চিরদিন তোমার আকাশ : জাগ্রত শাহবাগের শিক্ষা
বিলু কবীর
১.
আমরা যারা প্রবীণ তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দানা বেঁধে ছিল যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী কর্তব্যগুলো বুঝি আর করা গেল না। যারা একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্য, রাজাকার, আল বদর, আল শামস এবং শান্তি কমিটি বা পিস কমিটির বীভৎস্য ও ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন, যারা দেখেছেন রাজাকার আর পাকিস্তানি। সৈন্যরা কীভাবে বাংলাদেশে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। প্রায় তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমকে লুণ্ঠন করেছে, তারা কীভাবে গ্রামের পর গ্রাম-জনপদের পর জনপদ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, কীভাবে তাদের অত্যাচারে এক কোটি মানুষ তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোয় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, সেই তারাই যদি যুদ্ধাপরাধীদের আইনি বিচার, রায় এবং তার কার্যকারিতা বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম কি তা করবে বা করতে পারবে, করতে চাইবে? কারণ ভুলভাল ইতিহাস পড়ে সঠিক সত্যকে অনুধাবন করে তারা কি মহান একাত্তর বিষয়ে কতখানি মর্মাহত হতে পারবে, যতখানি আমরা প্রত্যক্ষদর্শীরা বা প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগীরা হয়েছিলাম বা হতে পেরেছিলাম?
কিন্তু আশা করার মতো বিষয় হলো, তরুণ বস্নগাররা আমাদের সেই দুরাশা বা যাকে বলা যেতে পারে সেই হতাশাকে দূরীভূত করেছে। আমরা এখন শাহবাগের দিকে তাকিয়ে নতুন করে আশাবাদী হয়েছি। নতুন করে স্বপ্ন দেখছি যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক, বেশি ন্যায়মুখী। বেশি সাহসী, প্রতিবাদী এবং কার্যকর কর্মসূচি নিতে সক্ষম। তাই আমরা আজ শাহবাগের গণজাগরণের মঞ্চের বদৌলতে নতুন আশায় বুক বেঁধেছি, আমরা না পারলেও আমাদের তরুণ-তরুণীরা আমাদের ছেলে-মেয়েরা অবশ্যই পারবে।
২.
ব্যক্তির প্রাধান্য এবং দলীয় প্রাধান্য না থাকলেও যে গণসংহতি গড়ে তোলা যায় এবং প্রয়োজনীয় মুহূর্তে বাঙালিরা যে, সেই কাজটি করতে পারে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম সেটা প্রমাণ করতে পেরেছে। আমরা যারা নিয়মিত বা অনিয়মিত শাহবাগে যাই, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকব, ব্যক্তি বলতে সেখানে কেবল মা জাহানারা ইমামের একটি বিশালকায় ছবি আছে প্রেরণার উৎস হিসেবে। যিনি কোন দলের প্রতিনিধি নন, যিনি কোন রাজনৈতিক নেতা নন, কোন স্বার্থ হাসিল করা যার প্রত্যাশা নয়। একজন গৃহিণী শহীদ জননী, যিনি মুক্তিসেনা শহীদ রুমীর মা হিসেবে আমাদের সবার মা হয়ে উঠেছেন। তিনি মহৎ, তিনিই প্রথম মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন গড়ে তুলে তার প্রতীকী বিচার করতে পর্যন্ত সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে তার কাজে সমগ্র জাতির বিবেক প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছিল বলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এবং হয়ে আছেন আমাদের মা। লক্ষ্য করলে দেখা যায় আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এভাবে অবিসংবাদিত সর্বজনীন নেতা হয়ে উঠতে পারেন না। কারণ তাদের কথায় কাজে পুরোমাত্রায় জাতির প্রত্যাশা সত্যিকারভাবে প্রতিফলিত হয় না। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শাহবাগে অন্য কোন নেতার ছবি নেই। কোন দলীয় সেস্নাগান নেই। বরং যে নির্দলীয় জাতির সেস্নাগানগুলো স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় ব্যবহার করে না, সেই সর্বজনীন সেস্নাগানগুলো সেখানে উচ্চারিত হয়েছে। কতদিন পর আজ শাহবাগে সেই সেস্নাগান হলো, 'জয় বাংলা', 'তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা,' 'তুমি কে আমি কে/ বাঙালি বাঙালি,' এই সেস্নাগানগুলো কোন দল বা ব্যক্তি বিশেষের নয়, বরং তা দলমত নির্বিশেষে সবার। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, ওই সেস্নাগানগুলো আওয়ামী লীগ ব্যবহার করে করে তাদের নিজস্ব করে তুলেছে। এক্ষেত্রে বলতে হয় এটি মুর্খদের প্রলাপ। আওয়ামী লীগ এসব সেস্নাগান ব্যবহার করে কিন্তু সে তো কাউকে ব্যবহার করতে নিষেধ করেনি। আর যদি নিষেধ করেও থাকে বা এমন কোন মনোভাব প্রকাশ করেও থাকে তাহলেও অন্যরা তা মানবে কেন? 'জয় বাংলা' 'তুমি কে আমি কে' তোমার আমার ঠিকানা, জয় বঙ্গবন্ধু' এই সেস্নাগান কোন অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের বা কোন দলের একার নয়। বরং তা মুক্তিযুদ্ধকামী সব মানুষ ও সংগঠনেরই। তফাৎ এই যে আওয়ামী লীগ সেগুলোকে চর্চা অর্থে ব্যবহার করে, অন্যরা সেটা করে না। করে যে না, সে দোষ তো আওয়ামী লীগের নয়। হ্যাঁ যদি আওয়ামী লীগ বা অন্য কেউ দাবি করে যে ওই সেস্নাগান এককভাবে শুধুই তাদের, তাহলে তাদের দোষারোপ করা যেতে পারে। যেমন 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' 'বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক' এই সেস্নাগানগুলো আওয়ামী লীগ, বিএনপি সবাই ব্যবহার করতে পারে। এখন সেটা যদি তারা না করে, তাহলে সে দোষ তো তাদের হতে পারে না, যারা সেটা ব্যবহার করেন।
৩.
