বিশেষ প্রতিনিধি ॥ যেন রীতিমতো জনারণ্য! বিএনপির মহাসমাবেশের একদিন পর পাল্টা শোডাউন হিসেবে রাজধানীবাসী দেখল জনসমুদ্রের গর্জন! আর এই সমুদ্রের গর্জন ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর তাদের রক্ষার ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। বুধবার লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে ১৪ দলের জনসভায় তীব্র জনস্রোতে কয়েক ঘণ্টার জন্য যেন থমকে গিয়েছিল ঢাকা মহানগরী। বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু স্কোয়ার, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার, দৈনিক বাংলা, ফকিরাপুল, পল্টন, বিজয়নগর, জাতীয় প্রেসক্লাব, হাইকোর্ট, কার্জন হল পর্যন্ত চতুর্দিকের দীর্ঘ পথই ছিল জনতরঙ্গ। যেন জনতরঙ্গের শুরু আছে, শেষ নেই। জনতরঙ্গ থেকে ভেসে আসা লাখো মানুষের গগনবিদারী একই সেøাগান- 'বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই নাই', বীর বাঙালী ঐক্য গড়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কর।'
বিএনপির মহাসমাবেশের জবাব দিতে বুধবার রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিত ঘটিয়ে বেশ ভালই পাল্টা জবাব দিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দল। জনসভার প্রস্তুতি ছিল ব্যাপকই। কিন্তু কর্মসূচীতে এমন যে গণবিস্ফোরণ ঘটবে তা আয়োজকদেরও হতবাক করে দেয়। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে এই জনসভাকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ-গুলিস্তানের চতুর্দিকে এত মানুষের স্থান সঙ্কুলান হবে না এটা আঁচ করতে পেরে মঞ্চের চতুর্দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার পথেই শত শত মাইক টাঙিয়ে দেন আয়োজকরা।
কিন্তু বিকেলের আগেই তীব্র জনস্রোতে রীতিমতো জনসমুদ্রে রূপ নেয় জনসভা। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের দুই সড়কের মোহনায় বিশাল মঞ্চ হলেও বিকেলের পূর্বেই জনসমাগম পশ্চিমে প্রেসক্লাব, উত্তরে কাকরাইল, পূর্বে পল্টন এবং উত্তরে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ ছাড়িয়ে সিদ্দিকবাজার, নবাবপুর, ফকিরাপুল ছাড়িয়ে যায়। পল্টন ময়দানেও হাজার হাজার মানুষকে অবস্থান নিতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষ হওয়ার সময়ও বিভিন্ন স্থান থেকে জনসভায় মিছিল নিয়ে লোক আসতে দেখা গেছে।
সকাল থেকেই এ জনসভাকে কেন্দ্র করে ১৪ দলের মধ্যে দেখা যায় উৎসবের আমেজ। বেলা ১২টার আগেই পল্টন থেকে পুরো গুলিস্তান-বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পুরো এলাকায় গড়ে তোলে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাসে-ট্রাকে করে নেতাকর্মীরা আসতে থাকেন জনসভাস্থলে। জনসভার মঞ্চ থেকে সকাল থেকেই পরিবেশন করা হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বজ্রকঠিন ভাষণ আর গণসঙ্গীত। আয়োজক চৌদ্দ দল হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হাজার হাজার সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখের পড়ার মতো।
বেলা ১২টা থেকেই ঢাকা মহানগরীর ৪৬ থানা, এক শ'টি ওয়ার্ড, ১৭টি ইউনিয়ন এবং ১৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে ব্যান্ডের তালে তালে নেচে-গেয়ে বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে আসতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। মিছিলে মিছিলে কার্যত পুরো ঢাকা যেন কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। আওয়ামী লীগ তাদের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অজস্র সংগঠন মিছিল নিয়ে আসতে থাকে সমাবেশস্থলে। বিশেষ করে অসংখ্য ব্যানার, ফেস্টুন ও বিশাল বিশাল মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের উদ্যোগে কয়েক শ' রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা গণমিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হলে এলাকার পুরো পরিবেশই যেন পাল্টে যায়।
