জামায়াতী তাণ্ডবের খণ্ড চিত্র
জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেইল্লা রাজাকারের যুদ্ধাপরাধের বিচারে ফাঁসির রায় দেয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে চালানো হয় ভয়াবহ সহিংসতা। জামায়াত-শিবির এবং কোথাও কোথাও জামায়াত-শিবির ও বিএনপি মিলিতভাবে আক্রমণ চালায় সরকারী স্থাপনা এবং সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধদের ওপর। তারা হত্যা করে বেশ কয়েক সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থককে। এ ছাড়া গানপাউডার ও পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয় বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পুড়িয়ে দেয় ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহন। এ প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও আলেম-ওলামাদের নিয়ে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক ইতোমধ্যে বেশ কিছু স্থানে এ সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের কয়েক স্থানে পাঠানো খবরে দেখা যাচ্ছে সর্বত্র এখনও আতঙ্ক। তাছাড়া কোথাও এখনও পৌঁছেনি সরকারী সহযোগিতা। নিচে দেশের বেশ কয়েকস্থান থেকে পাঠানো সংবাদ ছাপা হলো-
মৃত্যুপুরী বাঁশখালী
বাংলানিউজ ॥ বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজনপাড়ার নিতান্ত সহজ, সরল গ্রাম্য গৃহবধূ নিপু সুশীল। বয়সের কোটা এখনও ত্রিশ পেরোয়নি। সৌদিআরবে চুল কাটার কাজ করা স্বামীর পাঠানো টাকায় তিন সন্তান নিয়ে তার ভালই দিন কেটে যাচ্ছিল।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবিরের বর্বরতায় নিপু সুশীল এখন পথের ভিখিরি। সহিংস তা-বের আগুনে মাথা গোঁজার ঠাঁই, সহায়-সম্বলের সঙ্গে পুড়ে গেছে একদিন আগে নিপুর স্বামীর পাঠানো ৫০ হাজার টাকাও। পুড়ে গেছে অসময়ের সম্বল স্বর্ণের অলঙ্কার, সন্তানদের পড়ার বইপত্র। সেইসঙ্গে পুড়েছে তার সোনালি স্বপ্নও।
জামায়াতের বর্বরতার নয় দিন পার হয়ে গেলেও এখনও ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিপু সুশীলের মতো পাখি বালা সুশীল, পলাশী শীলরা। মানুষরূপী জানোয়ারের নৃশংসতার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে পাখি বালার মৃত্যুর মুখে থাকা অবুঝ গাভীটিও, যার আরও দুটি গাভী চরম যন্ত্রণা সয়ে ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে।
শুক্রবার দিনভর বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এসব এলাকার পাশাপাশি স্থানীয় আদালত, উপজেলা কমপ্লেক্স, মন্দির-মসজিদ, সবখানেই পাওয়া গেছে জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসের চিহ্ন। বাঁশখালী যেন পরিণত হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন জনপদে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর বাঁশখালী জুড়ে তা-ব সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির। বাঁশখালীকে দু'ভাগে ভাগ করে দক্ষিণ থেকে আসা জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা উপজেলা কমপ্লেক্স, আদালত এবং স্থানীয় মহাজনপাড়ায় আগুন দেয়। আর বাঁশখালীর উত্তরে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে, টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে।
গুজবে বিভ্রান্তি, অতপর তা-ব ॥ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবির মোবাইল ফোনে, উঠোন বৈঠক করে এবং বিভিন্ন কৌশলে বেশকিছু গুজব ছড়িয়ে দেয়। এতে বাঁশখালীর অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধ্যুষিত বিএনপি সমর্থিত এলাকাগুলোতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
উপজেলার জলদি এলাকার দোকানদার সোলায়মান জানান, উপজেলার দক্ষিণে নাপোড়া, শেখেরখীল, বাংলাবাজার, টাইমবাজার, চাম্বল, গণ্ডামারাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, সাঈদীর রায় ঘোষণার পর জনতা জেগে উঠেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতের বর্ডার পার হয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে ধরতে হবে। এজন্য সবাইকে জলদি উপজেলা সদরে আসার আহ্বান জানানো হয়। অন্যদিকে উপজেলার উত্তরে পুকুরিয়া, কালীপুর, বৈলছড়ি, মিয়াবাজার, চেচুরিয়াসহ আরও কয়েকটি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, সাঈদীকে জলদি হাইস্কুল মাঠে ফাঁসি দেয়া হবে। এ ফাঁসি ঠেকানোর জন্য জনগণকে হাইস্কুল মাঠে আসার আহ্বান জানানো হয়।
এসব গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে বাঁশখালীর দুটি কওমী-খারেজি মাদ্রাসা, একটি জামায়াত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা এবং বিএনপির আধিপত্য আছে এমন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে উপজেলা সদরে তা-ব শুরু" করে। তা-বে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের ছেলে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল বলেন, 'মূলত ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ যারা করেছে তারা সবাই শিশু-কিশোর। সবার বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর অথবা তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি হতে পারে। এদের মধ্যে এমন ভাব ছিল- যেন ভাংচুর করে, আগুন দিয়ে এরা উৎসব করছে।'
বর্বরতার সাক্ষী সরকারী অফিস-আদালত ॥ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর দুপুর আড়াইটার মধ্যে বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে, টায়ার জ্বালিয়ে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা অবরোধ সৃষ্টি করে। মূলত ৩টা থেকে শুরু হয় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ সহিংস তা-ব।
