From: shahadathussaini@hotmail.com
To: bazlul@yahoo.com; bangladeshiamericans@googlegroups.com; khabor@yahoogroups.com; alochona@yahoogroups.com; sayedahaq@yahoo.com; chottala@yahoogroups.com; mukto-mona@yahoogroups.com; mgani69@gmail.com; saokot_nccbl@yahoo.com; farida_majid@hotmail.com; zainul321@yahoo.com; kazi4986@yahoo.com; bangladesh-progressives@googlegroups.com; salimafsar@gmail.com; farzanamitu2003@yahoo.com
Subject: ভারত থেকে বৌদ্ধ উৎখাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্র
Date: Fri, 31 May 2013 19:28:41 -0400
Written by কে এম আমিনুল হক |
ভারত থেকে বৌদ্ধ উৎখাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্র ব্রাহ্মণজনগোষ্ঠী ভারতের ভূমি সন্তান নয়। এরা আর্য। আর্যরা ভারতের ভূমি সন্তান নয়- বহিরাগত। তারা অভাব দারিদ্র্য খাদ্য সংকট প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা যুদ্ধজনিত কারণে বিতাড়িত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দিকে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে আসে। আর্যদের আগমন সম্পর্কে সাম্প্রতিক ধারণা হল, খৃষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছরের দিকে মধ্য অথবা পূর্ব ইউরোপের অংশে অথবা রাশিয়ার উরাল পর্বতমালার সমতল ভূভাগে ইন্দো ইউরোপীয় অথবা আর্য জাতির উদ্ভব হয়। অত্যধিক শীতের জন্য হোক অথবা অন্য জাতির আক্রমণের ফলেই হোক এ আর্যরা পিতৃভূমি হতে দক্ষিণ পূর্বে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সভ্যতার দিক দিয়ে এরা খুব উন্নত ছিল এমনটি নয়। এ ব্যাপারে শ্রী অমিত কুমার বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, 'খৃস্টের জন্মের দু' হাজার বৎসর পূর্বে অর্থাৎ আজ হইতে প্রায় ৪ হাজার বৎসর পূর্বে ভারত বর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কাছে আর্য জাতির এক শাখা পশ্চিম পাঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয়। তাহাদের পূর্বে এদেশে কোল ভিল সাওতাল প্রভৃতি অসভ্য জাতি এবং দ্রাবিড় নামক প্রধান সুসভ্য জাতি বাস করিত।' এই দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের ভূমি সন্তান। এদেশে আগমনের পর দ্রাবিড়দের সাথে আর্যদের সংঘাত শুরু হয়। পর দেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আর্যদের সংগ্রাম শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের সংঘাত অব্যাহত থাকে। দূর দেশ থেকে ভয়সংকুল পথ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে সংকটের মধ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখার কৌশল অর্জন করে আর্যরা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জাতিগত সংকটের কারণে তারা দক্ষতার সাথে দ্রাবিড়দের মুকাবিলা করতে সক্ষম হয়। এক পর্যায়ে তারা ভূমি সন্তান দ্রাবিড়দের উপর বিজয়ী হয়। কালক্রমে দ্রাবিড়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর্যরা রপ্ত করে নেয়। দুই সভ্যতার মিশ্রণে নতুন সাংস্কৃতিক ধারা এবং ধর্মীয় অনুভবের সূচনা হয়। ওদিকে পরাজিত দ্রাবিড়রা বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয় অথবা আর্যদের অধীনে লাঞ্ছিত হতে থাকে। আর্যরা পরাজিত দ্রাবিড়দের ওপর তাদের নির্দেশনা চাপিয়ে দেয়। আর্যদের প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ প্রথার সর্বনিম্ন স্তরে দ্রাবিড়দের স্থান দেয়া হয়। পিরামিডের শীর্ষে স্থান নেয় আর্যরা। সর্ব নিম্নে অবস্থান হয় দ্রাবিড়দের। পিরামিডের স্তর বিন্যাস হয় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ দিয়ে। পুরো পিরামিডের ভার বহন করতে হয়- দ্রাবিড়দের। পর্যায়ক্রমে দ্রাবিড়রা আর্যদের বিন্যস্ত সমাজে হারিয়ে যায়। রুশ ঐতিহাসিক এ জেড ম্যানফ্রেডের মতে, সে যুগে ব্রাহ্মণদের কোন কর দিতে হত না। ক্ষত্রিয় শুদ্র প্রভৃতি জাতিকে ছোট লোক শ্রেণীর ধরা হত। নব্বই বছরের বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়কে নয় বছরের ব্রাহ্মণের পদ সেবা করতে হতো। