মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার
'আলীমের নির্দেশে কয়েকজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়'
নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ০৯-১০-২০১২
বিএনপির নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল সোমবার জবানবন্দি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী নুরুল ইসলাম। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরের মে মাসের শেষ দিকে আলীম ও পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশে কয়েকজন হিন্দুকে নির্যাতনের পর খঞ্জনপুর কুঠিবাড়িতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রায় এক ঘণ্টা জবানবন্দি দেন নুরুল ইসলাম (৬৮)। শারীরিক কারণে জামিনে থাকা আলীম এ সময় ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন।
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুরুল ইসলাম জবানবন্দিতে বলেন, ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। পরে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করতেন। তিনি বলেন, একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তানি সেনারা ক্ষেতলালে যায় এবং ক্ষেতলাল থানা ও স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়ে ক্যাম্প করে। পরে আলীমের সহায়তায় জয়পুরহাট শহরে শাওনলাল বাজলার বাড়ি দখল করে শান্তি কমিটি ও পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প করা হয়। জয়পুরহাট, আক্কেলপুর, পাঁচবিবি ও ক্ষেতলালের এসব ক্যাম্প থেকে ওই সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ পরিচালিত হতো।
রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষী বলেন, একাত্তরের মে মাসের শেষ দিকে একদিন তিনি দুই বন্ধুর সঙ্গে হারুঞ্জাহাট ও উত্তর হাটশহরের হিন্দুদের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে যান। এ সময় তাঁরা পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের হারুঞ্জাহাট গ্রামে ঢুকতে দেখেন। তাঁরা জানতে পারেন, পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা উত্তর হাটশহরেও ত্রাস সৃষ্টি করেছে। এদের একটি অংশ হারুঞ্জাহাটে গিয়ে তাঁর (সাক্ষী) পরিচিত বাদল ও শচীনকে ধরে উত্তর হাটশহরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা উত্তর হাটশহর গ্রামের প্রভাষ চন্দ্র শীল, মণীভূষণ ওরফে ফণীভূষণ চক্রবর্তী, কার্তিক বর্মণ, নিমাই চন্দ্র, প্রিয়নাথ বর্মণ ও আরও তিনজনকে ধরে এবং বাদল ও শচীনকে তাঁদের সঙ্গে বন্দী করে ক্ষেতলালে নিয়ে যায়। তাঁরাও পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অনুসরণ করে ক্ষেতলালে যান। ক্ষেতলালে শান্তি কমিটির কার্যালয়ে নিয়ে ওই বন্দীদের নির্যাতন করা হয়। তাঁরা চিৎকার শুনতে পান। পরে বন্দীদের শাওনলাল বাজলার বাড়ির ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আবদুল আলীম ও পাকিস্তানি সেনারা উপস্থিত ছিল। পরে আলীম ও পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশে ওই বন্দীদের খঞ্জনপুর কুঠিবাড়িতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
জবানবন্দি শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী খলিলুর রহমান। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় এই মামলার কার্যক্রম আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি: একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খান জবানবন্দি দেন। তিনি এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের দ্বাদশ ও শেষ সাক্ষী। তাঁকে জেরার জন্য ১৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
সাক্ষী সাইদুরের জেরা
জবানবন্দিতে সাক্ষী সাইদুর রহমান
আলীমের নির্দেশে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ০৫-০৯-২০১২
বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল মঙ্গলবার জবানবন্দি শেষ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী সাইদুর রহমান। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আলীমের নেতৃত্বে ও সহায়তায় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সাইদুর রহমানের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত। শারীরিক কারণে জামিনে থাকা আলীম এ সময় ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাইদুর গত সোমবার জবানবন্দি শুরু করেন।
জবানবন্দিতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, সত্তরের নির্বাচনে কনভেনশন মুসলিম লীগের পরাজিত প্রার্থী আলীম জয়পুরহাট শহরে নিজের বাড়িতে রাজাকারদের নিয়োগ দেন। এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনারা জয়পুরহাটের বিভিন্ন স্থানে আসে। জয়পুরহাট শহরে শাওনলাল বাজলার দোতলা বাড়ির নিচতলায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ও দোতলায় কমান্ডার মেজর আফজাল বেগের থাকার জায়গা করা হয়। শাওনলালের ধানের চাতালে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও গদিঘরে শান্তি কমিটির কার্যালয় স্থাপন করেন আলীম। এরপর তিনি আক্কেলপুর গিয়ে মোহনলাল আগরওয়ালের গদিঘরে শান্তি কমিটির কার্যালয়, দুর্গা দত্ত আগরওয়ালের দোকানঘরে রাজাকার ক্যাম্প ও অস্থায়ী থানা স্থাপন করেন। পরে তিনি শান্তি কমিটির সদস্যদের নিয়ে আক্কেলপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় পাকিস্তানি সেনাদের স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানেও মেজর আফজালের থাকার জন্য বিশেষ কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়।
