রবিবার, ১২ মে ২০১৩, ২৯ বৈশাখ ১৪২০
রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না
মুনতাসীর মামুন
॥ চতুর্থ কিস্তি ॥
অনেকে বলছেন, হেফাজতীরা ভাড়া করা এতিম তালেবএলেমদের দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সেøাগান দেওয়াচ্ছিলেন। সেøাগানটি ছিল 'শেখ হাসিনার গালে গালে জুতা মার তালে তালে'। মাদ্রাসার ছাত্রদের তাহজীব-তমুদ্দুন শেখাবার বদলে এইসব বেয়াদবি শিক্ষা দিচ্ছে বাবুনগরীরা। একজন ধর্মপ্রাণ বয়সী মহিলার নামে এই স্লোগান সভ্যতার কোন নিরিখে পড়ে না। হে বাবুনগরী, আহমেদ শফির নামে এ সেøাগান দিলে ভালো লাগবে? না, এ বেয়াদবি সেক্যুলার উদারপন্থীরা করে না। এসব বেয়াদবি শিক্ষা দেয়া হয় বাবুনগরীদের মাদ্রাসায়। এই সব সেøাগানের কারণে শেখ হাসিনা ক্রুদ্ধ হয়ে হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। তিনি ক্রুদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু এই কারণে হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন এমন মহিলা তিনি নন। রাজনীতি করলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে যন্ত্রণার যে স্টিমরোলার তাঁর ওপর দিয়ে গেছে, অন্য কারো পক্ষে তা সহ্য করা দুঃসহ হয়ে উঠত।
অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ অফিসে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে বহুবার হামলা হেফাজতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কারণ এটি একটি সামান্য কারণ হতে পারে বটে, তবে মূল কারণ নয়। হেফাজতীদের মতো উঠতি একটি দল আওয়ামী লীগ অফিস বারবার আক্রমণ করবে এবং সরকার আগের মতো নিশ্চুপ থাকবে- তাহলে দলই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। হতাশা আরো বাড়বে। তারপরও বলব এটি মূল কারণ নয়। মূল কারণ, হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপিরা এমন তা-ব সৃষ্টি করছিল যাতে মনে হচ্ছিল, এ সরকার কার্যত আর নেই। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার তা মেনে নিতে পারে না। তাদের ব্যবস্থা নিতে হয়। তাছাড়া জনগণের জানমাল রক্ষা করাও সরকারের অন্তিম দায়িত্ব।
ইতোমধ্যে হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপিরা বায়তুল মোকাররমের ধর্মীয় বইয়ের দোকানগুলো আক্রমণ করে। গত ৪২ বছরে অনেক দুর্যোগেও এসব ক্ষুদ্র দোকানের ওপর কখনও হামলা হয়নি। কারণ এসব দোকানে কোরান, আমপারা, তসবি, জায়নামাজ, টুপি, আতর বিক্রি হয়। হেফাজতী-জামায়াতী-বিএনপি (সংক্ষেপে এরপর থেকে হেজাবি) যখন দোকানগুলো আক্রমণ করতে যায় তখন ক্ষুদ্র দোকানদাররা বারবার মিনতি করছিল। ইয়াজিদের বরপুত্ররা তা শোনেনি। রসুল (স.)-এর নাতিদের হত্যায় ইয়াজিদের মন কাঁপেনি, আর ইয়াজিদের পুত্রদের হাত কাঁপবে? বরং কোরান-হাদিস যাতে ভালো করে আগুনে পোড়ে সে জন্য গান পাউডার ছড়িয়ে আগুন দেয়া হয়। নিমিষে ৬৩৫ জিল পবিত্র কোরান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভস্মীভূত হয় অন্যান্য বই ও সামগ্রী। ক্ষতির পরিমাণ এক কোটিরও বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব দেখল হেজাবিরা ধর্মগ্রন্থ কিভাবে পোড়ায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো। নাস্তিক হওয়াও এত বড় পাপের মধ্যে পড়ে না। এক হিন্দু ভদ্রলোক বলছিলেন, ভাই, মুসলমান না হতে পারি; কিন্তু কোরান তো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, সেটিতে আগুন দিতে বুক কাঁপল না! ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো দেখে তাঁর চোখে পানি। একজন বলেছিলেন, যে ইসরাইল ও ইহুদীদের অধিকাংশ মুসলমান রাষ্ট্র ঘৃণা করে তারাও কখনও কোরান পোড়ায়নি। এমনকি নাসারাদের দেশ আমেরিকার মৌলবাদী এক নাসারা কোরান পোড়ানোর হুমকি দেয়ায় স্বয়ং বারাক ওবামা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিলেন। কওমিরা কেমন মুসলমান তা প্রমাণিত হলো। হেজাবিরা আমাদের মুসলমানত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কোরান পোড়ানোর অথর্, তারা আর ইসলাম মানে না। আমরা ধর্ম থেকে কী খারিজ হব, এখন বাবুনগরী ও কওমি ও হেজাবিদের প্রমাণ করতে হবে তারা আদৌ ধর্মে বিশ্বাস করে কিনা? তারা শাহবাগের তরুণদের নাস্তিক বলে, কিন্তু এখন প্রমাণ হলো তারা কোরান পোড়ানো নাস্তিক। এক দোকানদার চিৎকার করে বলছিলেন (টিভি ফুটেজ) -এরা 'আল্লাহর শত্রু' এরা ধর্মের শত্রু, এরা নবীর (স.) শত্রু। এ কথার যৌক্তিকতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক তরুণ বিক্রেতাও বলেছিলেন, শফির গুন্ডারা এ কাজ করেছে অর্থাৎ হেজাবিরা। আল্লামা নয়, হজরত নয়, মৌলানা নয় একেবারে শফি। যে সম্মান অর্জন করতে জনাব শফির লেগেছে ৭০/৮০ বছর। এক নিমিষে তা ধুলায় লুটাল। আল্লাহ্ বান্দাকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন। আমরা অধিকাংশ সাধারণ বান্দা তাতে পাস করতে পারি না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার মোহে আহমেদ শফিও অন্ধ হয়ে গেলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী কোরান পুড়িয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপির সহযোগী জামায়াতীরা কোরান ও জয়নামাজ পোড়ানো শুরু করে, মসজিদে আগুন লাগানো শুরু করে। বিএনপিও তা পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করে। হেজাবিরাও এখন তা করল। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে হয়, হেফাজতের নির্দেশে হেজাবিরা কোরান পোড়ল।
এখানেই শেষ নয়, এরপর এরা বায়তুল মোকাররমের সোনার ও অন্যান্য দোকানে আগুন লাগায়, লুট করে। প্রমাণিত হলো হেজাবিরা কোরান পোড়ায়, আগুন লাগায় ও লুট করে। যদি কার্যকর কোন সরকার থাকে তাহলে এ পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ব্যবস্থা নিতে হয়। সরকারও সে ব্যবস্থা নিয়েছে। আওয়ামী লীগও ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষ নেয়। বিকেলে সৈয়দ আশরাফুলের বক্তব্যে অধিকাংশ মানুষ চমৎকৃত ও বিস্মিত হয়। অনেকে বিস্মিত হয়ে বলেন, দেশের এ অবস্থা দেখে আশরাফুল ও আর ঘুমোতে পারেননি। অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা বক্তব্যের বদলে প্যান প্যান করেন। আশরাফুল মাপা কথায়, ঠাণ্ডা গলায় যেভাবে বক্তব্য দিলেন, তাতে প্রাণ খুলে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে হয়। রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের কথা তিনি বলেননি। যে রকম কথা আমরা পছন্দ করি, সরাসরি সে রকমই বলেছেন। মূল বক্তব্য- হেফাজতীদের আর ঢাকায় আসতে দেয়া হবে না। বাড়াবাড়ি করলে বাড়ি থেকে বেরুতে দেয়া হবে না। যারা এসব করছে তারা রাজাকার, রাজাকারের বাচ্চা। মুহূর্তে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। দেশের যাবতীয় সেলফোন ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের নমনীয়তার কারণে যারা বিমষর্, হতাশ হয়ে মুষড়ে পড়েছিল তারা নিমিষে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তবে সংযম দেখায়। চাঙ্গা হয়ে যদি তারা রাস্তায় নামত তাহলে হেজাবিদের খবর ছিল। সাদেক হোসেন খোকাকে ১৯৭২ সালের মতো, মওদুদ আহমেদকে ১৯৯০ সালের মতো দৌড়াতে হতো। আশরাফের বক্তব্য অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাকি কাজ সম্পন্ন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী 'ধাক্কাতত্ত্ব' দিয়ে যে জমি হারিয়েছিলেন, ৬ মে সকালে সে জমি পুনরুদ্ধার করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এত বড় একটি অভ্যুত্থান বিনা রুক্তপাতে দমন করা হলো।