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতির কাছে তাদের উৎপাদনের ৫ অথবা ৬ ভাগের এক ভাগ কর আদায় করা হত। নর হত্যা করলে শিরোশেদ হতো বটে কিন্তু কোন ব্রাহ্মণ যদি শুদ্রকে হত্যা করতো তাহলে শুধু মাত্র সামান্য জরিমানা দিলেই চলতো। যেমন পোষা কুকুর মেরে ফেলার শাস্তিস্বরূপ কিছু জরিমানা হয়। এইভাবে নিম্নস্তরে অবস্থানকারী সমগ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আর্যরা সমকালীন সমাজ বিন্যস্ত করে ধর্মীয় আবেশ সৃষ্টি করে। সে সময় বিবেক বহির্ভূত অন্ধ আবেগের দ্যোতনা সৃষ্টি করে নিত্য নবনব নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয় সাধারণ মানুষের ওপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাধারণ মানুষকে ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। অন্ধকারের পর যেমন আলো দেখা যায়, গ্রীষ্মের পর যেমন বর্ষা আসে অনুরূপ নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা সম্বলিত সমাজে নির্যাতন বিরোধী প্রতিরোধ শক্তির অভ্যুদয় হয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ধারক ব্রাহ্মণ্য সমাজে জন্ম নেয় গৌতম বুদ্ধ। রাজকীয় সুখ সাচ্ছন্দ এবং প্রভুত্বের ব্যঞ্জনা তাকে আটকে রাখতে পারল না। যুগ যুগান্তর ব্যাপী দক্ষিণ এশিয়ায় মানবতার লাঞ্ছনা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যকার পুঞ্জিভূত দুঃখ ক্লেশ অসম্মান ও অবমাননা তার মধ্যে ভাবান্তরের সূচনা করে। তিনি রাজকীয় সুখ সম্ভোগের মোহ পরিত্যাগ করে দেশান্তরিত হন এবং প্রচলিত নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন কোন ব্যবস্থার ছক অর্জন না হওয়া পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে চিন্তার গভীরে ডুব দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন নতুন ব্যবস্থার সূত্রসমূহের আবিষ্কার তার সন্তুষ্টির সীমায় এসে পড়ে তখন তিনি তার মত প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সমকালীন ঘুণে ধরা বির্তনমূলক সমাজ কাঠামোর বিপরীতে তার নতুন চিন্তা শোষিত বঞ্চিত নির্যাতীত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নবতর এক বিপ্লবের বার্তা হয়ে অনুরণিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে বৌদ্ধবাদ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে শোষণ ও বিবর্তনমূলক সমাজ কাঠামোর ধারক কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি তাদের প্রভুত্ব হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মানবিক বিপ্লব প্রতিহত করার জন্য বৌদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। বৌদ্ধদের ধর্মবিরোধী নাস্তিক এবং বিদ্রোহী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে বৌদ্ধ বিরোধী উম্মাদনা সৃষ্টি করে বৌদ্ধদের উৎখাতে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- 'বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক। বৌদ্ধগ্রন্থে এদের নাম আছে। মহাভারতে এদের নাম হেতুবাদী। তারা আসলে নাস্তিক। তারা বলতেন, পরকাল আত্মা ইত্যাদি বড় বড় কথা বেদে আছে কারণ ভণ্ড, ধূর্ত ও নিশাচর এই তিন শ্রেণীর লোকরাই বেদ সৃষ্টি করেছে, ভগবান নয়। বেদের সার কথা হল পশুবলি। যজ্ঞের নিহত জীবন নাকি স্বর্গে যায়। চার্বাকরা বলেন, যদি তাই হয় তাহলে যজ্ঞকর্তা বা জজমান তার নিজের পিতাকে হত্যা করে স্বর্গে পাঠান না কেন... '... এই ঝগড়া বাড়তে বাড়তে বেদ ভক্তদের সংগে বৌদ্ধদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঝাপ দিতে হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে নাস্তিক, চার্বাকদের উক্তিতেই প্রমাণ রয়েছে। অতএব বৌদ্ধরা মূর্তিপূজা যজ্ঞবলি বা ধর্মাচার নিষিদ্ধ করে প্রচার করছিল পরকাল নেই, জীব হত্যা মহাপাপ প্রভৃতি। মোটকথা হিন্দু ধর্ম বা বৈদিক ধর্মের বিপরীতে জাতি ভেদ ছিল না।' গতিশীল বৌদ্ধবাদ যখন জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করল তখন থেকে শরু হল ব্রাহ্মণ্যবাদের সাথে বৌদ্ধবাদের বিরোধ। সংঘাত ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠল। উভয় পক্ষই পরস্পরকে গ্রাস করতে উদ্যত হল। হিন্দুরা তাদের রাজশক্তির আনুকুল্য নিয়ে বৌদ্ধদের উৎখাতের প্রাণান্ত প্রয়াস অব্যাহত রাখে। কখনো কখনো বৌদ্ধরা