জলদি পৌরসদরের বাসিন্দা ও দোকানদার লিয়াকত জানান, হরতালের কারণে জলদিসহ পুরো এলাকায় সকাল থেকেই অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। রায় ঘোষণার পর দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে লোকজন একেবারে কমে গিয়ে পুরো এলাকা ভুতুড়ে জনপদে পরিণত হয়। এর মধ্যে ৩টার দিকে জামায়াত-শিবিরের লোকজন ছোট বাচ্চাদের এনে বাজারে হিন্দুদের বিভিন্ন দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেক দোকান বন্ধ থাকলেও সেগুলো ভেঙ্গে লুটপাট করা হয়। জিনিসপত্র তছনছ করে দোকানগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম জানান, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কয়েক হাজার লোক যাদের অধিকাংশ শিশু-কিশোর, তারা মিছিল করে এসে প্রথমে উপজেলা শিক্ষা অফিস, কৃষি, এলজিইডি, উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় এবং উপজেলার সরকারী ত্রাণের গুদামে আগুন দেয়। ভাংচুর করা হয় ইউএনও'র অফিস। আগুনে গুদামে রাখা প্রায় দু'হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন বইপত্র, পুরনো সিলেবাসের প্রায় এক লাখ বইপত্র, ত্রাণের কম্বল, টিন, কৃষি উপকরণ, জেনারেটর সম্পূর্ণভাবে পুড়ে গেছে। তাদের দেয়া আগুন ছড়িয়ে পড়ে উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা মসজিদেও।
শুক্রবার উপজেলা কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, গুদামের ভেতর পুড়ে যাওয়া বইপত্র-মালামাল থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে।
বাঁশখালী সিনিয়র সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জারিকারক ইমাম হোসেন জানান, হরতালের কারণে সিনিয়র সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আমিরুল ইসলাম এবং সিনিয়র সহকারী জজ রোকেয়া আক্তার এজলাসে বসেননি। দু'বিচারকই আদালতে ছিলেন। বিকেল ৫টার দিকে হাজার হাজার মানুষ যাদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর, তারা মিছিল করে আদালত এলাকার ভেতরে ঢুকতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যেই তারা দুটি আদালতের এজলাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। কোর্ট হাজত ভেঙ্গে দু'জন আসামিকে বের করে দেয়।
বাঁশখালী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম তোফাইল বিন্ হোছাইন বলেন, 'সেদিনের ঘটনা কতটা নৃশংস তা বলে বোঝানো যাবে না। জামায়াত-শিবির কতটা বর্বর হতে পারে তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। মনে হচ্ছিল আরেকটা একাত্তর ফিরে এসেছে। আদালতের সব নথিপত্র তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষতি আগামী এক শ' বছরেও কাটিয়ে উঠা যাবে না।'
উপজেলা কমপ্লেক্স এবং আদালত ভবনে তা-বের পর জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা টিএ্যান্ডটি অফিস ভাংচুর করে। ওই অফিসের সামনে থাকা বেশ কয়েকটি দোকানও আগুনে পুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় শ্রী শ্রী অদ্বৈতানন্দ ঋষিমঠ ও মিশনসহ চারটি হিন্দু মন্দির।
শুক্রবার দুপুর দু'টার দিকে বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজনপাড়ায় ঢুকতেই দেখা গেল, শুয়ে আছে একটি সবল গাভী, চোখ জোড়া আকাশের দিকে। মনে হলো চোখ খুলে বিশ্রাম নিচ্ছে গাভীটি। গাভীটির মাথার ওপর কাকের অবিরম কা কা শব্দ আর পাখি বালার কান্নার পর বোঝা গেল, না, গাভীটি আর জীবিত নেই। জামায়াতের নৃশংসতার শিকার হয়ে আগুনে পুড়ে টানা আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শুক্রবার ভোরে মারা গেছে।
পাখি বালা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, তাঁর আরও একটি গাভী আগুনে পুড়ে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেছে। আরও একটি পোড়া গাভী গত আটদিন ধরে কিছু খেতে পারছে না। পাখি বালার ছোট ছেলের শ্বশুর দয়াল হরিকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে খুন করেছিল জামায়াতের দুর্বৃত্তরা। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে চার ভাই পুলিন সুশীল, সুনীল সুশীল, দুলাল সুশীল, আশীষ সুশীল এবং অপর দু'ভাই স্বপন শীল ও সম্ভু শীল এবং পাখি বালা শীলের বাড়ি।
09 Mar 2013 05:19:37 PM Saturday BdST |
| | |
|
জামায়াতের বর্বরতায় বাঁশখালী যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ! রমেন দাশগুপ্ত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম |
|
৪ মাসে নিহত ৭, আহত ৫৬৯ হামলা ঠেকাতে গিয়ে মার খাচ্ছে পুলিশ
বিশেষ প্রতিনিধি | তারিখ: ০৭-০৩-২০১৩
জামায়াত-শিবিরের হামলা ঠেকাতে গিয়ে গত চার মাসে পুলিশের সাতজন সদস্য নিহত এবং ৫৬৯ জন আহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশের ব্যবহূত ৫২টি যানবাহন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দেশব্যাপী এ হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। ..........
Details at:
http://prothom-alo.com/detail/date/2013-03-07/news/334495
ধ্বংসস্তূপে খাওয়া দাওয়া রাতযাপন
বারুদ ছিটিয়ে আগুন নিমেষেই সব শেষ
মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী | তারিখ: ০৭-০৩-২০১৩
জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব : শহরে বেরিয়ে স্তম্ভিত বগুড়াবাসী
শরিফুল হাসান, মিলন রহমান ও আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া থেকে | তারিখ: ০৭-০৩-২০১৩
__._,_.___