একাত্তরের গণহত্যা
নিক্সন প্রশাসনের দায়
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূল এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। ঝড়ে কত লোকের মৃত্যু হয়েছিল তার সঠিক হিসাব হয়নি। তবে সংখ্যাটা তিন থেকে দশ লাখের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপদ্রুত এলাকা ঘুরে এসে ইয়াহিয়া-প্রশাসনের নির্লিপ্ততা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঝড়ে দশ লাখ লোক মারা গেছে। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরও দশ লাখ লোক প্রাণ দেবে।
শেখ মুজিবের কথায় আরেকটা ঝড়ের আভাস ছিল। তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সে পথে হাঁটেনি। লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। ডিসেম্বরে (১৯৭১) মস্কো থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রাভদায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ উল্লেখ করা হয়েছিল। এ দেশের মানুষ শিকার হয়েছিল স্মরণকালের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার।
২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটের প্রধান আর্চার কে ব্লাড ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাস ও ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে 'সিলেকটিভ জেনোসাইড' শিরোনামে একটা তারবার্তা পাঠান। বার্তার প্রথম লাইনটা ছিল, 'ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তা দেখে আমরা সন্ত্রস্ত এবং মূক হয়ে গেছি।'
২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তার অনুচরদের নির্বিচার গণহত্যা চলেছিল মাসের পর মাস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর প্রশাসনের প্রশ্রয় ছিল তাতে। বাংলাদেশ তখন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ঠান্ডা লড়াইয়ের শিকার হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারে দূতিয়ালি করেছিলেন নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেনরি কিসিঞ্জার। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক গড়ার জন্য মাধ্যম হিসেবে পাকিস্তানকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানকে যুক্তরাষ্ট্রের তখন খুবই দরকার। এ ব্যাপারে কিসিঞ্জারের বক্তব্য ছিল সোজাসাপটা। বিশ্বব্যাংকের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট ম্যাকনামারাকে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, 'আমাদের ছয় মাসের সময় দরকার কিংবা তার চেয়েও কম। তিন মাসের জন্য এদের (ইয়াহিয়া গং) দরকার। তারপর আমরা দয়া দেখাব' (কিসিঞ্জার-ম্যাকনামারা টেলকন, ২১ জুন ১৯৭১)।
বাংলাদেশে গণহত্যা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল। ইয়াহিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়ার কারণে বাঙালিদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। জুনের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে কমপক্ষে দুই লাখ লোক মারা গেছে। বিশ্বস্ত কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত সিডনি শেনবার্গের রিপোর্টে বলা হয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ মারা গেছে (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ আগস্ট ১৯৭১)। তা সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার প্রতি নিক্সন প্রশাসনের ভালোবাসার কমতি ছিল না। নিক্সনের মন্তব্য ছিল, 'ইয়াহিয়া একজন ভালো মানুষ। হাজার মাইল দূরে দেশের দুই অংশকে এক রাখার কঠিন কাজটি করছেন তিনি' (হোয়াইট হাউস টেপ, ওভাল অফিস ৫২০-৬, ১৫ জুন ১৯৭১)। নিক্সন প্রশাসনের পাকিস্তানপ্রীতি ও বাংলাদেশ নিয়ে ভূমিকার বিস্তারিত উঠে এসেছে গ্যারি জে বাস-এর বইয়ে—দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড অ্যা ফরগটেন জেনোসাইড (নিউইয়র্ক, ২০১৩)।
বাংলাদেশের অসহায় মানুষগুলো প্রাণ বাঁচানোর জন্য বানের জলের মতো সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকছিল। মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য-সংক্রান্ত দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে, জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার বাঙালি উদ্বাস্তু সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছিল। জুলাই মাসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় দৈনিক গড়ে ২১ হাজার। ২৪ মে ও ২৮ জুন নিক্সনকে লেখা চিঠিতে ইয়াহিয়া অনুযোগ করেন—'রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মানবিক সমস্যাকে পুঁজি করার কোনো যুক্তি নেই, ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের ছুতো খুঁজছে।' ২৮ জুন এক ভাষণে ইয়াহিয়া শরণার্থীদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নতুন একটা সংবিধান এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নতুন সরকার গঠন করা হবে। ইয়াহিয়া সেপ্টেম্বরে তার মন্ত্রিসভার সদস্য ডা. আবদুল মোতালেব মালেককে গভর্নর করে পূর্ব পাকিস্তানে একটা অসামরিক শিখণ্ডী সরকার বসিয়ে দেন।
শরণার্থী সমস্যা দিন দিন বাড়ছিল। এটা উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। নিক্সন ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাননি। কিসিঞ্জার নিক্সনকে পরামর্শ দেন, 'আপনি বলুন যে, শরণার্থীরা শিগগিরই পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারবে। তখন ইয়াহিয়া বলবে যে সে এটাই চায়। আমি সব ব্যবস্থা দূতাবাসের সঙ্গে করে রেখেছি। আপনি ভারতকে সংযত থাকতে বলুন, আমি ইয়াহিয়াকে খোশমেজাজে রাখব।' নিক্সন বেশ তিক্ততার সঙ্গে বলেছিলেন, 'ভারতীয়দের দরকার একটা—'। কিসিঞ্জারের ত্বরিত জবাব ছিল, 'তারা এমনই বেজন্মা' (হোয়াইট হাউস টেপ, ২৮ জুন ১৯৭১, সকাল ১০.২৩—১০৫১)।
ভারত শরণার্থীদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। উদ্বাস্তুদের জন্য ভারত পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ৭ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। নিক্সন ভেবেছিলেন, '৬০ লাখ উদ্বাস্তুর জন্য এই টাকা খুব সামান্য।' নিউইয়র্ক টাইমস ২২ জুন প্রথম পাতায় একটা খবর ছেপেছিল—'সামরিক যন্ত্রাংশ এবং আটটি যুদ্ধবিমান নিয়ে একটা পাকিস্তানি জাহাজ নিউইয়র্ক বন্দর ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি; সাঁজোয়া বাহিনীর জন্য যন্ত্রাংশ নিয়ে আরেকটা জাহাজ মে মাসেই রওনা দিয়ে এখন করাচির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।' কিসিঞ্জারের লোকেরা বলেছিল, 'আমাদের সামরিক সরবরাহ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তবতার দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ ঠেকিয়ে রাখার জন্য অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।' ডেমোক্র্যাট সিনেটর ফ্রাংক চার্চ কোস্টগার্ড পাঠিয়ে মার্কিন সমুদ্রসীমা থেকে অস্ত্রবাহী জাহাজটি ফিরিয়ে আনতে নিক্সনকে অনুরোধ করেছিলেন। ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি নিক্সন প্রশাসনের নীরবতা ও আত্মসন্তুষ্টি দেখে ক্ষোভ জানিয়ে বলেছিলেন, 'এটা বিবেকবর্জিত কাজ' (এনএসসি ফাইলস, চার্চ স্পিচ এবং কেনেডি স্পিচ, ২২ জুন ১৯৭১)।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরবরাহ পেয়ে ইয়াহিয়া প্রশাসন পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার নামে গণহত্যা জারি রাখে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক, গবেষক।
mohi2005@gmail.com
http://www.prothom-alo.com/opinion/article/808999/
Nixon and Kissinger's Forgotten Shame - The New York Times
Looking Away from Genocide - The New Yorker
Unholy Alliances - The New Yorker
'The Blood Telegram: Nixon, Kissinger, and a Forgotten ...
Bangladesh after 44 Years: From 'Bottomless Basket' to Full Basket Case!
Bangladesh after 44 Years: From 'Bottomless Basket' to Full ...
HENRY KISSINGER'S 1974 PLAN FOR FOOD CONTROL GENOCIDE;
__._,_.___