রাজশক্তির অধিকারী হয়ে তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়। বৌদ্ধবাদ কেন্দ্রিক নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর-ভাঙন সৃষ্টির জন্য হিন্দুরা চানক্য কৌশল অবলম্বন করে। বৌদ্ধদের মধ্যকার অধৈর্যদের ছলেবলে কৌশলে উৎকোচ ও অর্থনৈতিক আনুকূল্য দিয়ে বৌদ্ধবাদের চলমান স্রোতের মধ্যে ভিন্ন স্রোতের সৃষ্টি করা হয় যা কালক্রমে বৌদ্ধদের বিভক্ত করে দেয়। বৌদ্ধবাদকে যারা একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে থাকে তাদেরকে বলা হতো হীনযান। আর হিন্দু ষড়যন্ত্রের পাঁকে যারা পা রেখেছিল যারা তাদের বুদ্ধি পরামর্শ মত কাজ করছিল তাদেরকে ব্রাহ্মণ্য সমাজ আধুনিক বলে অভিহিত করে। এরা মহাযান নামে অভিহিত। এরাই প্রকৃত পক্ষে পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মহাযান নতুন দল হিন্দুদের সমর্থন প্রশংসা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বৌদ্ধবাদের মূল আদর্শ পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজা শুরু করে। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তিমূলও নড়ে যায়। বৌদ্ধদের এই শ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে প্রথমত নির্ভেজাল বৌদ্ধবাদীদের ভারত ভূমি থেকে উৎখাত করে এবং পরবর্তীতে মহাযানদেরও উৎখাত করে। কিন্তু যারা একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আশ্রয় নিয়ে বৌদ্ধ আদর্শ পরিত্যাগ করে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে তাদের জাতি সত্তাকে বিসর্জন দেয় তারাই টিকে থাকে। সে কারণে আজ বৌদ্ধের সংখ্যা বৌদ্ধবাদের জন্মভূমিতে হাতে গোনা। কোন জাতি তার আদর্শ ও মূলনীতি পরিত্যাগ করে অপর কোন জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহন করলে সেই জাতিকে স্বাতন্ত্রবিহীন হয়ে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। ছয়শতকে যখন আরবে জাহেলিয়াতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে ইসলামের অভ্যুদয় হয়েছে সে সময় বাংলায় চলছিল বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞ। ৬০০ থেকে ৬৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলার শিবভক্ত রাজা শশাঙ্ক বাংলা থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত গয়ার বোধিদ্রুম বৃক্ষ গুলি তিনি সমূলে উৎপাটন করেন। যে বৃক্ষের উপর সম্রাট অশোক ঢেলে দিয়েছিলেন অপরিমেয় শ্রদ্ধা সেই বৃক্ষের পত্র পল্লব মূলকাণ্ড সবকিছু জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। পাটলিপুত্রে বৌদ্ধের চরণ চিহ্ন শোভিত পবিত্র প্রস্তর ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। বুশিনগরের বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেন। গয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে বৌদ্ধদেবের মূর্তিটি অসম্মানের সঙ্গে উৎপাটিত করে সেখানে শিব মূর্তি স্থাপন করেন। অক্সফোর্ডের Early History of India গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ মঠগুলি ধ্বংস করে দিয়ে মঠ সন্নাসীদের বিতাড়িত করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান নেপালের পাদদেশ পর্যন্ত বৌদ্ধ নিধন কার্যক্রম চালিয়েছিলেন কট্টর হিন্দু রাজা শশাঙ্ক। 'আর্য্যা মুখশ্রী মূলকল্প' নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম নয় জৈন ধর্মের ওপরও উৎপীড়ন ও অত্যাচার সমানভাবে চালিয়েছিলেন তিনি। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সাংস্কৃতিক চেতনা একই রকম। উভয় ধর্মে জীব হত্যা নিষেধ। আল্লাহ সম্বন্ধে তাদের ধারণা নেতিবাচক। এতদ্সত্ত্বেও ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাত করা হল এবং বৌদ্ধদের নিহত অথবা বিতাড়িত হতে হল অথচ মহাবীরের ধর্ম জৈন আজো ভারতে টিকে রয়েছে। এটা বিস্ময়কর মনে হলেও এর পেছনে কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সেটা হল বৌদ্ধরা শুরু থেকে হিন্দুদের দানবীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা প্রতিক্রিয়াশীল-চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। পক্ষান্তরে জৈনরা