বিশ্বাসের ভাইরাস: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কি জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে?
পুলিশ অবশেষে ব্লগার রাজীব হায়দারের খুনিদের ধরতে পেরেছে। হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন ছাত্র – ফয়সাল বিন নাইম, মাকসুদুল হাসান অনিক, এহসানুর রেজা রোমান, নাঈম সিকদার ও নাফিস ইমতিয়াজকে আটক করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা পাঁচজনই এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরের গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন। তিনি শুধু একজন ব্লগারই ছিলেন না, পেশাগত জীবনে ছিলেন স্থপতি। তার অপরিসীম মেধার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে 'মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের নকশা' যা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে বলে আমরা পত্রিকায় জেনেছি। রাজীবকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার পলাশনগরের বাড়ির অদূরে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। পাঠকদের হয়তো মনে আছে, রাজীব মারা যাবার পর পরই আমি একটি পত্রিকায় লেখা লিখেছিলাম – 'কেন কেবল তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন?' শিরোনামে (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এ প্রকাশিত)। সে লেখায় আমি অনুমান করেছিলাম যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং মুক্তমত প্রকাশের কারণেই রাজীব ধর্মান্ধ শক্তির উষ্মার কারণ হয়েছেন, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে,ঠিক যেমনিভাবে ঘাতকাহত হয়ে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে চলে যেতে হয়েছিল প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে। আমার অনুমান যে মিথ্যা ছিল না তা ধরা পড়ার পর অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এক শিবির কর্মী, যে এখনো ধরা পড়েনি বলে জানানো হয়েছে। অভিযুক্ত আততায়ীদের বিভিন্ন ব্লগের ঠিকানা এবং ব্লগ থেকে ডাউনলোড করে তথ্য দিয়ে প্ররোচিত করেন শিবিরের ওই ব্যক্তি। রাজীবের লেখা তাদের 'ধর্মানুভূতি'কে আহত করেছিল, তাই 'ঈমানি দায়িত্ব পালনের জন্য এই হত্যাকাণ্ড' তারা ঘটিয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উগ্রবাদী আচরণের নিদর্শন এটাই প্রথম নয়। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামে যে ছেলেটি গত বছরের নভেম্বর মাসে নিউইয়র্কে বোমা হামলা করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, সেই ছেলেটিও বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। এখন রাজীবের হত্যাকারীরাও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় এ প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে – কেন নর্থ সাউথের মত বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে মূলতঃ উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ ছেলে মেয়েরা পড়তে যায় বলে সার্বিকভাবে অনুমিত হয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি জঙ্গিবাদের প্রজনন-ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে? ডাল কুছ মে কালা হ্যায়? এ নিয়ে আজ আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এ – 'নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি কি জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য?' শিরোনামে। তবে লেখাটির বেশ কিছু অংশ ২০১০ সালের পুরোন গোয়েন্দা রিপোর্টের উপর লেখা বলে কয়েকটি তথ্য হালনাগাদ ছিল না। এই ব্লগটি সে লেখারই আরেকটু বর্ধিত এবং সংশোধিত রূপ।
নর্থ সাউথ এর ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নিতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পেলাম। বেশ কিছু পত্রিকার (যেমন ৩ মার্চ, ২০১৩ জনকণ্ঠ দ্রঃ) খবরেই এসেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্রপন্থী দল হিযবুত তাহরীরের আস্তানায় পরিণত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হতে পারেন, নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীর ও শিবিরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি সক্রিয় থাকা দেশের একমাত্র বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নর্থ সাউথ। এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক-পরিচালনা পরিষদের কর্মকর্তা। বাইরে থেকে একটা 'সুবেশিত এবং আধুনিক' বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ তৈরি হলেও দিনের পর দিন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ট্রাস্টি বোর্ডের দুই সদস্য ও ৫ শিক্ষককের প্রত্যক্ষ মদদে উগ্র মৌলবাদীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি এমন আলামত বেরিয়ে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাঠচক্রের আড়ালে নিয়মিতভাবে হয় শিবির ও হিযবুত তাহরীরের 'ঐক্যবন্ধ বৈঠক'। এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক-পরিচালনা পরিষদ কর্মকর্তা। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অংশটি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিযবুত তাহরীর লালনকারী হিসেবে পরিচিত একজন শিক্ষককে ২০ লাখ টাকা বেতনে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের চেষ্টা চালায় (বাংলাদেশ প্রতিদিনে ২০১০ সালে প্রকাশিত 'নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজবুত তাহরীর' শিরোনামের প্রতিবেদন দ্রষ্টব্য)। জানা গেছে, হিযবুত তাহরীর নামে জঙ্গিবাদের বিস্তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ কিছুদিন ধরেই গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হিযবুত তাহরীরের বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ছিলেন বিএনপি মতাদর্শী অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল আহাদ। উদ্যোক্তা হিসেবে আরও ছিলেন শায়েস্তা আহমদ, ব্যবসায়ী নুরুল এইচ খান, মাহবুব হোসেন ও জামায়াতের নীতিনির্ধারক সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। এই শাহ আবুল হান্নান ইন্টারনেটে (বিভিন্ন ফোরাম এবং ইয়াহু এবং গুগল গ্রুপে) 'জামাতি প্রপাগাণ্ডা' চালানোর কাজে সদা তৎপর। তার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারসহ অনেক সিনিয়র নেতার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। সম্প্রতি শাহবাগ আন্দোলন চলাকালীন সময় শাহ আব্দুল হান্নান, এমবি আই মুন্সি এবং শমশের মোবিন চৌধুরীর একটি কথোপকথন ইন্টারনেটে ফাঁস হয়ে যায়। BJI International Relations (বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস) এর গ্রুপ ইমেইল চালাচালিতে এই জামাতি মতাদর্শের সৈনিকেরা শাহবাগ আন্দোলনকে 'ফ্যাসিবাদী আন্দোলন' হিসেবে অভিহিত করেন। ব্যাপারটা খুবই তাৎপর্যময় এজন্য যে, 'আমার দেশ' জামাতে ইসলামীর প্রপাগান্ডিস্ট এম বি আই মুন্সি এবং হান্নান শাহ-এর লানগুলোই হুবহু টুকে নিয়ে এর পর দিন পত্রিকার শিরোনাম করেছিল 'শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি' শিরোনামে। এ নিয়ে নিউ অরলিন্স প্রবাসী গবেষক ড. জাফর উল্লাহ তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে এই জামাতি-ত্রয়ীর গুমোড় ফাঁস করে দেন মুক্তমনার ইংরেজী ব্লগে । এই শাহ হান্নানের মত মৌলবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী উগ্রপন্থি মানুষ কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের দায়িত্ব পেতে পারেন তা আমার বোধগম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার পেছনে তার মদদ থাকলে সেটি আমাকে অন্ততঃ অবাক করবে না।
........
মুক্তমনা বাংলা ব্লগ - নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় শিবির এবং হিযবুত ...
মুক্তমনা বাংলা ব্লগ - বিশ্বাসের ভাইরাস এবং রাজীব হত্যা
মুক্তমনায় অভিজিৎ রায়
- ওয়েবসাইট: বাংলা, ইংরেজি
- ব্লগ: বাংলা, ইংরেজি
- বই: নির্দেশিকা, গুডরিডস
- অন্যান্য প্রবন্ধ: বাংলা, ইংরেজি অভিজিৎ রায়: ব্লগার এবং বিজ্ঞান লেখক।
অভিজিৎ রায়
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় জঙ্গি তৈরির কারখানা!
__._,_.___