সুব্রত বিশ্বাস : সম্প্রতি পঞ্চগড়ে পুরোহিত হত্যার পর সরকারের জিরো টলারেন্সের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ, র্যাব প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী-জঙ্গীদের গ্রেফতার করছে। তাদের নতুন নতুন পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে। জঙ্গী দমনে ইতিমধ্যে এন্টিটেররিস্ট নামে নতুন আরো একটি বাহিনী গড়া হয়েছে। অথচ দিদিমার গল্পের ন্যায় রাক্ষসদের জন্ম ঠেকানো যাচ্ছেনা। ক্স বার বার একই কায়দায় হত্যাকান্ড ঘটছে। ঘটনার পর পর আমেরিকার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ফেইসবুকে আই এস আই ঘটিয়েছে বলে পোস্টিং দিয়ে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রয়াস চলে। সরকার বলছে এখানে কোন আই এস আই নেই। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এদিকে চলতি সপ্তাহে আমেরিকা বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের আগামী মে মাস পর্যন্ত সতর্ক থাকার নির্দেশ প্রদান করা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
- অভিজ্ঞজন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আল কায়দা থেকে আই এস আই সবই একই সূত্রে গাথা। বাংলাদেশের জামায়াত আর আই এস আই-এর দর্শন এক ও অভিন্ন। রাষ্ট্রের ধর্ম হলো নিরপেক্ষ থাকা এবং সকল ধর্মের অধিকার নিশ্চিত রাখা। কোন ধর্মের প্রতি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা না করা। আর আই এস আই-এর ধর্ম হলো ওহাবিজমের মাধ্যমে বিশে^র মুসলমান দেশগুলোকে শরিয়া আইনের ছাতার নীচে নিয়ে আসা। বাংলাদেশের জামায়াতের দর্শনও তাই। এই দর্শন প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আই এস আই এবং বাংলাদেশের জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে কোন বিরোধ বা তফাৎ নেই।
- এজন্য প্রথম দিকে তারা সংখ্যালঘু, আদিবাসী, উপজাতি প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও নিরীহ জাতিগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। এখন আহমদিয়া, শিয়া, কাদিয়ানী, খৃস্টান সবার ওপর সমান্তরাল ভাবে হত্যাকান্ড শুরু করেছে। তাদের দর্শন মতে কোন মুসলিম দেশে অমুসলিম থাকতে পারবে না। পাকিস্তানে তাই এই কাজটি করা শুরু হয়েছে বহু আগে থেকে।
- এ লক্ষ্য নিয়েই প্রতিটি দেশে বেঙের ছাতার ন্যায় মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিদেশ থেকে বিপুল অর্থ যোগান আসছে। ধর্ম শিক্ষার নামে তৈরী হচ্ছে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী গোষ্ঠী। এসব সন্ত্রাসী জঙ্গীরাই হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। আই এস আই-এর ন্যায় একই কায়দায় চাপাতি কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যাকান্ড চালানো হয়। মাদ্রাসাগুলোতে জঙ্গী সৃষ্টি প্রমাণিত হওয়ায় ইতিমধ্যে পাকিস্তানে ২ হাজার মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
- বাংলাদেশেও একই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্বে সরকার সন্ত্রাসের শেকড় জামায়াত, ধর্মীয় রাজনীতি ও তাদের অর্থনৈতিক উৎসের প্রতিষ্ঠান এবং জঙ্গী তৈরির কারখানা মাদ্রাসাগুলো বন্ধে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না।
- আগে কওমী মাদ্রাসায় মওদুদীবাদ পড়ানোর অভিযোগ ছিল। এখন প্রকাশ্যে আলীয়া মাদ্রাসাগুলোতেও পড়ানো হচ্ছে। এসব মাদ্রাসায় প্রশিক্ষিত জঙ্গীরাই উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষিত ঘরের বহু ছেলে মেয়েদেরও এ পথে নিয়ে আসা হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এসব জঙ্গীদের গড়ে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্ম বা সৃষ্টির প্রতি তাদের কোন আনগত্য নেই। তাই মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়না। জাতীয় পতাকা উত্তোলনও হয়না।