হিন্দুদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়নি। হিন্দুদের সাথে সহঅবস্থান করেছে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি সভ্যতা সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে। তারা মেনে নিয়েছে হিন্দুদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি, তারা ব্যবসায়ের হালখাতা, গনেশ ঠাকুরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, দুর্গাকালি স্বরস্বতী পূজা পার্বন হিন্দুদের মত উদযাপন করতে শুরু করে। ভারত জনের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে- 'হিন্দু মতে যদিও জৈন ও বুদ্ধ উভয়ে নাস্তিক তাহা হইলেও হিন্দু ধর্মের সহিত উভয়ের সংগ্রাম তীব্র ও ব্যাপক হয়নি। হিন্দুদের বর্ণাশ্রম হিন্দুদেব দেবী এবং হিন্দুর আচার নিয়ম তাহারা অনেকটা মানিয়া লইয়াছেন এবং রক্ষা করিয়াছেন।' আজকের হিন্দু ভারত তাদের পূর্ব পুরুষদের কৃতকর্ম মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ধুয়া তুলসী পাতা হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারে একটি মিথ্যা বানোয়াট ও অমার্জনীয় তথ্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে... বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ খৃস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ দিয়েছে ১১০০ খৃস্টাব্দ। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার উদন্তপুরী আক্রমণ করেছেন ১১৯৩ খৃস্টাব্দে আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খৃস্টাব্দ। মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুভারত মুসলিম বিজেতাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য ইতিহাসের তথ্য বিকৃত করতেও কুণ্ঠিত নয়। প্রকৃত ঘটনা হল একজন ব্রাহ্মণ কর্তৃক সম্রাট হর্ষবর্ধনকে হত্যা তারপর ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ক্ষমতা দখল করেন। এই সময় ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে একদল উগ্রবাদী ধর্মোন্মাদ হিন্দু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস ও ভস্মীভূত করে। ৪০০ খৃষ্টাব্দে চীনা পর্যটক ফাহিয়েন যখন গান্ধারা সফর করেন তখন উত্তর ভারতে বিকাশমান বৌদ্ধ ধর্মের গৌরবোজ্জল অধ্যায় দেখতে পান। কিন্তু ৬২৯ খৃস্টাব্দে অপর একজন চীনা বৌদ্ধ সন্নাসী ১২০ বছর পর নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। ৬২৯ সালে আর একজন চীনা পর্যটক গান্ধারা সফর করে বৌদ্ধবাদের করুণ পরিণতি দেখে মানসিকভাবে বিপন্ন হন। বখতিয়ার বৌদ্ধদের ওপর কোন ধরনের নির্যাতন করেছেন এমন কথা ইতিহাস বলে না বরং বৌদ্ধদের ডাকে বঙ্গ বিজয়ের জন্য বখতিয়ার সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। এমনকি বিজয়ান্তে তিনি বৌদ্ধদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় থেকে বিরত থাকেন। বাংলায় ১৪ শতকের অভিজ্ঞতা ১২ শতকে বাংলার ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাব ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির উত্থান। ১৩ শতকের প্রথম দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার দুশ' বছরের মধ্যে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিধ্বস্ত হিন্দু শক্তির উত্থান সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৫ শতকে রাজাগনেশের আকস্মিক উত্থান কিভাবে সম্ভব হল? এ জিজ্ঞাসার জবাব পেতে সমকালীন ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে। উপমহাদেশের বৌদ্ধবাদের উৎখাতের পর বহিরাগত আর্য অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এখানকার মূল অধিবাসীদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হলেও অপরাজেয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের উপস্থিতি তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। মুসলমানরা বহিরাগত ব্রাহ্মণ সৃষ্ট বর্ণবাদের শিকার এদেশের সাধারণ মানুষকে মুক্তির নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ করে দেয়। বিধ্বস্ত অবস্থায় ছোট ছোট অবস্থানে হিন্দু শক্তি তার বিক্ষত অস্তিত্ব কোন মতে ধরে রাখলেও বৃহত্তর পরিসরে শেষ পর্যন্ত বাংলাই ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির দৃশ্যমান সর্বশেষ দুর্গ। সব শেষে বাংলা থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি উৎখাতের পর তাদের প্রাধান্য বিস্তারে রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। এতদসত্ত্বেও তাদের পুনরুত্থানের আকাঙ্খা চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত হয়নি। সংগ্রাম সংঘাতের মধ্য দিয়ে আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারে কয়েক সহস্রাব্দের অভিজ্ঞতা ও কৌশল পূঁজি করে দুর্দমনীয় মুসলিম শক্তি বিনাশের জন্য সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে। সেই সুযোগটা এসে যায় ইলিয়াস শাহী সালতানাতের মুসলিম শক্তি কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতার মধ্য দিয়ে। মোহাম্মদ তুগলকের শাসনামলের শেষ পর্যায়ে উপমহাদেশের মুসলিম শক্তি কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে বাংলার ইলিয়াস শাহী সালতানাতকে ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। যুদ্ধ ও অবরোধের মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ইলিয়াস শাহকে বিপর্যস্ত হতে হয়। এই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে নিজস্ব শক্তি পুনর্গঠন ও সুসংহত করার জন্য সুলতানকে স্থানীয়ভাবে সৈন্য সংগ্রহ করতে হয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে। এ কারণে হিন্দু প্রধানদের সদিচ্ছা ও সমর্থনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রীয় নীতি কৌশল পুনর্বিন্যাসে হিন্দু প্রধানদের স্বার্থ বিবেচনায় আনতে হয়। আর এ সময়ই রাজা গনেশ সুলতানের দরবারে স্থান করে নেয়। শুধু গনেশই নয়, এই সাথে আরো কতিপয় প্রভাবশালী হিন্দু ইলিয়াস শাহের দরবারে সংশ্লিষ্ট হয়। মুহাম্মাদ শাহের পুত্র ফিরোজশাহ তুগলক বাংলা পুনরুদ্ধার প্রয়াসে বিহার আক্রমণ করার ফলে ইলিয়াস শাহ এবং তার পুত্র সিকান্দার শাহ যে করুণ অবস্থার সম্মুখীন হন সেটা অবলোকন করে রাজা গনেশ তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেন এবং গভীর মনোযোগী হয়ে উপমহাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। ফিরোজ শাহ তুগলকের মৃত্যুরপর দিল্লীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বেশ কটি স্বাধীন সালতানাতের অভ্যুদয় এবং তৈমুর লং কর্তৃক দিল্লী লুণ্ঠনসহ বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহ বাংলায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুপ্ত আকাঙ্খা ব্রাহ্মণ্যবাদী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহমান হয়ে উঠে। সালতানাতের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে রাজা গনেশের নেতৃত্বে হিন্দু রাজন্যবর্গ তাদের কূট কৌশল প্রয়োগ করে শাহী দরবারের সভাসদদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের শাসনামলের ঔদার্যের ফলে রাজা গণেশ প্রাধান্যে এসে যায়। সুলতানের মৃত্যু অথবা অপমৃত্যুর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সালতানাতের সবচেয়ে বিচক্ষণ মন্ত্রী খানজাহান ইয়াহিয়ার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর ১৪১১-১২ সাল নাগাদ রাজা গনেশ সালতানাতের রাজনীতির পুরো ভাগে এসে পড়ে। ধারণা করা হয় যে, এসব অপমৃত্যু ও হত্যাকাণ্ডের অন্তরালে রাজা গনেশের চক্রান্ত বিদ্যমান ছিল। সাইফ আল দ্বীন হামযার স্বল্পকালীন শাসনামলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। হামযা শাহকে কোন এক পর্যায়ে রাজা গনেশ ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যা করেন। ইতিপূর্বে রাজা গণেশ হামযা শাহকে নামে মাত্র ক্ষমতাসীন রেখে সমস্ত ক্ষমতা নিজে কুক্ষিগত করে রাখেন। এমন অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে হামযা শাহ এর গোলাম শিহাব সাইফুদ্দিন রাজা গনেশের গভীর ষড়যন্ত্র অনুধাবন করেন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেন। শিহাব সাইফুদ্দিন রাজা গনেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং রাজাকে সাময়িকভাবে স্তব্দ করে দিতে সক্ষম হন। অতঃপর শিহাব সাইফুদ্দিন বায়জিদ শাহ নাম ধারণ করে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বৈদিক চক্রের কাছে অবশেষে তাকে পরাজিত হতে হয়। রাজা গনেশ তাকে ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যা করেন। বাইজীদ-এর সন্তান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ গনেশের অপকর্মের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ক্ষমতার এই টানাপোড়ন ৪ বছর স্থায়ী হয়। রাজা গনেশের কূট চক্রের কাছে অবশেষে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ পরাস্ত হন এবং রক্তাক্ত পরিণতি তার ভাগ্যে জুটে। ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে রাজা গনেশ মুসলমানদের উচ্ছেদ করার মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি তাদের প্রতি খড়গ হস্ত হয়ে উঠেন যারা মোটামুটি জনগণের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অতি ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে মুসলিম নিধন শুরু করা হয় এবং বহু জ্ঞানী-গুণী হত্যা করা হয়। সমকালীন প্রভাবশালী মাশায়েখ শেখ বদরুল ইসলাম এবং তার পুত্র ফাইজুল ইসলাম রাজাকে অভিনন্দন জানাতে অস্বীকার করলে তাদেরকে দরবারে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। রাজা গনেশ তার শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করার অপরাধে পিতা পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। একই দিনে রাজার নির্দেশে অসংখ্য গুণী জ্ঞানী মানুষকে নৌকা ভর্তি করে মাঝ দরিয়ার ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। হেমিলটন বুকানন লিখেছেন, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলার নেতৃস্থানীয়রা শেখের চত্তরে ভিড় জমায়। নূর কুতুবুল আলম দ্বিরুক্তি না করে জৌনপুরের সুলতানের প্রতি বিপর্যস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের আমন্ত্রণ জানান। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম সসৈন্যে ফিরোজপুর উপকণ্ঠে এসে ডেরা গাড়লেন। রাজা গনেশ মুসলিম সৈন্যদের প্রতিরোধের দুঃসাহস করলেন না। রাজা গনেশ নূর কুতুবুল আলমের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। শেখ বললেন, রাজা গনেশের ইসলাম গ্রহণ ছাড়া জৌনপুরের সেনাবাহিনী প্রত্যাহত হবে না। প্রথমত রাজা গনেশ সম্মত হলেও তার স্ত্রীর প্ররোচনায় ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে পিছিয়ে গেলেন। বিনিময়ে তার পুত্র যদুকে ইসলামে দাখিল করলেন। শায়েখ যদুকে ইসলামে দীক্ষিত করে নতুন নাম দিলেন জালাল উদ্দিন। জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে জৌনপুরের সৈন্যরা বাংলা ত্যাগ করে। বাংলা থেকে জৌনপুরের সৈন্য প্রত্যাহারের পর রাজা গনেশ পুনরায় স্বরূপে আবির্ভূত হলেন, নতুন করে শুরু হল মুসলিম নিপীড়ন। রাজা গনেশ তার ধর্মান্তরিত সন্তান যদুকে ব্রাহ্মণদের পরামর্শে প্রায়শ্চিত্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করানোর উদ্যোগ নেন। তার মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ড এমনই ভয়ংকর হয়ে উঠে যে নূর কতুবুল আলমের পুত্র শেখ আনোয়ারকে ফাঁসীতে ঝুলানো হয়। এই একই দিনে গনেশ বিরোধী ক্ষোভ তীব্র হয়ে এমন ভয়াবহ রূপ নেয় যে, তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে গনেশ উল্টে যায়। রাজা গনেশ শুধু উৎখাতই হলেন না তাকে হত্যা করা হল এবং জালাল উদ্দিন মুহাম্মদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া হল। রাজা গনেশের পুত্র নব দিক্ষীত মুসলমান জালাল উদ্দিন দক্ষ সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তিনি পুনরায় বাংলার সালতানাতকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করালেন। বাংলার ভিন্নমুখী স্রোত আগের মতই প্রবাহিত হতে শুরু করে। উপমহাদেশ প্রসঙ্গ ১১৯৭ থেকে ১৫২৫ সাল পর্যন্ত তুর্ক আফগান মুসলমানরা সমগ্র উপমহাদেশে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু যখন তাদেরকে ভোগ বিলাস ঘিরে ধরে তখনই তারা দুর্বল হয়ে পড়েন এবং অনৈক্য ও ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিপর্যস্ত হতে থাকেন। মুসলিম শক্তির হাতে মার খাওয়া মধ্য ও উত্তর ভারতের হিন্দু রাজা মহারাজারা সংঘবদ্ধ হতে থাকে মুসলিম