চট্টগ্রাম অফিস/ফটিকছড়ি প্রতিনিধি ॥ ফটিকছড়ির ভুজপুরের কাজীরহাটে গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের শান্তিপূর্ণ হরতালবিরোধী মিছিলে যে নৃসংশতা ও বর্বরতা চলেছে তা ছিল একেবারে সুপরিকল্পিত এবং দেশব্যাপী চলমান ন্যক্কারজনক ঘটনাবলীরই একটি অংশ। পুলিশ ইতোমধ্যে শতাধিক জামায়াত-শিবির, হেফাজত ও বিএনপি ক্যাডারদের চিহ্নিত করেছে। বিজিবি, র্যাবের ক্যাম্প বসিয়ে হামলায় অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতারের অভিযান চলছে। শনিবার পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৫ জন জামায়াত-শিবির নেতা ও ক্যাডারকে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য শনিবার ভুজপুর থানার ওসি শামসুদ্দীন ভুইয়াকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে জেলা পুলিশ সুপার হাফিজ আকতার জনকন্ঠকে জানিয়েছেন। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এখন নিশ্চিত করা হচ্ছে এলাকার সংসদ সদস্য যুদ্ধাপরাধী গ্রেফতারকৃত সাকা চৌধুরীর পরিবারের অর্থে জামায়াতী পরিকল্পনায় শিবির ও হেফাজতে ইসলামের ক্যাডারদের মাঠে নামিয়ে এ নৃসংশ ঘটনার জন্ম দেয়া হয়েছে। যা এ যাবতকালের একটি রেকর্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থানীয় কাজীরহাট মাদ্রাসা মসজিদের মাইক ব্যবহার করে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে স্থানীয় মানুষদের হিংস্র করে তোলা হয়। উল্লেখ্য, পুরো এলাকাটি জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত।
ঐ দিন দুপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকশ' মোটর সাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহন সমভিব্যাহারে ছাত্রলীগের উদ্যোগে হরতাল বিরোধী শান্তিপূর্ণ মিছিলের গতি ব্যারিকেড দিয়ে আটকিয়ে জামায়াত-শিবির ও হেফাজতের ক্যাডাররা ত্রিমুখী হামলা চালায়। হামলাকারীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ করার পাশাপাশি ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। আর একের পর এক মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এরা ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়।
ছাত্রলীগের মিছিলটিকে ফিরে আসার সময় কাজীরহাট মাদ্রাসা সংলগ্ন সড়কে বাধাগ্রস্ত করে কাজীরহাট মসজিদের মাইক থেকে প্রচার চালানো হয়Ñ আওয়ামী লীগের নাস্তিকরা মসজিদে হামলা করেছে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে তুলে নিয়েছে এবং নাস্তিকরা মানুষের ঘরে ঘরে নারী পুরুষের ওপর নিপীড়ন অত্যাচার শুরু করেছে। ডাহা এ মিথ্যা প্রচারে এলাকার লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে ঘরে যার যা ছিল লাঠিসোটা নিয়ে আওয়ামী লীগের মিছিলের ওপর হামলায় যোগ দেয়। উত্তেজিত শত শত মানুষ এ হামলায় অংশ নেয়। জামায়াত-শিবির ও হেফাজতী ক্যাডারদের প্রণীত নীল নকশা অনুসারে প্রায় দু'ঘণ্টা ধরে বর্বরতা চালানো হয়। এতে ছাত্রলীগের ৪ জন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। আহত হয় প্রায় ২শ'। খবর পেয়ে বিজিবি, র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাদের ওপরও সন্ত্রাসীরা গুলিবর্ষণ করে।
জেলা পুলিশ সুপার হাফিজ আকতার শনিবার জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন, তারা বিভিন্নভাবে হামলায় অংশগ্রহণকারী বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের শতাধিক নেতাকর্মীকে শনাক্ত করেছেন। ঘটনার পর গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এদিকে, নৃশংস এবং বর্বরোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকা জুড়ে সর্বত্র শোকের মাতম এবং থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঐদিন রাতেই জারিকৃত ১৪৪ ধারা শুক্রবার রাতে প্রত্যাহার করে নিয়েছে প্রশাসন। তবে এ অনভিপ্রেত নির্মম ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবির, বিএনপি ক্যাডার এবং হেফাজত ইসলামের কর্মীদের পাশাপাশি ভূজপুর থানার ওসি শামসুদ্দীন ভুইয়ার রহস্যজনক ভূমিকায় তার শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীসহ প্রায় ৩ শতাধিক মোটর সাইকেল, জীপ, পিক-আপ এবং প্রাইভেটকারযোগে মিছিলটি আজাদী বাজার থেকে শুরু হয়। গাড়ি বহরটি নানুপুর- লেলাং-ফটিকছড়ি সদর- হেঁয়াকোতে যাওয়ার পথে কাজীরহাট ভূজপুর থানার কাছে পৌঁছলে জামায়াত-শিবির-হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের নীলনকশায় প্রণীত হামলার শিকার হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসার মাইক থেকে সন্ত্রাসীরা মসজিদ ও মাদ্রাসায় আক্রমণ করছে বলে মাইকিং করা হয়। সোয়া ১টার সময় মাইকের ঘোষণা শুনে গ্রামের নারী-পুরুষসহ শত শত জামায়াত-শিবির-হেফাজতে ইসলামের কর্মী ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে মিছিলের ওপর হামলে পড়ে। এতে মিছিলে অংশগ্রহণকারী নিরস্ত্র ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পাশের