জনসমুদ্রে খালেদার উদ্দেশে শেখ হাসিনা : পেছনের দরজা ভুলে যান, যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জনতার মহাসাগরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দুই নম্বর পথে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন ভুলে যাওয়ার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছেন। দুই নম্বর পথে ক্ষমতায় যেতে চান, বাংলাদেশে আর কোনদিন তা হবে না। পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন ভুলে যান। অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলের দিন শেষ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, জনতার মহাসাগরে যে ঢেউ জেগেছে, অবশ্যই বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। এখন থেকে গণতান্ত্রিক পথেই দেশ চলবে, অন্য কোন পথে নয়। বিরোধীদলীয় নেত্রী যতই চেষ্টা করুক রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের বাংলার মাটিতেই বিচার হবে, কেউ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। বাংলাদেশের মাটিতে পরাজিত শত্রু রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই হবে না।
একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে খালেদা জিয়ার অর্থ গ্রহণের তীব্র সমালোচনা করে চৌদ্দ দল নেত্রী বলেন, 'থলের বিড়াল আজ বেরিয়ে পড়েছে। আপনি '৯১ সালের নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, আজও নিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তানের প্রতি যদি আপনার এতই দরদ থাকে তবে সে দেশেই চলে যান। বাংলাদেশে থেকে দেশের মাটিকে আর কলুষিত করবেন না। আওয়ামী লীগ কখনই কোন বিদেশী শক্তির কাছে মাথা নত করে না। বরং বিরোধীদলীয় নেত্রীই মাথা নত করেন তাদের কাছে, যাদের আমরা একাত্তরে পরাজিত করেছি। এ জন্য তাঁর লজ্জা পাওয়া উচিত।
চৌদ্দ দল আয়োজিত তীব্র জনস্রোতের সামনে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, দেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে আর কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধ করে আমরা দেশকে স্বাধীন করেছি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকবে, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত থাকবে। গত তিনটি বছরে প্রতিটি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, আগামী নির্বাচনও অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে। জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে আর কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। ক্ষমতায় থাকতে নৌকার ভোট ঠেকাতে অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। আগামী নির্বাচনেও পারবেন না ইনশাল্লাহ্।
বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ের সামনে বুধবার বিকেলে চৌদ্দ দল আয়োজিত জনসভায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটিয়ে বড় ধরনেরই শোডাউন করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিএনপি-জামায়াত জোটের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে এ জনসভার আয়োজন করা হলেও তীব্র জনস্রোতে এক পর্যায়ে জনসভাটি রীতিমতো জনসমুদ্রে রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটের সামনে মূল মঞ্চ নির্মাণ করা হলেও জনসভার বিস্তৃত পুরো বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, গুলিস্তান উপচিয়ে একদিকে জিরো পয়েন্ট থেকে কার্জন হল, গুলিস্তান থেকে সিদ্দিকবাজার, বঙ্গবন্ধু স্কোয়ার থেকে নবাবপুর, গুলিস্তান থেকে ফকিরাপুল এবং জিরো পয়েন্ট থেকে মুক্তাঙ্গন, প্রেসক্লাব, বিজয়নগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
চৌদ্দ দলের সমাবেশ উপলক্ষে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে সকাল থেকেই সমাবেশস্থলে মিছিল নিয়ে আসতে থাকে নেতাকর্মীরা। দুপুরের আগেই পুরো এলাকা মানুষে মানুষে সয়লাব হয়ে যায়। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে সকাল থেকেই মূল মঞ্চ থেকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর বজ্রকঠিন ভাষণ এবং গণসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বিকেল চারটার দিকে যখন প্রধানমন্ত্রী জনসভার মঞ্চে আসেন তার আগেই প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় মানুষের তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রায় ৪০ মিনিটের ভাষণে ১২ মার্চ বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দিলেও তাঁর দেয়া ৯০ দিনের আলটিমেটাম এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন কথা বলেননি।
চৌদ্দ দলের সমন্বয়ক ও জাতীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিম, মাহবুব-উল-আলম হানিফ, ১১ দলের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, মইনউদ্দিন খান বাদল এমপি, সাম্যবাদী দলের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া, ন্যাপের এ্যাডভোকেট এনামুল হক, গণআজাদী লীগের হাজী আবদুস সামাদ, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, গণতন্ত্রী পার্টির শাহাদাৎ হোসেন, নগর আওয়ামী লীগের এমএ আজিজ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, মোল্লা মোঃ আবু কাউছার, আশরাফুন্নেসা মোশাররফ এমপি, নাজমা আখতার এমপি ও এসএম বদিউজ্জামান সোহাগ। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ওবায়দুল কাদেরসহ চৌদ্দ দলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নূহ-উল-আলম লেনিন ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
