রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরাতন ভৃত্য পদ্যের দ্বিতীয় লাইনে আছে 'কেষ্টা বেটাই চোর!' বর্তমানকালে দেশের জ্ঞানপাপী কুৎসা রটনাকারীদের কাছে 'কেষ্টা' হচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। দেশের কোথাও কিছু একটা ঘটলেই সরকারকে দায়ী করাটা যেন আজ ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বিচার বিশ্লেষণের ধার ধারে না, প্রকৃত কারণ খোঁজার চেষ্টা করে না, অতীতের ঘটনা মনে রাখে না কিন্তু শেখ হাসিনা এবং সরকার সম্পর্কে বড় গলায় কথা বলে আসর দখলের চেষ্টা করা জ্ঞানপাপী সমালোচকদের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে তিলকে তাল বানিয়ে গল্প বলার দক্ষতাও তাদের অনেক। রূপকথার সেই গল্পের মতো ব্যাপার। রাজামশায়ের প্রাসাদে রাজরানীর গর্ভে এক কালো ছেলের জন্ম হয়েছে। রাজার বিরুদ্ধাচারীরা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে প্রচার করল, রাজরানীর গর্ভে একটি কালো কাক জন্ম নিয়েছে। আজকের যুগেও বাংলাদেশে এই ধরনের ডাহা মিথ্যে বলার দুষ্টলোকের অভাব নেই এবং তাদের বলা মিথ্যে কথা প্রচারের জন্য এখন রয়েছে গণমাধ্যম। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এতটাই যে, উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে তাকায়। গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে তাই সরকারকে 'কেষ্টা' বানানোর চেষ্টা অতীতের চেয়ে একটু বেশি মনে হয়।
গার্মেন্টসের মালিক শ্রমিকদের প্রাপ্য ঠিকমতো দিল না এবং সে জন্য আশুলিয়া কিংবা কাঁচপুরে গ-গোল হলো, অমনি বলা শুরু যে শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের দোষ। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনের অভাবে ছাত্রছাত্রী ভর্তি নিয়ে সমস্যা, অমনি তা শেখ হাসিনা এবং সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপানো। রেলে কেন চাকরি হচ্ছে না। সেটাও প্রধানমন্ত্রীর দোষ। পুলিশ কেন লাঠি উঁচু করল, সেটার জন্যও দায়ী সরকার। একবারও ভাবা হয় না যে, কতিপয় অবিবেচক পুলিশের পরিচয়ে সরকার পরিচিত নয়। গার্মেন্টস মালিকদের আচরণ তো আর শেখ হাসিনা নিয়ন্ত্রণ করেন না। তিনি সরকার প্রধান হিসেবে যা করার তা তো করছেনই। শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করে দিয়েছেন সরকারী নির্দেশে এবং শ্রমিকরা তাতে যদ্দুর জানি, খুশিই হয়েছিলেন। আসলে বুঝতে হবে, সরকারের বিপুল কর্মযজ্ঞ দু'চারজন ব্যক্তি অনিয়ম, ক্ষতিকারক এবং নিজ স্বার্থে উল্টাপাল্টা কিছু করলে তার জন্য সরকার কিংবা সরকার প্রধানকে দায়ী করা যৌক্তিক নয়। তবে হ্যাঁ, যদি দেখা যায় যে, দুষ্টের বিচার হচ্ছে না এবং তারা বহালতবিয়তে বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন সমালোচনা কিংবা দু'চার কথা বলা যেতেই পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা এসব ক্ষেত্রে তো যদ্দুর জানি, ত্বরিত ব্যবস্থা নেন অথবা ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। তাহলে আর বিরূপ সমালোচনা কেন! বিপক্ষে কথা উঠেছিল বলে তিনি সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বিলম্ব না করে সরিয়ে দিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো সিনিয়র নেতাকেও তিনি পোর্টফোলিওবিহীন করে রেখেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আবুল হোসেন এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিপক্ষে যেসব কথা হৈচৈ ফেলল তা কিন্তু তদন্তে ধোপে টেকে নাই এবং আইনের বিচারে এখনও পর্যন্ত আসেও নাই। সড়ক ও জনপথ বিভাগে টেন্ডার কেলেঙ্কারিতে জড়িত শ্রমিক লীগ নেতারা কি শেখ হাসিনার ঔদাসীন্যের কারণে ছাড় পেয়েছেন? পান নাই। র্যাবের হাতে ঠিকই ধরা পড়েছেন এবং হাতকড়া লাগিয়ে জনসমক্ষে তাদের হাজতেও পাঠানো হয়েছে। তার মানে অনিয়ম, দুর্নীতি, জোরজবরদস্তির প্রশ্রয় বর্তমান সরকারের কাছে নাই। সড়ক সংস্কারের নামে