সোমবার, ১৩ মে ২০১৩, ৩০ বৈশাখ ১৪২০
রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না
মুনতাসীর মামুন
॥ পঞ্চম কিস্তি ॥
লন্ড্রি থেকে কাপড়চোপড় এনে, খোশ দিলে বিরিয়ানি খেয়ে বাবুনগরী, জুনায়েদীরা গাড়ি করে দ্বিপ্রহরে শাপলা চত্বরে পৌঁছান। অন্যদিকে, এতিমখানা ও মাদ্রাসা থেকে, ঢাকা শহরে দেখানো, ক্ষমতায় গেলে তারা যা খুশি করতে পারবে, ইসলাম কায়েমের তারা হবে সেনানি- এসব প্রলোভন দেখিয়ে আনা তালেবএলেমরা রৌদ্র বৃষ্টি উপেক্ষা করে দীর্ঘ পথ হেঁটে শাপলা চত্বরে পৌঁছায়। গতবার তাদের জন্য বিরিয়ানি, ফল-মূল, পানি ছিল। এখন সে সব কিছু না দেখে তারা ক্ষুব্ধ হয়। বিরিয়ানি খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে বাবুনগরীরা তালেবএলেমদের শহীদ হওয়ার আহ্বান জানায় বার বার। নাস্তিক সরকারকে উৎখাত করে হয় তারা শহীদ হবে নয় গাজী হবে। একদিকে বাবুনগরীদের নির্দেশে শহরের একদিকে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছিল অন্যদিকে তারা প্রায় লাখখানেক লোক মজুদ রাখছিলেন রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে। কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, শহরের অন্যপ্রান্তে আমি রাত ৯টা পর্যন্ত ঘুরে দেখেছি, দোকানপাট খোলা, রাস্তাঘাটে মানুষজন, সব স্বাভাবিক। এর অর্থ কি এই যে, শহরের অনেকে এই সব নিয়ে চিন্তিত নন? পুরো বিষয়টিই কিন্তু কেমন অস্বাভাবিক ঠেকেছে।
সৈয়দ আশরাফের ঘোষণার পর সুর করে বাবুনগরীরা বলতে থাকেন, 'আশরাফ আগামীকাল কোন্ পথ দিয়ে পালাবে তা ঠিক করো।' হেজাবিরা তো নিশ্চিত যে, তারা ক্ষমতায় যাচ্ছে। তাই ক্ষমতার দম্ভে নানা ধরনের উপহাস করছিলেন। এবং বাচ্চা 'জেহাদী'দের উন্মত্ত করে গাছ কাটা, ফুটপাথ তুলে ফেলা, ল্যাম্পপোস্ট উপড়ে ফেলার কাজে লাগাচ্ছিলেন। খেলায় যাকে ওয়ার্ম আপ বলে সে রকমভাবে নিরাপত্তা রক্ষীদের বিরুদ্ধে 'লড়াই' করার জন্য তাদের প্রস্তুত করছিলেন।
পুলিশ হেজাবিদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং বিকেল পাঁচটার মধ্যে তাদের স্থান ত্যাগ করতে বলেছিলেন। এই শর্ত মেনে চুক্তিপত্র করেই হেজাবিরা সমাবেশ করছিলেন। যাঁরা কোরান পোড়ায় তাদের কাছে কথার বরখেলাপ কোন ব্যাপারই নয়। এবং ঠিকই দেখা গেল, হেজাবি নেতারা ঘোষণা করলেন, তাঁরা নড়বেন না। তাদের আল্লামা শফীর বক্তব্য না শুনে তারা নড়বেন না। আমরা যা অনুমান করছিলাম তাই ঠিক হলো। শুধু সমাবেশ নয়, তাঁরা চারদিকে তখনও আগুন লাগাচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেভাবে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল হেজাবিরাও তাই করেছিলেন। হেজাবিদের প্রায় সব নেতা ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। পোড়ামাটি নীতি তাঁরা সেখান থেকে শিখেছিলেন। সরকার হেজাবিদের ধমকির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপই নিতে পারছিল না। বাবুনগরীরা ক্ষমতা দখলে আস্থাবান ছিলেন একটি কারণেÑ তা'হলো, হাটহাজারী, লালবাগ ও লালখান বাজারে জঙ্গী ট্রেনিং দেয়া হয়। শাহরিয়ার কবিরের চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, আহমাদ শফী ও ইজহারুল ইসলাম জঙ্গী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আফগানিস্তানে বাংলাদেশী জঙ্গী পাঠিয়েছেন এবং সে জঙ্গী মারা গেলে তার নিঃস্ব পরিবারকে কোন সাহায্য করেননি।
হেফাজতের সেøাগানই বলে দেয় তারা কী চেয়েছিল। তারা তালেবানী রাষ্ট্র করবে, আহমাদ শফী হবেন যার প্রধান। এখন বাবুনগরীর কনফেশনে জানা যাচ্ছে, তাঁরা ঠিকই তালেবানী রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন যার প্রধানমন্ত্রী হবেন বাবুনগরী আর আধ্যাত্মিক গুরু আহমাদ শফী। [আমাদের সময়, ৮-৫-১৩]
ইরানের খোমেনী স্টাইলে আর কি! এখানেও আমরা ষড়যন্ত্রের মধ্যে ষড়যন্ত্র লক্ষ্য করি। খালেদা চাচ্ছিলেন জামায়াত-হেফাজতকে দিয়ে সরকার পতন ঘটিয়ে তিনি তখতে তাউসে বসবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আহমাদ শফীরা বিএনপিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছিলেনÑ যেখানে খালেদার স্থান নেই। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এমনই হয়। পরস্পর পরস্পরের পিঠে ছুরি মারে।
