বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে উদ্দেশ করে বলেছেন, নিজেরা অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যা-খুন করে আবার বড় বড় আওয়াজ করবে, বাংলাদেশের জনগণ আর তা বরদাশ্ত করবে না। নিজেরা অপরাধ করে উল্টো বড় বড় কথা বলবে, দেশের জনগণ আর তা সহ্য করবে না। বিরোধীদলীয় নেত্রী (খালেদা জিয়া) চান না দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে বড় হোক। তাই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নষ্ট করতে যা যা করার তাই তিনি করে যাচ্ছেন। যতই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হোক, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, ইনশাল্লাহ ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছরে যারা দেশের মানুষকে অত্যাচার-নির্যাতন-গণধর্ষণ ও হত্যা করেছে তাদেরও বিচার বাংলার মাটিতেই হবে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ও বিকেলে দু'দফায় ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে সূচনা ও সমাপনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিএনপি তাদের জোটের পরিধি যতই বাড়াক, ওই পাঁচ বছরে তাদের দুঃশাসন, অত্যাচার-নির্যাতনের কথা দেশের জনগণ ভুলে যায়নি। আমরা ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধের রাজনীতি করিনি। আমাদের সকল শক্তি ব্যয় করেছি দেশ ও জনগণের উন্নয়নে।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে ক্ষমতা মানেই দেশের মানুষের সেবা করা, বিএনপির মতো নিজেদের আখের গোছাতে নয়। আমরা সংবিধান সংশোধন করে ভবিষ্যতে কোন অসাংবিধানিক বা অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় না আসতে পারে, আসলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করেছি। সংবিধান সংশোধন করে আমরা জনগণের সাংবিধানিক ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছি। আমরা দেশকে উন্নতি-সমৃদ্ধি, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা করে গড়ে তুলবই।
বিরোধী দলের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল। আমরা শক্তহাতে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতি দমন করেছি এটা বিরোধীদলীয় নেত্রীর পছন্দ নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি এটাও তাঁর (খালেদা জিয়া) পছন্দ নয়। কারণ স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের নিয়েই তাঁর ঘর-সংসার। কিন্তু আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। এতিমের টাকা মেরে খাওয়ায় তাঁর (খালেদা) বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। আমরা কোন কাজে হস্তক্ষেপ করছি না। তাই অপরাধ করলে অপরাধীদের বিচার হবেই।
গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই তৃণমূল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। তবে দু'দফা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে দেশের জ্বলন্ত ইস্যু বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর কথিত নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, সাংবাদিক সম্মেলন করে বিরোধী দলের নেতার চারদিনের আল্টিমেটাম প্রদানসহ সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি কথাও বলেননি। তবে তৃণমূল নেতাদের তিনি মহাজোট সরকারের গত সাড়ে তিন বছরে অর্জিত সাফল্য জনগণের সামনে তুলে ধরা, দ্রুত জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর ভোলা জেলার সাংগঠনিক রিপোর্ট তুলে ধরেন সাধারণ সম্পাদক ও জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন টুলু। উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন জেলার সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা। এরপর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তৃণমূল নেতারা জেলার সার্বিক সাংগঠনিক চিত্র তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে। জেলার উন্নয়নে তৃণমূল নেতারা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরলে প্রধানমন্ত্রী তা একে একে পূরণের আশ্বাস দেন।
এ সময় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ এমপি, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সতীশ চন্দ্র রায়, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মাহবুব-উল-আলম হানিফ, এ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, আখতারুজ্জামান, আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক এমপি, মৃণাল কান্তি দাস, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, আফজাল হোসেন, ফরিদুন্নাহার লাইলী এমপি, সুজিত রায় নন্দী, এনামুল হক শামীম, পংকজ দেবনাথ, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জ্যাকব এমপি, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপি ও ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী এমপি উপস্থিত ছিলেন। সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন বরিশাল বিভাগীয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম।