রাস্তায়, বিলে এবং গাছের ঝোপে পড়ে থাকে। এ পর্যায়ে পুলিশ দ্রুত অকুস্থলে পৌঁছলে তারাও হামলার শিকার হয়। এ হামলায় পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় হেঁয়াকো ক্যাম্প থেকে বিজিবি এসে অকুস্থলে পৌঁছলেই হামলাকারীরা তাদের ওপরও আক্রমণ করে। বিজিবিও আত্মরক্ষা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাল্টা গুলি ছুড়ে। হামলাকারীরা বিজিবির দুটি পিকআপ, পুলিশের গাড়ি, আগুন নেভাতে যাওয়া দমকল বাহিনীর গাড়ি, ৪টি প্রাইভেটকার, ১টি মাইক্রো, ২টি জিপ, ১টি এ্যাম্বুলেন্স, ১০২টি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা দফায় দফায় হামলার পর আরও বিজিবি, র্যাব, অতিরিক্ত পুলিশ অকুস্থলে মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল বশর দুদু চৌধুরী শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, যখন এটিএম পেয়ারুল ইসলামসহ তিনি নিজেই মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা সহকারে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পেয়ারুল কাজিরহাট মাদ্রাসার মোহতামেম মওলানা জুনায়েদ বিন জালাল এবং ভূজপুর থানার ওসির সঙ্গে কয়েকদফায় টেলিফোনে আলাপ করে নেন। তাঁরা কোন অসুবিধা হবে না বলে আশ্বস্ত করায় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাটি কাজিরহাটে পৌঁছে। পৌনে ২টার সময় ফেরার পথে থানার সন্নিকটে মাইকিং করে মিছিলের ওপর নির্মম হামলা চালানো হয়। হামলার সময় থানার ওসি অফিস কক্ষে বসে থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে যাননি। ফটিকছড়ি থানা থেকে দ্রুত অকুস্থলে যাওয়া ফটিকছড়ি থানার ওসি (তদন্ত) মঞ্জুরুল কাদেরের নেতৃত্বে পুলিশ দল যাওয়ার পরও ভূজপুর থানা ওসির অনুমতি ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফাঁকা গুলি করতে পারেনি। ফলে, মিছিলকারীদের ওপর জামায়াত-শিবির ও হেফাজতী ক্যাডাররা হামলা জোরদার করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই হামলাকারীরা যেখানে যাকে পেয়েছে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিজিবি সদস্যদের কঠোর তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। এরই মধ্যে সন্ত্রাসীরা কেরোসিন ও গান পাউডার ছিটিয়ে শতাধিক গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হয় সড়কের এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ধ্বংস্তূপ। দুদু চৌধুরী আরও জানান, এ হামলা ছিল পরিকল্পিত। মিছিলের পূর্বদিন জামায়াত নেতা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আল কাদেরী, জামায়াত-শিবির নেতা, দুই ইউপি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন এ হামলা নিয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি আরও জানান, তাদের সঙ্গে থাকা জাফর চৌধুরী নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে ঢুকে পড়েন। সেখানে গিয়ে মা-বোনদের কাছে বাঁচানোর জন্য আর্তনাদ করেও কোন কাজ হয়নি। বরং ওই বাড়ির মহিলারা নাস্তিক বলে চিৎকার করে ধারাল অস্ত্র দিয়ে তাকে (জাফর) আঘাত করা হয়।
এদিকে, যে ৪৩ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে তাদের ৪১ জনই মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে ৮ জনের আঘাত গুরুতর। তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে শনিবার চমেক সূত্রে জানানো হয়েছে। এ তিনজন বেঁচে থাকলেও তাদের স্মৃতিশক্তি ফেরা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা।
এদিকে, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সাকা পরিবারের দেয়া অর্থে জামায়াত-শিবির ও হেফাজতীরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ছাত্রলীগের শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর এ বর্বরতা চালিয়েছে। এর জবাব আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আইনীভাবে দেয়া হবে, যা হবে কঠোর।
এদিকে, শুক্রবার রাতভর ভুজপুরে অভিযান চালিয়ে আরও ৯ জামায়াত-শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ নিয়ে গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৫। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় ১শ' জনকে সুনির্দিষ্ট আসামি করে ৫ হাজার জনের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করার পর আরও বেশ কয়েকটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। কাজিরহাটের বর্বর এ ঘটনার পর পূর্ব ও পশ্চিম ভুজপুর গ্রামজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শনিবারও কাজিরহাট এলাকায় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেনি। এলাকায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি টহল অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি মনিটরিং করার জন্য উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে অবস্থান করে চলেছেন।