শাহবাগের আন্দোলন দেখে মনে হচ্ছে যে হ্যাঁ সমাজ এখনও অতটা পচে যায়নি। আমাদের অতীত থেকে আমরা বলা যেতে পারে কোন রাজনৈতিক শিক্ষাই গ্রহণ করিনি। কিন্তু আমাদের দুরবস্থা অনুধাবন করে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করেছে। এবং তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে। এর বিপরীতে আরেকটা যে আশার সৃষ্টি হয়েছে তাহলো আমাদের পরবর্তী এই প্রজন্মের মাধ্যমে তার পরবর্তী যে প্রজন্ম, তাদের মধ্যেও, মানে আজকে যারা শিশু, তাদের মধ্যেও এক ধরনের কর্তব্যবোধ ও জাতির চেতনার শুভ সংক্রমণ ঘটেছে, যা আমাদের বংশধারায় আরও এক প্রজন্ম দীর্ঘ হবে। যার সামাজিক প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী, আরও ভরসার উদ্রেককারী। অতএব এই প্রজন্ম কেবল যে তৈরি হয়েছে তা-ই নয়, তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করছেও বটে।
৪.
শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে হরতাল, প্রতিবাদ ইত্যাদির নামে জামায়াতে ইসলামী যে তা-ব, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, ভাঙচুর ও জ্বালাও-পোড়াও, হত্যাযজ্ঞের মতো নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে বা করে চলেছে, তাকে বলা যায় একাত্তরের পুনরাবৃত্তি। তারা যে কতটা ভয়ঙ্কর তারই প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১৩-তে আরও একবার। একাত্তরের সাক্ষী ছিল তখনকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এবং গোটা বিশ্ব। আর এবারে তাদের অমানবিক বীভৎসতার সাক্ষী হয়ে রইল বর্তমান বাংলাদেশের ১৬ কোটি নাগরিক এবং সমগ্র পৃথিবী।
৫.
শাহবাগের এই আন্দোলন এবং আমাদের চলতি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রলম্বিতা এবং রায় পাওয়ার মাধ্যমে আরেকটি বিশেষ শিক্ষা হলো সত্যকে আইনিভাবে 'সত্য' বলে প্রতিষ্ঠিত করাটা বড় শক্ত। এখানে বিচারপ্রার্থীরা যেন বড় অসহায়। তার উপরে সে বিচার যদি হয় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বহু বছর পর, তাহলে তো বিচারের দীর্ঘসূত্রতার এবং রায় পাওয়ার প্রতীক্ষার প্রলম্বিতার আর শেষই থাকে না। অতএব অভিজ্ঞতা এই যে, প্রত্যাশাও এই যে, অপরাধ ঘটার পর যত দ্রুত সম্ভব বিচার হওয়া। বিলম্ব মানেই বিস্মৃত হওয়া, আলামত নষ্ট হয়া, অপরাধীর শক্তি সঞ্চিত হওয়া, সাক্ষীর অভাব সৃষ্টি হওয়া, সন্ত্রস্ত হওয়া, অরাজকতার শিকারে বঞ্চনার মুখোমুখি হওয়া। অতএব শাহবাগের শিক্ষা হলো দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা এবং দ্রুত রায় কার্যকর করা।
শাহবাগ জাগিয়ে রাখতে জেগে থাক। শাহবাগ ভালো থাক।
- ওলামা-মাশায়েখ ও বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের অভিমত : জামায়াত কোন ইসলামী দল নয় নিষিদ্ধ করা হোক এই সংগঠনকে
- সাতক্ষীরায় সরেজমিন পরিদর্শন : জামায়াত-শিবিরের তা-ব আর নৃশংসতার চিহ্ন
- হরতালের আগেই ১৮ দলীয় জোটের তা-ব : নাশকতা আগুন
- খালেদার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চ'নষ্ট ছেলেরাই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত অর্জন পুনরুদ্ধারে মাঠে নেমেছে'প্রতি শুক্রবার শাহবাগে সমাবেশ
আশুলিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বক্তারা
তরুণদের অপমান করবেন না
গোলাম মর্তুজা ও অরূপ রায়, আশুলিয়া থেকে | তারিখ: ১৬-০৩-২০১৩
আশুলিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশইত্তেফাক রিপোর্টশাহবাগের তরুণদের নিয়ে খালেদার 'বিষোদ্গার'
__._,_.___