এ ছাড়া বাবার জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েও এলাকায় তেমন কোনো উন্নয়ন কাজ তিনি করেননি বলে অভিযোগ করে সাধারণ মানুষ। তাই ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী আগামী নির্বাচনে ভোলা সদর আসন থেকে বিকল্প যোগ্য প্রার্থী খুঁজছে। ভোলা জেলা বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোট থেকে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে জেলা বিএনপির সভাপতিকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
বাবার জনপ্রিয়তায় ভর করে : স্থানীয় লোকজন জানায়, এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুর ভোলা সদর আসনের এমপি ও মন্ত্রী থাকাকালে জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর গত সংসদ নির্বাচনে ভোলা-১ আসন থেকে চারদলীয় জোটের মনোনয়ন চান তাঁর বড় ছেলে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। ওই সময়ে জোট থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতা সাবেক মন্ত্রী মরহুম মোশারেফ হোসেন শাজাহান মনোনয়ন না পাওয়ায় জেলা বিএনপি নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়। তারা হরতাল ও অবরোধ করে ভোলা অচল করে দেয়। বিএনপির বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে দাঁড়াতেই পারেনি পার্থর লোকজন। অবস্থা বেগতিক দেখে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপে এবং তাঁর নির্দেশেই পার্থর সঙ্গে স্থানীয় বিএনপির সমঝোতা হয় এবং বিএনপি নেতা-কর্মীরা পার্থর পক্ষেই নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। তবে এবার জোট থেকে মনোনয়ন পেলেও আর বিজেপি নেতা পার্থর পক্ষে বিএনপি নেতা-কর্মীরা নির্বাচন করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে জেলা বিএনপি। জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ গোলাম নবী আলমগীরকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার জন্য দলের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জোর দাবি জানিয়ে আসছে।
জনবিচ্ছিন্ন জনপ্রতিনিধি : এলাকার মানুষ এমপি পার্থকে এখন জনবিচ্ছিন্ন নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করছে। তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস আর সেখানে তাঁর বাবার গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করছেন। ভোলায় বিজেপির প্রভাবশালী নেতা অনুপম দে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের এমপি সাহেব ঢাকায় বসেই রাজনীতি করছেন। পার্থ একজন পটু রাজনীতিবিদ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঢাকায় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টকশোতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি এমপি ২৪ ঘণ্টাই রাজনীতি করছেন। আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করছেন তাঁর দুই ভাই আশিকুর রহমান শান্ত ও ওয়াশিকুর রহমান অঞ্জন।
তবে সাধারণ মানুষের মুখে অন্য কথা। ভোলা শহরের পুরনো যুগিরঘোল এলাকার ব্যবসায়ী ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চৌকিদারবাড়ির বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মজিবর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বিএনপি করি। গত নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়া ভোট করছিল, তাই পার্থকে ভোট দিছিলাম। কিন্তু হেইতে এমপি হওয়ার পর এলাকায়ই আইয়েন না।' তিনি আরো বলেন, 'আগামীতে যে-ই ধানের শীষ নিয়া ভোট করব হেরেই আমি ভোট দিমু।' সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাছ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন (৪৭) বলেন, 'আমাগো এলাকার চেয়ারম্যান অইলো সিরাজ। গত নির্বাচনে আমরা চেয়ারম্যানের কথায় পার্থরে ভোট দিছিলাম। কিন্তু পার্থ এমপি হওয়ার পর আর এলাকায়ই আইয়েন নাই।' তিনি আরো বলেন, 'ভোটের আগে পার্থ এলাকায় যহন আইছিল তহন আমরা কইছিলাম, আমাগো কালা গাজী হাওলাদার বাড়ির মসজিদের লইগ্যা সাহায্য করেন। হেইতে তহন কইছিল, মসজিদের ছাদ কইর্যা দিমু। এমপি হওয়ার পর তাঁর চেহারাও আর দেহি নাই। অথচ তোফায়েল নেতা আমাগো এলাকার এমপি না অইয়াও হেইতে কয়েক দিন আগে এলাকায় গিয়া আমাগো হেই মসজিদে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিছে। আগামী নির্বাচনে আমরা চিন্তাভাবনা কইর্যা ভোট দিমু।'
এলাকার এমপি কে জানতে চাইলে শহরের পৌর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চর জংলা এলাকার লাকড়ি ব্যবসায়ী মো. কাজল প্রথমে চিনতে পারেননি। 'নাজিউর রহমান মঞ্জুরের ছেলে পার্থকে চেনেন না?' প্রশ্ন করার পর একটু কষ্ট হলেও অবশেষে চিনতে পেরে তিনি উল্টো প্রশ্ন তোলেন, 'হেতো এলাকায়ই আইয়েন না। তাঁরে চিনমু কেমনে?'
