বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক কবিতার পঙ্ক্তিমালা লিখেছেন। কবি মহাদেব সাহা তার কবিতায় লিখেছেন এভাবে, তাকে বার্লিনের এক ভায়োলিন বাদক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার পরিচয় কী? কবি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা দেখিয়ে বলেছিলেন, এই আমার পরিচয়, এর চেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না। ভারতের জাতির পিতা মাহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে তার কিয়দংশও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হয়নি। এর প্রধান কারণ ভারতের কংগ্রেস তার জন্মের পর অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ জন্মের পর ছয় ভাগের এক ভাগ সময় ক্ষমতার। তা ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেভাবে বিকশিত হয়েছে সেভাবে বাংলাদেশে হতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ২১ বছর লেগেছে সত্য প্রকাশের পরিবেশ তৈরি করতে। শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে কত রকম বাধার সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমনকি জিয়াউর রহমান সাহেবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্টি করা হয়েছিল 'শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটি'। যে কোনো পাঠক ১৯৮১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহের দৈনিক পত্রিকার পাতা ওল্টালেই এ কথার সত্যতা মিলবে। এমনকি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি নিয়ে কত রকম মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে মিলাদ পর্যন্ত পড়তে দেওয়া হয়নি। যারা দেননি তারাই এখন কত রকম বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের কথা বলে যাচ্ছেন। তাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ দেশে গবেষণার সবিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
কবি আল মাহমুদ যেমন করে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন সেটা খুবই যথার্থ। তার নিশিডাক কবিতার অংশবিশেষ এখানে উৎকলন করা যেতে পারে। "সে যখন বলল, 'ভাইসব'। অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল।" অথচ এই মাটিতে অর্বাচীনরা শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ডাক নিয়ে বিতর্ক করেই যাচ্ছে। কেননা টিক্কা খানের সঙ্গে বসে থেকে ( ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার সালেকও শুনতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। শুনতে পায়নি এ দেশের কিছু জ্ঞানপাপী। কবি আল মাহমুদের কবিতার চরণগুলো এদের হৃদয়ে রেখাপাত করে না। জানি না টিক্কা খানের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালেকের স্বীকারোক্তিকে এরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।
(ডযবহ ঃযব ভরৎংঃ ংযড়ঃ যধফ নববহ ভরৎবফ, ঃযব াড়রপব ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ পধসব ভধরহঃষু ঃযৎড়ঁময ড়হ ধ ধিাবষবহমঃয পষড়ংব ঃড় ঃযধঃ ড়ভ ঃযব ড়ভভরপরধষ চধশরংঃধহ জধফরড়. ওহ যিধঃ সঁংঃ যধাব নববহ, ধহফ ংড়ঁহফবফ ষরশব, ধ ঢ়ৎব-ৎবপড়ৎফবফ সবংংধমব, ঃযব ঝযবরশয চৎড়পষধরসবফ ঊধংঃ চধশরংঃধহ ঃড় নব ঃযব চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয).
অনেক কবি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখলেও আল মাহমুদ মাত্র একটি কবিতা লিখেছেন। বোধকরি একটা কবিতাই হাজার কবিতার সমান। কবি শেখ মুজিবকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন।
"সে যখন ডাকলো 'ভাইয়েরা আমার।'
ভেঙ্গে যাওয়া পাখির ঝাঁক ভীড় করে নেমে এল পৃথিবীর ডাঙ্গায়
কবিরা কলম ও বন্দুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে লাগলো খোলা ময়দানে।"
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে অনেকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ স্পিস বা মার্টিন লুথার কিং ( জুনিয়র)-এর 'আই হ্যাভ এ ড্রিম'-এর সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। 'ধূমকেতু'তে কবি নজরুল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'এদেশের নাড়ীতে, অস্থিমজ্জায় যে পচন ধরেছে, তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না।'
আবারও বাঙালি মনীষী এস ওয়াজেদ আলীর লেখা থেকে দুটি লাইন এখানে সংকলিত করা সমীচীন হবে।
"বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হ'লে, এ চিন্তাকে রূপায়িত করতে হলে, এ সাধনাকে সার্থক করতে হলে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন। যথা_ (১) হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য; (২) বাংলার রাষ্ট্রীয় জীবনের স্বাতন্ত্র্য; আর (৩) শুভবুদ্ধি ও জ্ঞানের উদ্বোধন এবং সম্প্রসারণ।" বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেখা গেল এস ওয়াজেদ আলীর উলি্লখিত তিনটি জিনিস বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শুধু এই জাতিকে দিয়েই গেছেন। যেমনভাবে দিয়ে গেছেন ভারতের মাহাত্মা গান্ধী। জীবনে একটা মুহূর্তের জন্য কারও সঙ্গেই আপস করেননি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন, 'শেখ মুজিব একটি মহাকাব্যের নায়ক ছিলেন। এই মহাকাব্য জাতীয়তাবাদের। আরও নির্দিষ্ট অর্থে এ হচ্ছে পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান ও পরিণতিতে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। এমনকি পঞ্চাশ দশকেই বাঙালির ভবিষ্যৎ পথরেখার কথা বলেছেন অবলীলাক্রমে। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট গণপরিষদে দেওয়া তার ভাষণেও তা লক্ষ্য করি। তিনি বলেছিলেন , "ঝরৎ ুড়ঁ রিষষ ংবব ঃযধঃ ঃযবু ধিহঃ ঃড় ঢ়ষধপব ঃযব ড়িৎফ 'ঊধংঃ চধশরংঃধহ' 'রহংঃবধফ ড়ভ ঊধংঃ ইবহমধষ'... ঞযব ড়িৎফ 'ইবহমধষ' যধং ধ যরংঃড়ৎু, যধং ধ ঃৎধফরঃরড়হ ড়ভ রঃং ড়হি."
স্বাধীনতার এত বছর পরও বিদ্যুতের কারণে আমাদের সব উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হয় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিদ্যুৎ নিয়ে ভেবেছেন ষাটের দশকে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে তার নির্বাচনী ইশতেহারে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন এভাবে_ 'সর্বাধিক পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের প্রত্যেকটি উৎসের সদ্ব্যবহার করা হবে। পূর্ব পাকিস্তানকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নূ্যনপক্ষে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।... রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্প ও জামালগঞ্জ কয়লা খনি প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হবে।' বঙ্গবন্ধু চার দশকের বেশি সময় আগে জাতির জন্য করণীয় ঠিক করেছিলেন, আজকের দিনে তা অনেকে ভাবতে পারেন। এই জন্য তো তিনি জাতির পিতা। ১৯৭১ সালে 'বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা' শীর্ষক এক নিবন্ধে পঞ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিরঞ্জন মজুমদার লিখেছিলেন, 'দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান। কেউ ইতিহাসের একটি পঙ্ক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউবা একটি অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব এই সমগ্র ইতিহাস।' বাংলাদেশে বহু মত থাকবে, বহু নেতা থাকবে_ এটাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক থাকবে_ এটা কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আশা করে না। একমাত্র অর্বাচীনরাই শেখ মুজিবকে অস্বীকার করতে পারে।
সুভাষ সিংহ রায় : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
suvassingho@gmail.com
বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু: একে আজাদ চৌধুরীস্টাফ করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের স্রষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (ইউজিসি) অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু সমগ্র ইতিহাসের স্রষ্টা: http://www.samakal.com.bd/details.php?news=20&action=main&view=archiev&y=2011&m=08&d=23&option=single&news_id=185067&pub_no=791 |
__._,_.___