সড়ক ও জনপথ বিভাগের দুর্নীতির যে পিলে চমকানো খবর পত্রিকায় এসেছে সে ব্যাপারে যোগাযোগমন্ত্রী এক মুহূূর্ত বিলম্ব না করে অনুসন্ধান ও তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছেন। এই রকম দৃষ্টান্ত আরও দেয়া যেতে পারে। এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, সরকারের কোন বিভাগের কতিপয় দুর্বৃত্তের দোষ সরকারের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়। কারণ কয়েকজন কর্মচারী অন্যায় করে নিজের স্বার্থে, সরকারের নির্দেশে নয়। এইসব কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত হলে মানুষ খুশি হয়। আর যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয় তবে তো কথাই নাই। শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার এই কাজটি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন নীতিমাফিক করতে। জ্ঞানপাপীরা এইসব জেনেও চুপ থাকেন এবং অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। সেইজন্য লেখার শুরুতেই বলেছি, বিচার-বিশ্লেষণের ধার না ধেরে, সত্যকে আড়াল করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার মতো কথা বলা ভাল নয়। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপারে তারা নিকট অতীতের কথাও সযতনে আড়াল করেন। গত সপ্তাহের কলামে নিকট অতীতের 'হাওয়া ভবন', তার প্রধান ব্যক্তি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের দুর্নীতির কিছু চিত্র তুলে ধরেছিলাম। কয়েকজন নিয়মিত পাঠক সেই ব্যাপারে বিস্তৃত লেখার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি তো ওই লেখাতেই বলেছি যে, গত সরকার এবং হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, অপশাসন সম্পর্কে লিখতে গেলে একটিমাত্র কলামে তা সম্ভব নয় এবং সব লেখাও যাবে না। তবু বর্তমান সরকারের সমালোচনায় যারা অনাবশ্যক গলাবাজি করেন তাদের মনে করিয়ে দেয়ার জন্য দু'একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতেই পারে।
ক. জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলের ছিল বিজ্ঞাপন ব্যবসা। অন্যান্য ব্যবসাও তার ছিল। তার মধ্যে প্রধান ছিল কমিশন ব্যবসা। অর্থাৎ কাজ পাইয়ে দিয়ে কমিশনের টাকা খাওয়া। রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্যবর্ধনের নামে একচ্ছত্র বিজ্ঞাপনী ব্যবসা করে মাত্র তিন বছরে আরাফাত রহমান কোকো কামিয়েছিল এক শ' কোটি টাকা। সার্কের অতিথিদের সংবর্ধনা দেয়ার জন্য নির্মিত ঢাকার রাস্তার বিল বোর্ডগুলো বানিয়ে কামিয়েছে দেড় শ' কোটি। বিজ্ঞাপন ব্যবসার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়েছে কোকোর কোম্পানিকে অবিশ্বাস্য রকম বেশি টাকায় কাজ দিতে।
খ. প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, কুখ্যাত মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে দুবাইতে দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বড় ছেলে এবং হাওয়া ভবনের প্রধান চালক তারেক রহমান। সেই বৈঠকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনার ব্যাপারে তারেকের সঙ্গে দাউদের কথা হয়। তথ্যে আরও জানা যায় যে, ৬ কোটি ডলার দিয়ে দুবাইতে একটি বাড়ি কিনেছিলেন তারেক। আল কায়দা গোষ্ঠীর সঙ্গেও নাকি তারেকের সম্পর্ক ছিল। সেবার তারেকের সঙ্গী ছিলেন তদানীন্তন মেজর জেনারেল রেজাকুল হায়দার।
গ. ২০০৩ সালের প্রকাশিত একটি দৈনিকের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে চলেছে রাজধানীতে রোড ডিভাইডার ভাঙ্গাগড়ার খেলা এবং এই কাজের নিয়ন্ত্রক হাওয়া ভবন। একই রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন সাংসদ কাদের সিদ্দিকী এক জনসভায় বলেন, হাওয়া ভবন থেকে আট হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