শক্তিকে পর্যুদস্ত করার জন্য। ওদিকে মধ্য এশিয়ার এক সংগ্রামী পুরুষ জজির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবর যে তার রাজ্য সমরখন্দও বোখারা হারিয়ে নিরাশ্রয় ভবঘুরের মত পথে পথে ঘুরছিলেন, নিজের শক্তি সামর্থ্য অর্জন করে তিনি পুনরায় মধ্য এশিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ভারত পর্যন্ত ধেয়ে আসেন। ১৫৬২ সালে তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লী দখল করেন। দিল্লীতে তখনও তিনি পরিপূর্ণ শিকড় গাড়তে সক্ষম হননি। দিল্লী দখলের ১ বছরের মাথায় রাজপুত নামালব ও মধ্য ভারতের ১২০ জন রাজা মহারাজা সংঘবদ্ধভাবে মুসলিম শক্তি উৎখাতের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাদের ৮০ হাজার অশ্বারোহী এবং ৫শ' রণহস্তী এবং অসংখ্য পদাতিক বাহিনীর মুকাবিলায় বাবরের মাত্র ১০ হাজার সৈন্য মরণপণ লড়াই করে আগ্রার অদূরে খানুয়ার যুদ্ধে সংঘবদ্ধ হিন্দু শক্তি বিদ্ধস্ত হওয়ার পর শক্তি দিয়ে মুসলমানদের মুকাবিলার উচ্ছাশা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মন থেকে উধাও হয়ে যায়। অতঃপর তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করে। তাদের পরিক্ষীত কৌশল তিন প্রজন্ম প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী হয়। এ প্রকল্প আর কিছু নয় তিন প্রজন্মের মধ্যে মুসলমানদেরকে বিপথগামী করে নিজেদের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করা। তিন প্রজন্ম প্রকল্প সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হল। তিন প্রজন্ম প্রকল্প প্রথম প্রজন্মে একজন ১০০% মুসলমান পুরুষের সাথে একজন ১০০% হিন্দু নারীর বিয়ে দিতে হবে। তাদের মিলনে যে শংকর সন্তান জন্মাবে সে হবে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে ৫০% মুসলমান এবং ৫০% হিন্দু। দ্বিতীয় প্রজন্মে সেই ৫০% মুসলমানের ১০০% হিন্দু নারীর বিয়ে হলে যে শংকর সন্তান জন্মাবে সে হবে ১৭% মুসলমান ও ৮৩% হিন্দু। এবং তৃতীয় প্রজন্মে সেই ১৭% মুসলমানের সাথে কোন ১০০% হিন্দু নারীর বিয়ে দিলে পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানটি সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে হবে ৯৩% হিন্দু এবং ৭% মুসলমান। অর্থাৎ তিন প্রজন্ম শেষ হতে না হতেই মুসলমানিত্ব শেষ হয়ে যাবে। (ইতিহাসের অন্তরালেঃ ফারুক মাহমুদ, পৃ.১৯৭) বাস্তবায়ন শুরু শেষ অবধি ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও হিন্দু রাজন্যবর্গ সম্মুখ সমর পরিহার করে মুসলমানদের চরিত্র হননের বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই চরিত্র হনন প্রক্রিয়া শুরু হয় হুমায়ুনের শাসন কাল থেকে। হুমায়ুন শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে পলাতক জীবন যাপনকালে হিন্দু রাজা মহারাজাদের সাহচর্যে এবং ইরানে আশ্রিত জীবন যাপন কালে শরাব সাকী এবং হেরেম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তার দিল্লী পুনর্দখলের পর হেরেম জীবনের সুখানুভূতির আকাঙ্খা তীব্র হয়ে ওঠে। পিতা বাবরের সংগ্রামী জীবনের পথ পরিহার করে অবশেষে হুমায়ুন ভোগ বিলাসী জীবন যাপনের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ে। রাজপুত ও হিন্দু রাজা মহারাজা এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা সে সময় যাবতীয় প্রমোদ উপাচার সুরা এবং নৃত্য গীত পটিয়সী সুন্দরী সরবরাহের যোগানদার হয়ে উঠে। তাদের সরবরাহকৃত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চতুর রমনীরা তাদের সুনিপুণ অভিনয় ও চাতুরী দিয়ে শুধু মুঘল সম্রাটই নয় আমীর ওমরাহদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং পরবর্তীতে মুঘল রাজনীতিকে পঙ্কিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করে। অবশেষে হুমায়ুনের মৃত্যু ব্রাহ্মণ্যবাদী কুচক্রীদের জন্য বড় রকমের সুযোগ এনে দেয়। ১৩ বছরের কিশোর আকবর তখনো যার মধ্যে ভাল মন্দ উপলব্ধি করার শক্তি সুসংহত হয়নি এমন একজন অশিক্ষিত নাবালক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। এই অশিক্ষিত কিশোর সম্রাটকে রাজপুত হেরেম বালারা তাদের রূপ যৌবন ছলাকলা দিয়ে বিভ্রান্তির দিকে টেনে নিয়ে