সাইদুর রহমান বলেন, একাত্তরের ১৯ এপ্রিল তিনিসহ আক্কেলপুর সংগ্রাম কমিটির কয়েকজন সদস্য পাঁচবিবি সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁরা ওই রাতে পাঁচবিবিতে ছিলেন। পরদিন দুপুরের দিকে আলীম ও পাঁচবিবি শান্তি কমিটির নেতা জয়বারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল পাঁচবিবি আক্রমণ করে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অপরাধ করে। বিকেলে তারা মেহেরুদ্দিন চৌধুরীর বাড়ি আক্রমণ করে। এ অবস্থায় তিনি আক্কেলপুরের দিকে রওনা হন। পথে জয়পুরহাটে গিয়ে শোনেন, পাঁচবিবিতে আক্রমণের ঘটনায় সেখানকার সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে আলীমের বাড়ি আক্রমণ করেছে। আলীম বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছেন। ২১ এপ্রিল সান্তাহার থেকে ট্রেনে করে আক্কেলপুর গিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আকাশে মর্টার শেল নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলি করে। এতে খাদাইল গ্রামের আবদুল মজিদ গুলিবিদ্ধ হন।
সাক্ষী আরও বলেন, পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে ৭ মে আক্কেলপুর থেকে ১৩ জনের একটি দল ভারতে যাচ্ছিল। রাত হয়ে গেলে তারা ভাদস ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ আলী ডাক্তারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তিনি ছিলেন আলীমের দোসর। দলটিকে বৈঠকখানায় ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। সৈয়দ আলী রাতেই জয়পুরহাটে আলীমের কাছে এ খবর পাঠান। পরদিন সকালে আলীম পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে সেখানে যান এবং আটক ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন। বাকি ১০ জনকে আক্কেলপুর রেলস্টেশনের বিশ্রামাগারে আটক রাখা হয়। তাঁদের একজন আবদুস সালাম ছিলেন তাঁর (সাক্ষী) বাল্যবন্ধু। এ খবর পেয়ে তিনি সেখানে গিয়ে গোপনে বিশ্রামাগারের জানালা দিয়ে সালামের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানেন। পরে তিনি শোনেন, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া তিনজনকে আলীমের নির্দেশে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ঘাটে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিশ্রামাগারে আটক রাখা ১০ জনকেও আলীম পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের পাঁচবিবির কোকতারা গ্রামের একটি পুকুর পাড়ে নিয়ে গুলি করলে নয়জন মারা যান, একজন বেঁচে যান।
সাইদুর রহমান বলেন, একাত্তরের ১৪ জুন খোকন পাইকারের নেতৃত্বে বগুড়ার ১৪ জন যুবক বগুড়া যাওয়ার পথে আক্কেলপুরে শান্তি কমিটির সদস্যরা তাঁদের ধরে শান্তি কমিটির কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এ খবর জানানো হলে আলীম গিয়ে আটক ব্যক্তিদের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন। তিনি তাঁদের অমানবিক নির্যাতন করে হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সেনারা ওই ১৪ জনকে আক্কেলপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় নিয়ে গাছের সঙ্গে ঝোলায়। তাঁদের খেজুর কাঁটা দিয়ে আঘাত করা হয়।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীর কাছে জানতে চান, এসব ঘটনা কী তিনি নিজের চোখে দেখেছেন? জবাবে সাক্ষী বলেন, এসব ঘটনা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন।
সাইদুর রহমান বলেন, আহত ওই ১৪ জনকে আমট্র গ্রামে নিয়ে তাঁদের ও স্থানীয় কয়েকজনকে দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয়। এরপর ওই ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। জুন মাসের শেষ দিকে সংগ্রাম পরিষদের কাজে তিনি (সাক্ষী) জয়পুরহাট যান। তিনি রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারের পশ্চিম পাশের ফাঁকা জায়গায় ২৪ জন ব্যক্তি, কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও মেজর আফজালের সঙ্গে আলীমকে ছবি তুলতে দেখেন। পরে জেনেছেন, জয়পুরহাটের আলোখেলা স্টুডিওর মালিক মোতাসসিন বিল্লাহ ওই ছবি তোলেন। আক্কেলপুরের শহীদ ফজলুল করিমের বড় ভাই আবদুল হাই ওই ছবি সংরক্ষণ করেন।
সাক্ষী বলেন, ৭ অক্টোবর জয়পুরহাটের পশ্চিমে পাহাড়পুরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। পরদিন তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরার পর আলীমের নির্দেশে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘোরানো হয় এবং প্রচার করা হয়, কেউ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলে তাঁদের পরিণতিও এমন হবে। পরে তিনি (সাক্ষী) জানতে পারেন, বন্ধনপুর বুড়িবাড়ি ঘাটে ওই তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রানা দাশগুপ্ত এ সময় জানতে চান, সাক্ষী যেসব ঘটনার বিবরণ দিলেন, তা কী নিজে দেখেছেন? জবাবে সাক্ষী বলেন, কয়েকটি ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন, কয়েকটি শোনা।
জবানবন্দি শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী মুন্সী আহসান কবীর সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন। পরে জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় এ মামলার কার্যক্রম ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
আলীমের নির্দেশে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ..
http://www.prothom-alo.com/detail/news/286754
আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৮টি অভিযোগ উপস্থাপন।
\
__._,_.___