বিশাল এ জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সাংবিধান পথ পছন্দ করেন না, তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের মতোই তিনি (খালেদা) অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতায় দখলে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, আজ থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। খালেদা জিয়া কথায় কথায় বিদেশী দালাল খুঁজে বেড়ান। আজ পাকিস্তানের আদালতে আইএসআইর সাবেক প্রধান হলফনামা দিয়ে বলেছেন, '৯১ সালের নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে তারা টাকা দিয়েছেন। একাত্তরের পরাজিত শক্তির কাছে দেশ তিনি দেশ বিক্রি করতে চান বলেই তিনি ক্ষমতায় থেকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসীদের দিয়ে গ্রেনেড মেরে মানুষ খুন করিয়েছেন। আজও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এবং স্বাধীনতার মাস মার্চকে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার-আলবদরদের বাঁচানোর জন্য বেছে নিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য তিনি ঢাকা অচল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যখন শুরু হয়েছে তখন তিনি (খালেদা জিয়া) হত্যা, সন্ত্রাস, বোমা ও আগুন দিয়ে মানুষ খুন করে নৈরাজ্যের পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী যতই চেষ্টা করুন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারবেন না। খালেদা জিয়া ও তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষায় মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছেন, বিদেশে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। কিন্তু রক্ষা করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার হয়েছে, রায়ও কার্যকর হয়েছে। ইনশাল্লাহ্ বাংলার মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। কেউ তাদের রক্ষা করতে পারবে না।
১৮ মার্চে বিএনপি-জামায়াত জোটের দেশব্যাপী তা-ব, বোমা ও আগুন দিয়ে মানুষ খুনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থেকে আমরা প্রতিশোধের রাজনীতি করিনি। কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলেই ১৮ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার নামে ফজরের নামাজের সময় বোমা মেরে, গাড়িতে আগুন ধরিয়ে মানুষ হত্যা করার পরও আপনাদের কোন কর্মসূচীতে আমরা বাধা দেইনি। বিরোধী দল লংমার্চ, গাড়ি মার্চ, সভা-সমাবেশ সবই করেছে। শুধু একটি শর্ত ছিল কর্মসূচীর নামে তারা বোমাবাজি, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর করবে না।
এ প্রসঙ্গে তিনি বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছরের শাসনামলে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতনের কথা তুলে ধরে বলেন, খালেদা জিয়া কর্মসূচীতে বাধা প্রদানের কথা বলেন, কিন্তু তাঁর পাঁচ বছরের শাসনামলে একদিনও আমাদের রাস্তায় পর্যন্ত দাঁড়াতে দেননি। নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য জোটের ক্যাডাররা ছয় বছরের শিশু কন্যাকে পর্যন্ত ধর্ষণ করেছে। হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা, নির্যাতন করেছে। দেশের এমন কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ নেই যে যার গায়ে খালেদা জিয়ার হাতের নির্যাতনের দাগ নেই। আমরা ক্ষমতায় এসে সে পথে যাইনি, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলেই প্রতিশোধের রাজনীতি করিনি।
বিরোধী দলের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে খালেদা জিয়ারা বিচার বিভাগ-প্রশাসন-সংসদ সবকিছুকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। ভুয়া সার্টিফিকেটধারীকে বিচারক করেছেন, ভোট চুরির জন্য প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেন, প্রশাসনকে নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ এবং প্রায় ১৩শ' কর্মকর্তাকে ওএসডি করেন, দলীয় লোককে নিয়োগ দিতে বিসিএসের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পর্যন্ত ফাঁস করেন। আপনার (খালেদা) মুখে বড় বড় কথা মানায় না।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া পাঁচ বছর দেশ চালাননি, বরং সবকিছু ধ্বংস করে গেছেন। ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করে অর্থ বানানো আর বিদেশে পাচার করাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। ক্ষমতায় থাকতে প্রায় দেড়শ' স্যুটকেস করে সম্পদ পাচারের ঘটনাও দেশবাসী জানে। আর তাঁর দুই পুত্রের বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা মার্কিন ফেডারেল কোর্টে প্রমাণিত হয়েছে। এফবিআই বাংলাদেশে এসে সাক্ষী দিয়ে গেছে তাঁর দুই পুত্রের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের তথ্য। ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করে নিজেও জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করেছেন। এসবের কী জবাব দেবেন আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া? ক্ষমতায় থেকে খালেদা জিয়া সার্থক হয়েছেন শুধুমাত্র জঙ্গীবাদ সৃষ্টি, দুর্নীতি করে অর্থ বানানো আর নির্বিচারে মানুষ হত্যা। আর কিছুতেই তিনি সফলতা দেখাতে পারেননি।