বেলা তিনটায় সমাবেশ শুরুর আগেই প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এক পর্যায়ে দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় যেন মানুষের বাঁধভাঙ্গা স্রোত নামে। এক পর্যায়ে একদিকে জিরো পয়েন্ট, পল্টন, জাতীয় প্রেসক্লাব, অন্যদিকে গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু স্কোয়ার, জাতীয় স্টেডিয়াম, ফকিরাপুল, সচিবালয় হয়ে কার্জন হল, কাকরাইল, বিজয়নগর সর্বত্রই লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। তবে সারাদেশ থেকেই ব্যাপক নেতাকর্মী ঢাকায় আসায় তাদের শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি আয়োজকরা। একদিক থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে এলেও অন্যদিকে শত শত লোককে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে শুরুর পর পরই চলে যেতে দেখা গেছে। নিজ নিজ জেলায় দ্রুত ফিরতেই নেতাকর্মীদের এই আসা-যাওয়া ছিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই।
ঢাকার আশপাশের জেলাসহ ঢাকা মহানগরীর ১৫ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে আসা বিশাল বিশাল মিছিল নগরবাসীর দৃষ্টি কাড়ে। বিশেষ করে আসলামুল হক আসলাম ও ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লার নেতৃত্বে শত শত গাড়ির বহর নিয়ে বর্ণাঢ্য সাজে হাজার হাজার নেতাকর্মীর শোডাউন সবার দৃষ্টি কাড়ে। এ ছাড়া সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবের হোসেন চৌধুরী, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, কামাল আহমেদ মজুমদার, হাবিবুর রহমান মোল্লা, এ্যাডভোকেট সানজিদা খানম, আসাদুজ্জামান খান কামাল, নসরুল হামিদ বিপু, মিজানুর রহমান খান দীপু, রহমত উল্লাহ, হাবিবুর রহমান মোল্লা, গাজীপুর থেকে মেহের আফরোজ চুমকি, নারায়ণগঞ্জ থেকে শামীম ওসমান, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাভার থেকে তালুকদার মুরাদ জয়ের নেতৃত্বে আসা বিশাল বিশাল মিছিল ছিল উল্লেখ করার মতো।
শুধু ঢাকা আশপাশের জেলা বা ঢাকা মহানগরীরই নয়, সকাল থেকেই মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, ভোলা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জসহ অসংখ্য জেলা থেকেও হাজার হাজার নেতাকর্মী বাস-ট্রাকে চড়ে এসে জনসভায় যোগ দিতে দেখা যায়। দুপুর থেকেই তীব্র জনস্রোত ও মিছিলের কারণে এই পুরো এলাকায় প্রচ- যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, বিএমএ, এসেনসিয়াল ড্রাগস, টিএ্যান্ডটি ফেডারেল ইউনিয়নসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসংখ্য সংগঠনও মিছিল নিয়ে চৌদ্দ দলের জনসভায় যোগ দিতে দেখা যায়
আয়োজক চৌদ্দ দল হলেও এই জনসভাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সুবিশাল এ গণর্যালিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অসংখ্য সাধারণ মানুষকে অংশ নিতে দেখা যায়। বিশেষ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের হাজার হাজার মাুনষকে নিয়ে বড় বড় শোডাউন সবার দৃষ্টি কাড়ে।
বিশাল এই জনসমুদ্র থেকে চৌদ্দ দলের কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে দীপ্ত শপথ- যতদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন না হবে ততদিন রাজপথ ছেড়ে যাবে না মহাজোটের নেতাকর্মীরা। সারাদেশের পাড়া-মহল্লা, শহর-বন্দরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষকে সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার দৃঢ় অঙ্গীকার জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকার-আলবদরদের ঠাঁই হবে না। বিরোধী দল যতই ষড়যন্ত্র করুক, বাংলার মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।
এমন বাঁধভাঙ্গা মানুষের গণজোয়ার অনেকদিনই দেখেনি রাজধানীবাসী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন এবং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় মাঠে নামা বিএনপি-জামায়াত জোটের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথে রাজধানীতে লাখো মানুষের বাঁধভাঙ্গা স্রোত নামিয়ে বুধবার বড় ধরনের শোডাউন করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দল। সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বিএনপির মহাসমাবেশের তিনগুণ লোক সমাগম ঘটিয়ে ভালই শোডাউন করল চৌদ্দ দল।