http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-10/news/312066
ছাত্রলীগের রোষে প্রাণ গেল পথচারী বিশ্বজিতের
বিশ্বজিেক চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে বের হয়ে আসছে ছাত্রলীগ কর্মী
রাস্তায় নামার পর রড ও চাপাতি দিয়ে তাঁকে আঘাত
জীবন বাঁচাতে মরণপণ দৌড়েও রক্ষা পাননি তিনি
পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় গতকাল অবরোধকারী সন্দেহে বিশ্বজিত্ দাসকে চাপাতি দিয়ে কোপান ছাত্রলীগের কর্মীরা
ছবি: হাসান রাজা
বিশ্বজিৎ দাস সম্ভবত ভুল সময়ে ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এইটুকু ভুলের কারণেই জীবন গেল তাঁর। ওই খানে তখন অবরোধের পক্ষের মিছিলে ধাওয়া দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। সে সময় অবরোধের পক্ষের কেউ এমন সন্দেহে তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারা হলো। যাদের হাতে চাপাতি ছিল না, তারা রড দিয়ে পিটিয়েছে, লাঠির বাড়িতে রক্তাক্ত করেছে, লাথি-ঘুষি মেরেছে।
জীবন বাঁচাতে মরণপণ দৌড়েও রক্ষা পাননি বিশ্বজিৎ দাস। তাঁকে পাশের হাসপাতালেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একজন রিকশাওয়ালা হাসপাতালে পৌঁছে দিলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি বাঁচেননি। বিশ্বজিৎ দাসের বয়স হয়েছিল মাত্র ২৪ বছর। অসংখ্য মানুষের সামনে গতকাল রোববার এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটল।
ঘটনার সূত্রপাত পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় সকাল নয়টার ঠিক আগে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির সমর্থনে গতকাল সকাল নয়টার আগে ঢাকা জজকোর্ট এলাকা থেকে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীরা একটি মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে যান। এ সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি কাজী নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আইনজীবীদের ধাওয়া করেন। এর কয়েক মিনিট পর ভিক্টোরিয়া পার্কসংলগ্ন একটি তেলের পাম্পের কাছে তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পাম্পের দিকে ধাওয়া দিয়ে আসতে থাকলে আতঙ্কিত পথচারী বিশ্বজিৎ দৌড়ে সেখানকার একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের দুই তলায় আশ্রয় নেন। ঘটনা শুরু এখান থেকেই। তখন সময় সকাল নয়টা এক মিনিট।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিড়ের মধ্য থেকে হঠাৎ শোনা গেল 'ওপরে' 'ওপরে'। এরপরই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে বিশ্বজিৎকে জাপটে ধরে এলোপাতাড়ি রড দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁকে ধারালো চাপাতি দিয়ে ডান হাতের গোড়ায় গুরুতর জখম করা হয়। আহত ও পাকড়াও অবস্থা থেকে ছুটে দৌড় দেন বিশ্বজিৎ। তাতেও রক্ষা পাননি তিনি। নিচে নামতেই আবার চারদিক থেকে রড-লাঠির বাড়ি পড়তে থাকে।
এ সময় পথচারীদের কেউ কেউ বিশ্বজিৎকে পাশের ন্যাশনাল হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাতেও বাধা দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। এরপর প্রাণ বাঁচাতে আবার দৌড় দেন তিনি। দৌড়ে শাঁখারীবাজারের একটি গলিতে গিয়েই ঢলে পড়ে যান। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় এক রিকশাচালক রিকশায় করে বিশ্বজিৎকে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কিছুক্ষণ পর মারা যান বিশ্বজিৎ। পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ওই হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। চিকিৎসকদের কাগজপত্র অনুযায়ী, বিশ্বজিতের মৃত্যুর সময় সকাল নয়টা ৫৫ মিনিট।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্বজিতের পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সময়মতো রক্তক্ষরণ কমিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেননি। পুলিশ নিয়ে না আসায় চিকিৎসা শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার আবু তানভীর সিদ্দিক বলেন, আঘাত ও প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে।
হামলাকারী ছাত্রলীগের কর্মীদের ছবি তোলা আছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তা দেখিয়েছেও। প্রত্যক্ষদর্শীরাও অনেককে চিনতে পেরেছেন। তাঁরা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রলীগের কর্মী মো. শাকিল, তাহসীন কাদের, শাওন, নূরে আলম লিমন, মাসুদ আলম নাহিদ ও ইমদাদুল।
জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ছাত্রলীগের কর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নন।
রাজধানীর সূত্রাপুর থানার ভারপ্রপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, লাশ ময়নাতদন্ত শেষে তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে বিশ্বজিৎ ছোট। বড় ভাই উত্তম কুমার দাসের পরিবারের সঙ্গেই পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনের এক বাসায় থাকতেন বিশ্বজিৎ। পুরান ঢাকার ১২৩ নম্বর শাঁখারীবাজারে নিউ আমন্ত্রণ টেইলার্স নামে তাঁর একটি কাপড় সেলাইয়ের দোকান আছে। তাঁর গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মাসুরাবাজার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম অনন্ত দাস।
হাসপাতালের মর্গে বড় ভাই উত্তম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন পায়ে হেঁটেই দোকানে যান বিশ্বজিৎ। গতকাল সকাল নয়টার দিকে দোকানের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। ১০ মিনিট পর দুর্ঘটনার সংবাদ পান তিনি। তিনি বলেন, খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন ছাত্রদলের কর্মী ভেবে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। অথচ শুধু বিশ্বজিৎ নন, তাঁর পরিবারের কেউউ কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। যদিও বিশ্বজিতের মরদেহ নিয়ে রাজনীতিও খানিকটা হয়েছে। গতকাল অবরোধ শেষে বিকেলে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, বিশ্বজিৎ একজন বিএনপির কর্মী।
__._,_.___