দেশের গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষমতায় আসার পর অনেক টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছি। সংবাদপত্রগুলোও যে যেভাবে খুশি সরকারের সমালোচনা করতে পারছে, আমরা কোথাও কোন বাধা দেইনি। খালেদা জিয়া সাংবাদিক নির্যাতনের কথা বলেন, কিন্তু তাঁর আমলে ১৬ সাংবাদিককে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে, প্রায় ১৮শ' সাংবাদিককে নির্যাতন করেছেন। যাদের অনেকেই আজ পঙ্গুত্ব নিয়ে বেছে রয়েছেন।
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ কখনই ব্যর্থ হয় না। গত তিন বছরে আমরা দেশে বোমাবাজি করতে দেইনি, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাস সৃষ্টি হতে দেইনি। দেশে সুশাসন কায়েম করেছি। বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছি, খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তুলেছি। জিনিসপত্রের দাম কমিয়েছি, মানুষের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছি। দেশে আজ কোথাও দুর্ভিক্ষ নেই, মঙ্গা নেই, খাদ্যের অভাব নেই। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল হিসেবে পরিচিত পাচ্ছে। তিনি বলেন, এই তিন বছরে আমরা ৬৮ লাখ ৫১৬ জন বেকারের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছি, সাড়ে চার লাখ বেকারকে সরকারি চাকরি দিয়েছি।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ক্ষমতায় থাকলে ভারতপ্রীতি, আর বিরোধী দলের গেলে ভারতবিরোধী- এটাই খালেদা জিয়ার নীতি। তিনি কখনও দেশের স্বার্থ রক্ষা করেননি। আমরা গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছি, আর উনি (খালেদা) দিল্লী গিয়ে গঙ্গার পানির কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতায় থাকতে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। কিন্তু আমরা ভারত সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি, এ বাধা নির্মাণের প্রাক-জরিপে অবশ্যই বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে রাখতে হবে। বিএনপি-জাতীয় পার্টি ২৮/২০ বছর ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু দেশের সীমানা নির্ধারণ করেননি। আমরা তা করেছি।
দেশের অর্থনীতি খারাপ- খালেদা জিয়ার এ অভিযোগের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের নয়, উনার (খালেদা) নিজের অর্থনীতি খারাপ হতে পারে। জনগণের অর্থসম্পদ চুরি করে সম্পদশালী হয়েছেন। বিদ্যুতের নামে খাম্বা দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। জনগণের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছেন। সরকারী অর্থ ব্যয় করে উনার দুই ছেলেকে কি শিক্ষা দিয়েছেন? একজন সন্ত্রাস গ্রেনেড মারা আর দুর্নীতি করে বিদেশে অর্থ পাচার, আর অন্যজন ড্রাগে গ্রাজুয়েশন করেছে। দেশের মানুষের শান্তি উনার (খালেদা) পছন্দ হচ্ছে না। তাই স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে তিনি নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করছেন। কিন্তু কোন লাভ হবে না। আমরা দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলবই ইনশাল্লাহ।
১৪ দলের নেতারা যা বলেন
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়াউর রহমানসহ অনেকেই আমাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু কেউই আওয়ামী লীগকে দমাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তখন আপনি খালেদা জিয়া দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় ষড়যন্ত্র করছেন। কিন্তু দেশের মানুষ আপনাদের চিনে ফেলেছে। খালেদা জিয়া আইএসআই থেকে টাকা নিয়ে রাজনীতি করেন উল্লেখ করে সাজেদা চৌধুরী বলেন, পাকিস্তানের টাকায় রাজনীতি করার জবাব দিতে হবে। জনগণ জানতে চায় মাসে মাসে আপনি কত টাকা পান? পাকিস্তানের টাকা নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন তা হবে না।
উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ১৪ দলের এ মহাসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত করে জনগণ প্রমাণ করেছে, মার্চ মাস বঙ্গবন্ধুর মাস। মার্চ মাস আওয়ামী লীগের মাস। মার্চ মাস শেখ হাসিনার মাস। তিনি খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, আপনি যাদের সঙ্গে নিয়ে হুংকার দিচ্ছেন তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তি। পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে হুংকার দিয়ে বাংলার জনগণকে পরাজিত করা যাবে না।