রাত আটটায় খালেদা ঢাকাবাসীকে জানালেন, হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে। ৪৮ ঘণ্টার মাথায় খালেদা এই ঘোষণা দিলেন। বোঝা গেল তাদের পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁরা পৌঁছেছেন। আহমাদ শফী গাড়ি করে রওনা হচ্ছিলেন ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিতে। তবে হেজাবি নেতাদের অনেকে মনে করছিলেন, তিনি হেজাবিদের ফিরে যেতেও বলতে পারেন। পথে আহমাদ শফীর মোবাইল ফোনে দু'টি ফোন আসে। তিনি ঘোষণা করেন, তিনি আর যাবেন না। এটিও প্রচারিত হয়ে পড়ে। কিন্তু, তিনি নির্দেশ দেন হেফাজতিরা যেন স্থান ত্যাগ না করে। দশটা-এগারোটার সময় দেখা গেল খালেদার নির্দেশ সত্ত্বেও মওদুদ, খোকা, আনোয়ার, দুদুরা খাবার, পানি নিয়ে নামছেন না। পরে ভাড়া করা জেহাদীদের কনফেশনে জানা গেছে, তারা প্রায় ২৪ ঘণ্টা অভুক্ত। পেশাব-পায়খানা করতে পারেননি। খাওয়ার পানিও পাননি। ঢাকার রাস্তাঘাট তাঁরা চেনেন না। বাতি নেই, অন্ধকার, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। অনেকে ভয়েও স্থান ত্যাগ করতে লাগলেন। স্বদেশ রায় রাত ১১টায় ফোন করে আমাকে জানালেন, পত্রিকার প্রবিবেদক জানিয়েছেন, সমাবেশ থেকে লোকজন চলে যাচ্ছে।
বাবুনগরীরা এবং হেজাবিরা ভেবেছিলেন, এই সমাবেশ ভঙ্গ করার সাহস কারও নেই। আর বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা যোগ দিলে তো কথাই নেই। সবই তো পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বড় বৈশিষ্ট্য অনিশ্চয়তা। এ কথা অনেকবার লিখেছি, ইতিহাসের পটভূমিকায় এই অনিশ্চয়তা বাঙালীকে অনেক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছে। এবারের অনিশ্চয়তা ছিল নিরাপত্তা বাহিনী সমাবেশ ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করবে কী করবে না। এক পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন, পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত এত বৃহৎ আকারের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার কোন পরিকল্পনা কখনও করা হয়নি। এটি ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ ধরনের পরিকল্পনা সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
মাঝরাতের পর অভিযান শুরু হয়। ১৫ মিনিটের মধ্যে শাপলাচত্বর মুক্ত। সবার আগে পালান বাবুনগরী, লতিফ নেজামী ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা। নিজের সাথীদের ফেলে এ ভাবে পলায়ন তাদের চরম স্বার্থপরতা তা তৃণমূল পর্যায়ের হেজাবিদের মনে রাখা উচিত। তাদের তো লড়াই করে শহীদ হওয়ার কথা। শহীদ না হয়ে পালালেন কেন? এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে জঙ্গীগুরু শাইখ আবদুর রহমানের কথা। জঙ্গী শাইখ ধরা পড়লে তাঁর স্ত্রী আর্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি তো শহীদ হবেন বলেছিলেন, তিনি তো শহীদ হলেন না!
তাঁরা তো লড়াই করে গাজী হবেন বলেছিলেন। কিন্তু লড়াই দূরের কথা, জলকামানের পানি, শব্দবহুল গ্রেনেড আর ফাঁকা রবার বুলেটেই শাপলা চত্বর খালি। একদল এক দৌড়ে যাত্রাবাড়ী হয়ে কাঁচপুরের পথে। বাকিরা এদিক-সেদিক গলি-ঘুপজি আর বিভিন্ন ভবনে। পরের এক চিত্রে দেখা যায়, কান ধরে একদল হেফাজতী বা হেজাবি বসে আছেন। তাঁরা শহীদও হননি। গাজীও হননি; বরং মানুষের কাছে পাজি হিসেবেই পরিচিত হয়েছেন। হেফাজতে শহীদ নয়, হেফাজতে গাজী নয়, এখন তারা হেফাজতে পাজি। (চলবে)
সোমবার, ১৩ মে ২০১৩, ৩০ বৈশাখ ১৪২
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2013-05-13&ni=135164
Also Read:
বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০১৩, ২৬ বৈশাখ ১৪২০
রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না - ॥ প্রথম কিস্তি ॥
মুনতাসীর মামুন
শুক্রবার, ১০ মে ২০১৩, ২৭ বৈশাখ ১৪২০
রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না - ॥ দ্বিতীয় কিস্তি ॥
মুনতাসীর মামুন
শনিবার, ১১ মে ২০১৩, ২৮ বৈশাখ ১৪২০
রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না ॥ তৃতীয় কিস্তি ॥
মুনতাসীর মামুন
শনিবার, ১১ মে ২০১৩, ২৮ বৈশাখ ১৪২০
রবিবার, ১২ মে ২০১৩, ২৯ বৈশাখ ১৪২০
রাজাকার, রাজাকারপন্থী, রাজাকারের বাচ্চাদের কর্তৃত্ব এ দেশে আর হবে না ॥ চতুর্থ কিস্তি ॥
মুনতাসীর মামুন
ويقترح رجل الله يتصرف [ Man proposes, Allah the Almighty disposes]
__._,_.___