চলে সফলভাবে। হিন্দু দর্শন ও জীবনাচার আকবরের মন মগজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। রাজা মহারাজাদের অনেকেই আকবরের হাতে ভগ্নী ও কন্যা সম্প্রদান করে মুঘল পরিবারে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলে। জয়পুরের রাজা বিহারী মল (মান সিংহের পিতামহ) তার কন্যা জয়পুরী বেগমকে বিয়ে দেন ১৯ বছরের তরুণ সম্রাট আকবরের সাথে। এই আত্মীয়তার সুবাদে পিতা পুত্র এবং পৌত্র যোগ দান করেন আকবরের সেনাপতি পদে। বিকানীর ও জয়সলমীরের রাজারাও আকবরকে কন্যা দান করেন। মানসিংহ তার বোন রেবা রানীকে বিয়ে দেন জ্যেষ্টপুত্র ভাবী সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে এবং কন্যাকে বিয়ে দেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ট পুত্র ভাবী সম্রাট খসরুর সাথে। (An Advanced history : Re Mayodan, P-441-43) উত্তর মধ্য ভারতের অন্যান্য রাজা মহারাজারাও এই মহাজন পন্থা অনুসরণ করে মুঘল যুবরাজ ও ওমরাহদের আত্মীয়ভুক্ত হন। অতঃপর নিকটাত্মীয়ের দাবীতে মুঘল বাহিনীর প্রায় সবগুলো গুরুত্বপুর্ণ সেনাপতির পদ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের করায়ত্ত হয়। তারা সোয়া তিনশত বছর ধরে সারা ভারতে জেঁকে বসা তাদের পুরানো শত্রু তুর্ক আফগান মুসলমানদের নির্মূল করেন মুঘলদের সাথে নিয়ে। রাজ দরবারে ফৈজী আবুল ফজল প্রমুখ আমীর ওমরাহের প্রতিপক্ষে বীরবল ও টোডরমল হিন্দু সভাসদবর্গ আসন গ্রহণ করে। (ইতিহাসের অন্তরালে ফারুক মাহমুদ, পৃঃ ১৯৭) জাহাঙ্গীরের সময় নূরজাহান এবং আসফ জাহর রাজনৈতিক তৎপরতা এবং শায়েখ আহমদ সরহিন্দের বলিষ্ট ভূমিকায় ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের দুর্নিবার অগ্রযাত্রা অনেকখানি ব্যাহত হলেও মুঘল প্রাসাদে আকবরের আমলে যে বিষ বৃক্ষ রোপিত হয়েছিল সেটা ইতিমধ্যে মহীরুহে পরিণত হয়ে গেছে। ভোগ বিলাসী আত্মসর্বস্ব যুবরাজ ও আমীর ওমরাহ প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও আত্মঘাতী সংঘাতের মধ্য দিয়ে আত্মবিনাশের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই সুযোগে মুসলিম শক্তিকে উৎখাত করে হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে রাজপুত, জাঠ ও শিখ সম্প্রদায়। এর পেছনে সক্রিয় ছিল বর্ণ হিন্দুরা। যে ভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরকে ভারতের মাটি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল অনুরূপ পন্থায় মুসলিম শক্তিকে উৎখাত করার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। 'মারাঠারা সমগ্র মধ্য ভারত জয় করে। দিল্লী শহর লুণ্ঠন করে। মারাঠা রাজপুত জাঠ শিখদের বিভিন্ন সসস্ত্র বাহিনী, উপবাহিনী সমগ্র মধ্য পশ্চিম ও উত্তর ভারতের মুসলিমদের অসংখ্য মসজিদ ধ্বংস করে, সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং তাদেরকে দলে দলে হত্যা করতে থাকে।' কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুঘলদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। তারা এবং আমীর ওমরাহ সকলে নিজেদের নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ে। উপমহাদেশের মুসলমানদের এই নিরূপায় অবস্থায় দিল্লীর মুজাদ্দিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর আহ্বানে আফগান বীর আহমদ শাহ আবদালী পর পর ৯ দফা ভারত আক্রমণ করে মারাঠাদের ঔদ্ধত্য গুঁড়িয়ে দেন। দিল্লীর সন্নিকটে একটি রণক্ষেত্রে ১ লক্ষ মারাঠা সৈন্য প্রাণ হারায়। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও তাদের মুসলিম বিধ্বংসী তৎপরতা অব্যাহত থাকে। তবে আগের দুর্নিবার গতি অনেকটা হ্রাস পায়। কিন্তু সুবাহ বাংলায় সেই একই তৎপরতা প্রচ্ছন্নভাবে সমান গতিতে এগিয়ে চলে। নবাবদের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের অজ্ঞাতে তাদের উৎখাতের ষড়যন্ত্র ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠে। একদিকে পর্যায়ক্রমিক ব্রাহ্মণ্য ষড়যন্ত্র উত্তরোত্তর শক্তি সঞ্চর করে, অন্যদিকে 'দক্ষিণের পথ ধরে বর্গী বলে অভিহিত মারাঠা বাহিনী সুবাহ বাংলা অবধি লুটতরাজ চালায়। তাদের শিকার হয়েছিল সুবাহ বাংলার সম্পদশালী মুসলিম পরিবারগুলো। |
__._,_.___