উপদেষ্টাম-লীর আরেক সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা আজকে সমাবেশ ডেকেছিলাম। হয়ে গেছে মহাসমাবেশ। আর মহাসমাবেশ পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। তিনি বলেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে তাহরীর স্কয়ার বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশের জনগণ সাড়া দেয়নি। জনগণ আজকে শেখ হাসিনার ডাকে মহাসমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করেছে। তিনি শেখ হাসিনা নির্দেশে দেশের মানুষকে একাত্তরের মতো আবার গর্জে উঠে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দেয়ার আহ্বান জানান। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, আল্টিমেটাম দিয়েছেন, কিন্তু সেটা কিসের আল্টিমেটাম? আল্টিমেটাম কী যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায়, আপনার দুর্নীতিবাজ পুত্রদের রক্ষায়, আল্টিমেটাম কী আপনার দুনীতি রক্ষায়? যদি তাই হয় তাহলে কোন ছাড় নেই। রেলমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, '৭২-এর সংবিধান, জাতির জনকের বিষয়ে কোন ছাড় নয়।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের নামে বোমাবাজি, নৈরাজ্য কেন- এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। খালেদা জিয়াকে আইএসআইয়ের 'পোষা ময়না' উল্লেখ করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা তাকে যা বলেন, তিনি তাই করেন।
সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সমাবেশ করলেও সমাবেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কিছু বলেননি। খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে। তার বক্তব্য ছিল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবিসহ ঘাতকদের জড়ো করা হচ্ছিল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার জন্য। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতার জন্য খালেদা জিয়া সফল হননি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে প্রায় ৫ হাজার দুইশ' নির্বাচন হয়েছে, তার সবগুলোই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এসব নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল বিএনপিসহ কোন দল, গণমাধ্যম কেউই কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন দেশে- বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আর তাই যদি হয় তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেন শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু হবে না? অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, খালেদা জিয়া আমাদের বলেন, আন্দোলন করে নাকি আমাদের হটিয়ে দেবে। কিন্তু আমরা বলতে চাই- আন্দোলন কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী তা আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। কাজেই আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণকে আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গীমুক্ত বাংলাদেশ চান, নাকি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জঙ্গী দেশ চান? তিনি বলেন, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদালতের রায়ে বাতিল করা হয়েছে তা আর ফিরে আসবে না। ন্যাড়া বার বার বেল তলায় যাবে না। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপি বলে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে নয়। তবে তাদের সমাবেশে যখন দেখা যায় গোলাম আযম, নিজামীদের মুক্তি দাবি সম্বলিত পোস্টার, তাদের সমাবেশে টাঙ্গানো হয় যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি সম্বলিত সেøাগান, তখন এর অর্থ কী দাঁড়ায়? তিনি নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে সংসদে আসার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান।
জাসদের হাসানুল হক ইনু মহাজোট গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, খালেদা- নিজামীর সরকার যখন আফগান স্টাইলে দেশ পরিচালনা করছিল, দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল সেই প্রেক্ষাপটে মহাজোট গঠন হয়। গত তিন বছরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশকে অন্ধকার থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে তখন খালেদা জিয়া আবারও দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। খালেদা জিয়ার আল্টিমেটামের জবাবে ইনু বলেন, উনি সমস্যার সমাধানের কথা বলেননি। কোন প্রস্তাবও দেননি। উনি দিয়েছেন উৎখাতের হুমকি। যদি উনি নির্বাচনী ব্যবস্থার বিকল্প কোন প্রস্তাব দিতেন তাহলে বুঝতাম উনি গণতন্ত্রের কথা বলছেন। মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, শেখ হাসিনার ডাকে লাখ লাখ মানুষ আজকের মহাসমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করেছে। বিরোধী দল বলেছিল, ১২ মার্চের সমাবেশ রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হবে। আসলে ১২ মার্চ খালেদা জিয়াদের রাজনৈতিক কবর রচনা হয়েছে । জনগণ আপনাদের ডাকে সাড়া দেয়নি।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া বলেন, দেশে একদিকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অন্যদিকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে, দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে হবে।
ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট এনামুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলে ঐক্যবদ্ধ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সকল ষড়যন্ত্র নসাৎ করে দিতে হবে।
জাসদের কার্যকরী সভাপতি মাইনুদ্দিন খান বাদল খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের ঘাতকদের সঙ্গ ত্যাগ করলে আপনার সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। তা না হলে আলোচনা হবে কীনা তাও সন্দেহ আছে।