- জামায়াত তাদের দর্শন মওদুদীবাদ ও ওহাবিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিএনপিকে যে তারা জামাতাইজেশন করে নিয়েছে বলাইবাহুল্য। এখন আওয়ামী লীগকে জামাতাজাইশেন করার প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়ায় ইতিপূর্বে ১৭ হাজার জামায়াত আওয়ামী লীগে যোগদানের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে অর্থের বিনিময়ে দল বহির্ভূত জামায়াতের লোকদের নমিনেশন পাইয়ে দিতে তৃণমূল আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। চেয়ারম্যান নির্বাচনেও একইভাবে স্থানীয় এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা অর্থের বিনিময়ে অর্থ ও বিত্তশালী জামায়াত, রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের নমিনেশন পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
- বিভিন্ন স্বার্থের বিণিময়ে জামায়াতকে দলভুক্ত করা কিংবা আওয়ামী লীগে জামায়াত ঢুকে পড়ার প্রক্রিয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগ থেকে উপরিভাগের শীর্ষ নেতারা জড়িয়ে আছেন। নির্বাচনী বৈতরনী পার হতে বিগত নির্বাচনে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ তাই জামায়াতের পুরো জেলা কমিটিকেই দলে অন্তর্ভূক্ত করে নেন। সম্প্রতি নৌপরিবহনমন্ত্রীর সভায় চট্টগ্রাম জামায়াত নেতা লতিফের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছাত্রলীগের সদ্য গঠিত কমিটিতে শিবিরের দাগী জঙ্গীদের অন্তর্ভূক্তির অভিযোগ উঠেছে।
- এমতাবস্থায় গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে পুলিশ বিভাগে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে জামায়াত বা প্রতিক্রিয়াশীল লোকজন যাতে নিয়োগ না পায় সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিজ্ঞ মহলের ধারনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর এরূপ আহ্বানের পেছনে নিশ্চয় কোন অশুভ ইঙ্গিত রয়েছে। সে ইঙ্গিতের বহিঃপ্রকাশ তাৎক্ষণিকভাবে লক্ষ্য করা গেছে পুলিশ প্রধানের পাল্টা বিবৃতির মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, যেহেতু জামায়াত নিষিদ্ধ নয়, তাই নিয়োগ দিতে আপত্তি কোথায়। প্রশ্ন আসে সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী না পুলিশ প্রধান।
- প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, জামায়াত আওয়ামী লীগে ঢোকার পাশাপাশি পুলিশ বিভাগেও নিয়োগের মাধ্যমে প্রবেশের প্রচেষ্টা হচ্ছে। যদিও পুলিশ প্রধান বলেছেন, কোন দুস্কৃতিকারী পুলিশে ঢোকতে পারবেনা। কিন্তু পুলিশের কর্মকান্ড নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। যে পুলিশ রাজীব হত্যাকারীকে অর্থের বিনিময়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়, টাকার জন্য ব্যাংক কর্মচারী, পৌর কর্মচারী, চা-দোকানীকে পেঠাতে এবং পুড়িয়ে মারতে পারে সেই পুলিশ টাকার বিনিময়ে পুলিশ বিভাগে জামাতের লোকজন নিয়োগ দিচ্ছে না সে নিশ্চয়তা কোথায়? পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দেশের সরকার প্রধানের আহ্বান নিশ্চয় তারই ইঙ্গিত বহন করে। জামায়াতকে পুলিশ বিভাগে নিয়োগ না দেওয়ার আহ্বানের ন্যায় ইতিপূর্বে জামাতকে দলে নেওয়ার ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান বা সতর্ক করা আদৌ মানা হয়? মানা হলে ১৭ হাজার জামায়াত দলে অন্তর্ভুক্ত হয় কিভাবে? নৌপরিবহনমন্ত্রীর পাশে জামাত নেতা লতিফ স্থান পায় কেমন করে।
- দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিরো টলােেরন্সর কথা বললেও চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসীদের লালন ও পার পাইয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা, এমপি, জিপি, এপিপিরা টু-পাইস কামিয়ে নিচ্ছেন। অভিযুুক্ত বা ধৃত জঙ্গী, সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবিরদের ছাড়িয়ে আনতে সুপারিশ করা, আল্গে রাখা কিংবা জামানত পাইয়ে দিতে সরকারী জিপি, এপিপিরা প্রধান ভুমিকা রাখছেন।
- প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ যথাসময়ে যথাযথভাবে পালিত হয়না। প্রধানমন্ত্রীর চারপাশের চাটুকাররা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে কমই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাদের সকলেই স্বার্থ উদ্ধারে আমলাদের সাথে দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছেন। পুলিশ বিভাগ, র্যাব, অফিস আদালতে আমলা-কর্মচারীদের বেশিরভাগ জামাত-বিএনপির আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা বসে আছে। অথচ সরকার পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। সরকারের এ নির্ভরশীলতা পুলিশ, র্যাব, আমলা-কর্মচারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশ যখন বলে মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশ এই কথার মাধ্যমেই পুলিশের বেপরোয়া চরিত্রের প্রকাশ পায়। এবং বলা চলে, তাদের কর্মকান্ড ক্রমে ক্রমে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
- সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কেন বন্ধ হচ্ছে না সম্প্রতি ৭১ টিভিতে এরূপ এক আলোচনায় জনৈক সাংবাদিক অভিযোগ করে বলেছেন, ২০০৯ সালে কয়েকটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল আজও সেগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তিনি আরো বলেন, অস্বীকার করার নয় পুলিশ অনেককে ধরছে। কিন্তু বহুক্ষেত্রে আসামীদের ছেড়ে দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে আসামীদের পক্ষে দুর্বল চার্জশীট দেওয়ার ঘটনাও তো অস্বীকার করা যাবেনা। অন্যদিকে পুলিশকে যথাযথভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়না এটাও তো সত্য। পুলিশ কি-না করতে পারে। অথচ সাগর-রুনি হত্যা, অভিজিৎ হত্যার অপরাধী কিংবা বর্ষবরণের রাতে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রী লাঞ্চনার অপরাধীদের ধরতে পারেনা কেন?
- আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ওলামা লীগ। ওলামা লীগ সাম্প্রতিককালে যেসব বক্তব্য রেখেছে তা জামাতের বক্তব্যকেও হার মানায়। অভিযোগ ওটার পরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমনকি ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন নয় বলে কোন বিবৃতি দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন হত্যাকান্ডে বিশেষ করে ব্লগার এবং ভিন্ন মতের লেখকদের হত্যা করার সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, র্যাব প্রধানরা হত্যাকারীদের অভিযুক্ত না করে প্রথমেই আক্রান্তকারীকে যেভাবে অভিযুক্ত করেন তাতে হত্যাকারীদের আস্কারা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
- পরিশেষে প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকে বলা যায়, গণতন্ত্রকে আপাতত পকেটে রেখে উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে কিংবা মাহফুজ আনামের ঘটনা টেনে এনে চারপাশের ছাইচাপা আগুন চাপা দেওয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে। অথচ এই চাপিয়ে চলা অবস্থানই যে সরকারকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে এই বাস্তবতা উপলদ্ধি করতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। যত শীঘ্র সরকার এ বস্তবতা উপলব্ধি করতে সমর্থ হবে দেশ ও সরকারের জন্য মঙ্গল। অন্যথায় চরম অশনিসংকেত যে দেশের ও জাতির জন্য অপেক্ষা করছে বলাইবাহুল্য
__._,_.___