শহরের কালীবাড়ি রোড এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, 'আমাগো এমপির এবার এলাকায় এসে ভোট চাওন লাগব না। তাঁরে টেলিভিশনেই ভোট দিয়া এমপি বানাইব।'
ক্ষুব্ধ দলীয় নেতা-কর্মীরাও : বিজেপির নেতা-কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে আগামীতে এ আসন থেকে এমপি হওয়া পার্থর জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। নিজ দলের এমপির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে গত মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ভোলা জেলা শাখা কার্যালয়ে বসে জাতীয় ওলামা পার্টি ভোলা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. সামছুদ্দিন বলেন, "গত নির্বাচনে এমপি হলেও পার্থ এখন আর এলাকায় তেমন আসেন না। এমনকি তিনি তাঁর নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ রাখছেন না। উনি এখন ঢাকায় বসে বিভিন্ন টেলিভিশনে 'টকশো' নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। পার্থর দলের অবস্থাও খুব নাজুক। দলের এমপি এলাকায় কখন আসেন আর কখন যান তা আমরা দলীয় নেতা হয়েও জানি না। আমি ঢাকায় এমপির বাসায় গিয়েও তাঁর দেখা পাই না।"
বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক নেই : পার্থর সঙ্গে জেলা বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানা গেছে। বরং এ সম্পর্ক এখন সাপে-নেউলে। জেলা বিএনপি আয়োজিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচিসহ কোনো কর্মসূচিতে পার্থ উপস্থিত থাকেন না। অনেক সময় তাঁকে আমন্ত্রণও জানানো হয় না। অন্যদিকে বিজেপির কোনো কর্মসূচিতেও জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা উপস্থিত থাকেন না। এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক মো. আকবর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ইলিশ মাছের সঙ্গে দায়ের যেমন সম্পর্ক, আন্দালিব রহমান পার্থর সঙ্গে এখন জেলা বিএনপির ঠিক তেমনি সম্পর্ক। তিনি আরো বলেন, আগামী নির্বাচনে ১৮ দলের জোট থেকে পার্থকে মনোনয়ন দিলে তিনি জামানত হারাবেন_এটা শতভাগ নিশ্চিত। আর জোট থেকে মনোনয়ন পেলেও জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা আগামীতে আর তাঁকে সমর্থন দেবে না। কারণ ভোলা বিএনপির দাবি, এবার জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ গোলাম নবী আলমগীর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট থেকে মনোনয়ন চাইবেন এবং তাঁর পক্ষেই দলের নেতা-কর্মীরা কাজ করবে।
নামসর্বস্ব দল : বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) একটি নামসর্বস্ব দল হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। ভোলা শহরের নতুন বাজার চত্বরে এ দলের একটি কার্যালয় থাকলেও জেলার অন্য উপজেলায় কিংবা বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলায় দলীয় কার্যালয় নেই। এ দলের সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডও চোখে পড়ে না। পার্থর দুই ভাই শান্ত ও অঞ্জন এ দলের ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা। দলীয় নেতা-কর্মীরাও এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, জাতীয় ওলামা পার্টি ভোলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দিন বলেন, বিজেপির কোনো কর্মকাণ্ড নেই। সদর উপজেলায় দলের কয়েকটি পকেট কমিটি হলেও বাকি ছয় উপজেলায় কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি।
এ ব্যাপারে বক্তব্যের জন্য বিজেপি ভোলা জেলা শাখার সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
ভোলা বিএনপির ভাষ্য : ভোলা জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ গোলাম নবী আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ঐক্য শক্তিশালী। ভোলা জেলায়ও বিএনপি অনেক শক্তিশালী। ভোলা সদর আসনে বহু বছর ধরেই যোগ্য ও গণমানুষের নেতা সাবেক মন্ত্রী মরহুম মোশারেফ হোসেন শাজাহান এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। গত নির্বাচনে একটি মহলের চক্রান্তের কারণে তিনি মনোনয়ন পাননি। তাই ওই সময়ে বিজেপির নেতা আন্দালিব রহমান পার্থকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার আর সেই চক্রান্তের ফাঁদে পা দেবে না ভোলা জেলা বিএনপি। এবারও যদি পার্থকে জোট থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলে আগামী দিনে ভোলায় কঠিন অবস্থা হবে। বিজেপি জোটের শরিক দল হলেও ভোলায় এ দলের কোনো অস্তিত্ব নেই উল্লেখ করে বিএনপি সভাপতি বলেন, 'দেশের অন্য কোথায়ও এ দলের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে আমার জানা নেই। সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনেও এ দলের নেতা-কর্মীদের মাঠে পাওয়া যায় না।'
পার্থকে জনবিচ্ছিন্ন নেতা উল্লেখ করে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. ফারুক মিয়া বলেন, যে আসনে বিএনপির তেমন শক্তিশালী প্রার্থী নেই, সাধারণত সে আসনে জামায়াতে ইসলামী কিংবা জোটের অন্য শরিক দলের প্রার্থীকে জোট থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু আগামী নির্বাচনে ভোলা সদর আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ গোলাম নবী আলমগীর বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী। বিএনপির জন্য নিবেদিত এ নেতা দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে ভোলা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ইতিমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাই আগামীতে তাঁকে ছাড়া অন্য দলের কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে তা বিএনপি মেনে নেবে না।
পার্থ বলেন : এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি জনবিচ্ছিন্ন নেতা নই। এলাকার মানুষের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ আছে আমার। আমি আমি প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে ভোলায় আসি। প্রতিটি ঈদ ভোলায় কাটাই। বিএনপির একটি পক্ষ ভোলা-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে চায়। ওই পক্ষই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।' তিনি বলেন, 'বিরোধী দলের নেতা ও এমপি হিসেবে এলাকায় কাজ করার সুযোগ খুবই কম। যদি কখনো সরকারি দলের এমপি হই তাহলে ভোলাকে স্বপ্নের শহর বানাব।' পার্থ আরো বলেন, 'এই সরকারের আমলে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ কোটি টাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিয়ে গেছে। মাত্র দুই কোটি টাকার কাজ করতে পেরেছি। আমার দলের নেতা-কর্মীদের জিআর, টিআর, কাবিখার কাজ দিতে পারছি না বলেই তারা আমার ওপর হয়তো ক্ষুব্ধ। তবে দুর্নীতির ব্যাপারে আমার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারবে না।'
__._,_.___