ঘ. জিহাদের প্রতিকৃতি নামে এক প্রামাণ্যচিত্র থেকে জানা যায় যে, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন তারেক। জঙ্গী নেতা মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, এ ব্যাপারে হাওয়া ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তার সঙ্গে ছিল হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ এবং বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর।
ঙ. ২০০৭ সালের একটি দৈনিকের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার মামুন প্রতারণার মাধ্যমে গাজীপুর বন বিভাগের প্রায় ৭২ বিঘা জমি বরাদ্দ নিয়েছিলেন। তৎকালীন ভূমি সচিব এবং জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতি বিঘা জমির দাম ধরা হয়েছিল মাত্র সোয়া লাখ টাকার কিছু বেশি। পরিবেশ ও আইন মন্ত্রণালয়ের আপত্তি এবং মতামত উপেক্ষা করে ৭২ বিঘার বন কেটে গড়ে তোলা হয় টেক্সটাইল মিল।
এসব কারণেই বলেছি, বিগত জোট সরকারের দুঃশাসন ও দুর্নীতির খতিয়ান দিতে গেলে লেখা শেষ হবে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, দুঃশাসন ও দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তার দুই ছেলে এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। এটা কেবল দুঃখজনকই নয়, লজ্জাজনকও। এখন যেসব জ্ঞানপাপী সুশীলরা টেলিভিশন টকশো কিংবা পত্রিকার কলামে শেখ হাসিনা ও সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম, পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে মিথ্যাচার করেন তারা কি সত্যি সত্যি ভুলে গেছেন নিকট অতীতের দুরাচারের সকল কথা? কত জ্ঞানী তারা, এত তাড়াতাড়ি স্মৃতিভ্রষ্ট হন কি করে। এইসব তথাকথিত বিজ্ঞজনেরা কি প্রমাণ করতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র-কন্যা কিংবা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ভগ্নির সঙ্গে কোন প্রকার সরকারী প্রজেক্টের অনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা? এরা কেউ লোভী বা ভোগী হন নাই। বরং ত্যাগী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আদরের কন্যা শেখ রেহানা তো নিজ নামে বরাদ্দ বাড়ি সরকারকে ফিরিয়ে দিয়ে ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শেখ হাসিনার দুই সন্তান দেশ ও মানুষের জন্য হিতকর যেসব কাজ করে চলেছেন তার কিয়দংশও কি খালেদা জিয়ার সন্তনেরা করতে চেয়েছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই দেশের সচেতন মানুষেরা সততার সঙ্গেই দেবেন। তাই এসব নিয়ে বেশি না বলাই ভাল।
সবশেষে জনকণ্ঠের ২২ জুন সংখ্যার প্রথম পাতায় ছাপা একটা গুরুত্বপূর্ণ খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। খবরে বলা হয়েছে, পত্রিকার কাটিং আর ধার করা গবেষণা নিয়ে দুর্নীতির সার্টিফিকেট দেয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল অব বাংলাদেশ। তাদের দেয়া সার্টিফিকেটের কারণে বাংলাদেশের মাথায় দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মুকুট উঠেছে বেশ কয়েকবার। জনকণ্ঠের রিপোর্ট অনুযায়ী পেপার কাটিং পদ্ধতিতেই স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। আর অন্যের ধার করা গবেষণা নিয়ে দেশে ও বিদেশে হৈচৈ করাতেই তো রয়েছে চরম দুর্নীতি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এই ধরনের কর্মকা- বিশেষভাবে দায়ী বললে বোধ হয় ভুল হবে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এই কাজটি করে আসছে ১৯৯৬ সাল থেকে। প্রতি বছর তারা যে সার্টিফিকেট দেয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন দেশের গুণীজনেরা। কিন্তু এতে তাদের কিছু এসে-যায় বলে মনে হয় না। বরং তাদের সার্টিফিকেটের বলে বলবান হয়ে গলাবাজি করেন কিছু জ্ঞানপাপী। সরকার এবং শেখ হাসিনার সমালোচনা করতে গিয়ে তারা মূলত বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেই নষ্ট করেন। কবে যে তাদের বোধোদয় হবে!
লেখক : কলামিস্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব