বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ দেয়ায় ভিক্টিম ও সাক্ষীদের নানা ধরনের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। অনেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ দিতে নিরাপদবোধ করছেন না। তাঁদের নানভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, ট্রাইবু্যনালের বিধিমালায় সাৰীদের প্রটেকশনের কথা আছে। এ ছাড়া পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ট্রাইবু্যনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান বলেছেন, এমন অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যদিকে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, বিধিমালায় সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই, সাক্ষীরা যাতে নিরাপদে এসে সাৰ্য দিতে পারে সে জন্য 'উইটনেস প্রটেকশন ল' তৈরি করতে হবে। আইনের পাশাপাশি তাঁদের আর্থিক ও শারীরিক নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
এদিকে ভিক্টিম ও সাক্ষীরা এখন জীবনের নিরাপত্তাবোধ করছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে সাঈদীর মামলার ১৪তম সাৰী আব্দুল হালিম বাবুল অভিযোগ করেছেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়েছেন। সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম এ বিষযে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, এই অভিযোগ 'সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো নাটক'।
একইভাবে চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরম্নদ্ধে ২ জন সংখ্যালঘু প্রত্যক্ষ সাৰীকে ভয়ভীতি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যারা কু-েশ্বরী ঔষাধালয়ের অধ্যৰ্য নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে হত্যা করার দৃশ্য দেখেছিল। কৌশলগত কারণে তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। অন্য সাৰী মুক্তিযোদ্ধা সীরম্ন বাঙালী জনকণ্ঠকে বলেছেন, তাঁকেও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল। ঢাকার আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সাবেক আইজি এমএ হান্নান খানের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ দিলে তিনি ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বর্তমানে তাঁকে আর কোন হুমকি দেয়া হয়নি। সিরম্ন বাঙালী আরও বলেন, 'আমি সাকার বিরম্নদ্ধে অবশ্যই সাৰ্য দিব ট্রাইবু্যনালে এসে। সাকা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি কখনও চুপ থাকতে পারি না।'
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, কোন সাৰী যদি জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে বা তাকে কেউ হুমকি প্রদর্শন করে, তা হলে সে পুলিশকে বিষয়টি জানাতে পারে। পুলিশ অভিযোগ পেলে অবশ্যই ত্বরিত গতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তিনি আরও বলেন, ট্রাইবু্যনালের বিধিমালা আছে, সেখানে ভিকটিম ও সাৰীদের প্রটেকশনের বিষয়টি রয়েছে। নতুন আইন করার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সময়সাপেৰ। ট্রাইবু্যনালের বিধিমালায় যে প্রটেকশনের কথা আছে তা দিয়েই সাৰীদের নিরাপত্তা দেয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে তদনত্ম সংস্থার প্রধান সাবেক আইজি এমএ হান্নান খান জনকণ্ঠকে বলেন, যদি কোন সাৰীকে হুমকি ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়, তা হলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিব।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাৰী যাতে নিরাপদে এসে আসামির বিরম্নদ্ধে সাৰ্য প্রদান করতে পারে সেজন্য 'উইটনেস প্রটেকশন ল' তৈরি করতে হবে।
এর আগে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নেতা, পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকারও বলেছেন, দেশে বিচার কাজ শুরম্ন হলে অনেকে যুদ্ধাপরাধের বিরম্নদ্ধে সাৰ্য দিতে নিরাপদবোধ করছেন না। নানাভাবে তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। সাৰ্য দিলে তাদের জীবন বিপন্ন করে দেয়া হবে এমন ভয়ও দেখান হচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব সাৰীদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া। বিচার কাজ আরও ভালোভাবে সম্পন্ন করতে দ্রম্নত বিচার শেষ করতে, স্বচ্ছভাবে শেষ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিধিমালাতে ভিক্টিম ও সাৰীদের নিরাপত্তার কথা আছে। কিন্তু কিভাবে প্রটেকশন দেয়া হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এ ৰেত্রে আমার দাবি প্রথমত ভিক্টিম ও সাৰী প্রটেকশনের ব্যাবস্থা শুধু থাকলেই চলবে না, প্রক্রিয়ায় আনতে হবে। এটা তো নিশ্চিত করা দরকার। প্রটেকশনটা খুবই প্রয়োজন। ওভারঅল পরিস্থিতি যারা বানচাল করতে চায়, ওই পৰ যে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম, চক্রানত্মমূলক রাষ্ট্রদ্রোহমূলক যে সব কাজকর্ম করছে। এ সব কার্যক্রমকে বাসত্মব বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে যদি নিশ্চিত করা যায় এবং নিশ্চিতের লৰ্যে ভিক্টিম ও সাৰীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে ও নিশ্চিত করতে হবে। শুধু সেস্নাগানের মধ্যে রাখলে চলবে না।
আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে এখন পর্যনত্ম জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরম্নদ্ধে সাৰ্যগ্রহণ চলছে। সাঈদীর বিরম্নদ্ধে প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ ও জেরার কাজ শুরম্ন হয় গত বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে। প্রথম থেকে যেসব সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা ইতোমধ্যে শেষ করেছে আদালত তাঁরা হলেন, মাহাবুব উদ্দিন হাওলাদার, রম্নহুল আমীন নবীন, মিজানুর রহমান তালুকদার, সুলতান আহমেদ হাওলাদার, মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার, মানিক পসারি, মফিজ উদ্দিন পসারি, মোঃ মোসত্মফা হাওলাদার, মোঃ আলতাফ হোসেন হাওলাদার, বাসুদেব মিস্ত্রি, আব্দুল জলিল শেখ, আব্দুল আওয়াল এমপি (বর্তমান), গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা ও আব্দুল হালিম বাবুল। মঙ্গলবার ১৫তম সাৰী মধুসূদন ঘরামী সাঈদীর বিরম্নদ্ধে জবানবন্দী প্রদান করবেন।
১৭ জানুয়ারি সাঈদীর বিরম্নদ্ধে ১৪তম সাৰী আবদুল হালিম বাবুল সাৰ্য দিতে গিয়ে ট্রাইবু্যনালে বলেন, 'এই আইনজীবীরা সাত-আটশ' লোক নিয়ে বাড়িতে গিয়ে আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এসেছে। আমরা একাত্তরে নির্যাতিত। এখন আমাদের দেশানত্মর করতে চায়।' এ ঘটনার পর ১৯ জানুযারি সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির দক্ষিণ হলে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তাজুল ইসলাম বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত অভিযোগকে 'সম্পূর্ণ মিথ্যা ও সাজানো নাটক'। হুমকি দেয়ার এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।