প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমরা জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করি। ভোটের অধিকারে বিশ্বাস করি। সে জন্যই আমরা জনগণের হাতে তাদের সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছি। অতীতে নির্বাচন মানেই ছিল ভোট ডাকাতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, মিডিয়া ক্যু কিংবা মানুষ হত্যা-গ-গোল। কিন্তু মহাজোট সরকারের আমলে প্রায় ৫ হাজার ১৭৫টি বিভিন্ন নির্বাচন হয়েছে, বিরোধী দল কেন, কোন গণমাধ্যমও একটি নির্বাচন নিয়েও বলতে পারেনি কারচুপি হয়েছে। জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের মানুষকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। অতীতে কোন সময়ই তা হয়নি।
২০০১ সালপরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরে দেশব্যাপী অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা ও গণধর্ষণের বিবরণ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতা নিয়েই প্রথমে অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে পরবর্তীতে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে শত শত মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। ছয় বছরের ছোট শিশু কন্যাও বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের পাশবিক নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। বিএনপি-জামায়াতের কাজই ছিল সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। তারা যে ক্ষমতায় থেকে বল্লাহীন দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে তা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক তদন্তেও বেরিয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্ররা যে দুর্নীতি করে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে তা ধরা পড়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআই এসে আদালতে সাক্ষী দিয়ে গেছেন কীভাবে তারা অর্থ পাচার করেছে। শুধু পুত্রই নয়, খালেদা নিজেও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল পরিমাণ কালো টাকা জরিমানা দিয়ে সাদা করেছেন। ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে লুণ্ঠিত বিশাল অর্থের পাহাড় রক্ষা করতে নির্বাচনে কারচুপির নীলনকশা করে। ভোটার তালিকায় এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার ধরা পড়ে। যার ফলে জনগণ আন্দোলন করে। পরবর্তীতে আসে ওয়ান ইলেভেন।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশে ওই পাঁচ বছরে অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে কমিশন হয়েছিল। মাত্র দেড় বছরের তদন্ত রিপোর্টেই বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতনের চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা ভাষায় বলার মতো নয়। এদেরও বিচার হবে। অপরাধ করে এখন বড় বড় গলায় কথা বলবে- এটা দেশের জনগণ আর সহ্য করবে না। দেশের জনগণ তাদের চরিত্র জানে। ওই পাঁচ বছরে যারা দেশের মানুষকে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে ইনশাল্লাহ তাদেরও বিচার বাংলার মাটিতেই হবে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু'বছরের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমন কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ নেই যে ওই সময় নির্যাতনের শিকার হননি। সারাদেশেই ছিল শুধু আতঙ্ক। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া আজ তত্ত্বাবধায়কের কথা বলছেন, অথচ তত্ত্বাবধায়ক এসেই তাঁকে জেলে ঢুকিয়েছে, দুই ছেলেকে মুচলেকা নিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছে। এ সব কথা কী খালেদা জিয়া ভুলে গেছেন? বিএনপি-জামায়াতের পাঁচ বছর এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এই সাত বছর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অসহ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাকে দেশে ফিরতে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু ন্যায় ও সত্যের পথের লড়াইয়ে আমি কখনও ভয় পাইনি বলেই জোর করেই দেশে ফিরে এসেছি। আমি ওই সময় দেশে ফিরে না আসলে দেশে গণতন্ত্র আসত না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করত। কিন্তু দেশে ফেরার পর আমার ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের কথা জনগণ ভুলে যায়নি, তবুও আমি অন্যায়ের কাছে মাথানত করিনি। আগামীতেও কারব না।
সমুদ্র জয়ের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালেই দেশের স্থল ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আইনও প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু '৭৫-পরবর্তী কোন সরকারই এ ব্যাপারে আর কিছুই করেনি। গতবার সরকারে আসার আগে শুনলাম দেশ নাকি গ্যাসের ওপর ভাসছে। গ্যাস বিক্রির কথায় আমি রাজি হইনি। খালেদা জিয়া গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। আওয়ামী লীগ কখনও দেশ বিক্রি করে না, বরং স্বার্থ সংরক্ষণ করে। আমরা সমুদ্র জয় করে তা প্রমাণ করেছি। আগামীতে জনগণ ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিলে ভারতের সঙ্গে মামলাতেও আমরা বিজয়ী হব।
শেখ হাসিনা বলেন, যতই বাধা-বিপত্তি আসুক, বিএনপি আমলে জঙ্গীবাদ-দুর্নীতি-সন্ত্রাসী দেশ হিসেবে পরিচয় পাওয়া বাংলাদেশ বর্তমান সরকারের মাত্র তিন বছরেই উন্নয়নের মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলবই।