শিরোনামে বললাম অচেতনতা, কারণ অসচেতনতা বলতে এখন আর রুচি হয় না। অপরিচিতদের না পারি, কাছের-দূরের আত্মীয়-বন্ধু-পরিচিতদের সচেতন করার চেষ্টা করতে করতে তো ইতিমধ্যেই হাপিয়ে উঠেছি। কিন্তু এরা অসচেতন তো হয়ই না, বরং অচেতন মানুষের মতই আচরণ করতে পছন্দ করে। এ পর্যন্ত চার ধরণের মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
প্রথম শ্রেণীর মানুষ যে কোন বিষয়েই নিজস্ব বিচার বুদ্ধির সাথে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করে তার করনীয় সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে পৌছায়। এরা আপনার কথা মন দিয়ে শুনবে, অযথা কথার গতিরোধ করবে না, নিজ মতামত আপনার সাথে শেয়ার করবে। সর্বোপরি মানবতা, মানবাধিকার, নীতিবোধ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় এনে তার কার্যকলাপ স্থির করবে। এরাই সুশীল সমাজের একটা অংশ যারা দেশের ও তার মানুষগুলোকে নিয়েই বেশি সময় কাটায় নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধিকে কম গুরুত্ব দিয়ে। এদের সংখ্যা সবচাইতে অল্প।
দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষ প্রথম শ্রেনী থেকে শুধু একটা ব্যাপারেই পিছিয়ে আছে, তা হচ্ছে তাদের সংস্কারবোধ ও পিছুটানকে এড়িয়ে যাবার অক্ষমতা। এরা আপনার কথা শুনবে ও বুঝবে কিন্তু 'যদি কিছু হয়' ভেবে নিজস্ব ভুল দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করার সাহস করবে না। এদের সংখ্যা মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে।
তৃতীয় শ্রেনীর মানুষ আপনার কথা শুনবে ঠিকই বুঝবে না, কারণ তাদের অশিক্ষা। এদের একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারলেই হয় কিন্তু সেটা একটু সময়সাপেক্ষই বটে।
আর চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ হচ্ছে নিকৃষ্টতম। এরা আপনার কথা শুনবেই না, শুনলেও পাত্তা দেবে না, অকারণে ফোঁড়ন কেটে আপনাকে হেয় করার চেষ্টা করবে, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে যত রকম কুকর্ম আছে তাই করে বেড়াবে। এদের না আছে কোন নীতিবোধ, না আছে বুদ্ধিবৃত্তি, না আছে ভাল কিছু গ্রহণ করার প্রবণতা। আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে এদের সংখ্যাই সবচাইতে বেশি।
ভূমিকাটা একটু বড় করে ফেললাম বলে দুঃখিত। এই কথাগুলো আগে থেকেই মাথায় ছিল, আজ আবার নতুন করে ভাবতে বসলাম টিএসসি থেকে বাসায় এসে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত 'বাচ্চু রাজাকার' ওরফে আবুল কালাম আযাদ এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় আজ ঘোষিত হয়েছে। এ উপলক্ষে আমাদের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের বাইরে আজ যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র 'আলবদর' দেখানো হচ্ছিল সন্ধ্যা সাতটার পর থেকে। কয়েকজন পটকা ফুটিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করছিল। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে টিএসসিতে প্রতিদিন এত অগণিত মানুষ আসে, যার সিকিভাগ মানুষকেও বিনামূল্যে প্রদর্শিত ওই প্রামাণ্য চিত্রটি দেখার মত ধৈর্যের পরিচয় দিতে আজ দেখলাম না। বেশিরভাগই সামনে দিয়ে ঘুরে চলে যাচ্ছিল, নতুবা ফোনে কথা বলতে বলতে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে নিজেদের 'জরুরী' কাজে চলে যাচ্ছিল। টিএসসিতে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে চা খাওয়া মানুষের অভাব হয় না কিন্তু আজ স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত, লুন্ঠিত ও নিহত অসংখ্য মানুষের দুঃখের আহাজারি দেখার মানুষের বড়ই অভাব।
স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়া মানুষের সংখ্যা যেখানে শতভাগ হওয়া উচিৎ সেখানে এখনো জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির, তাদের প্রতি সমব্যাথী কিছু রাজনৈতিক দল ও এদের সমর্থিত অসংখ্য মানুষ আজ যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্যের বিরুদ্ধাচরন করার সাহস পায় কোথা থেকে? এটি একটি জাতীয় ইস্যু, দলীয় বা রাজনৈতিক নয়। যারা ভাবছেন আমি এখানে আম্লীগের বিজয়গাঁথা শোনাতে এলাম কিনা, তাদের বলছি আম্লীগ ও বিম্পি কোন দলকেই সমর্থন করতে আমার রুচি হয় না। বিগত নির্বাচনে না ভোট দিয়েছি, এবারো দেব। তাই যারা এখনো বিম্পির সমর্থন করার কারণে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিচার দাবীর ব্যাপারে দোনমনা করছেন তাদের হাতে এখনো সময় আছে মত পরিবর্তন করার। আরে ভাই একটিবার ভাবুন না আপনার বাবা বা ভাইকে যদি একাত্তরে শরীরের বিভিন্ন মাংস খুবলে নিয়ে জবাই করা হত, আপনার মা বা বোন বা স্ত্রীকে ধর্ষনের পর নিম্নাংগে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বা মরিচ গুড়ো ঢেলে দিয়ে বা দু পা দুদিকে টেনে ছিড়ে ফেলে হত্যা করা হত, তখন কি আপনি আজকের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামশা দেখতে পারতেন। একটু ইতিহাস ঘেটে দেখুন আক্ষরিক অর্থে এ কাজগুলোই করেছিল পাকিস্তান আর্মির দোসর হয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিকমিটির সদস্য আমাদের বাঙ্গালী, বাংলাদেশি ও মুসলমান 'ভাইরা'। এখন আপনিই ভেবে দেখুন কি করবেন? যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য নিশ্চিত করার জন্যে সহায়তা করে নিজেকে মানুষ ভাবার চেষ্টা করবেন? নাকি 'দূষিত রাজনীতি', 'পাকিস্তানী ও রাজাকাররা আমাদের ভাই', 'মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় দালাল' এসবের ধোঁয়া তুলে অচেতন হয়ে জীবন পার করে দেবেন?
চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ হয়ে থাকার সময় এখন আর নয়। একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে যখন দেশে দেশে মানবতা ও মানবাধিকারের সপক্ষে অগণিত প্রথম শ্রেণীর মানুষের আন্দোলনের ডাকে অমানুষের দলের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, তখন আমরা কেন কাঁপাতে পারব না?
শক্তি আজ আপনার হাতে
বাস্তবতা করাঘাতে
অমানুষের দলে নয় ভেসে যাবার
জয় হোক আজ মানবতার।
-ক্ষ্যাপা মানুষ
__._,_.___