অবশেষে সত্যের জয় তাহের হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ডের বিচার ন্যায় ও সত্যের পতাকাকেই শুধু যে উড্ডীন করেছে তাই নয়, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা সৃজনেও তার অবদান অপরিসীম সমস্ত অন্যায়, অবিচার আর বিভ্রান্তির কালোমেঘ ফুঁড়ে অবশেষে সত্যের প্রদীপ্ত সূর্য ঝলমল আলো ছড়াল জাতির আকাশে। সকল প্রকার গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার, ইতিহাসকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অন্ধকার বৃত্তে আটকে রাখার পৌনঃপুনিক সব অপচেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে ন্যায়বিচারের কাছে। জাতির জনকের খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে; জেলহত্যার ন্যায়বিচারও পেয়েছে জাতি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চলছে। এসবই জাতির কলঙ্কমুক্তির এক-একটি যুগান্তকারী পর্যায়; ইতিহাসের ইতিবাচক পালাবদলের অনুষঙ্গ। এরই ধারাবাহিকতায় আরও একটি অবধারিত সত্যের মীমাংসা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরের মৃত্যুদ-ের রায়কে ঘিরে। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই সামরিক আদালতের এক প্রহসনের বিচারে দ-িত করে মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সেনানী কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। ঐ সময় সেই আইনে মৃত্যুদ-ের বিধান না থাকলেও সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়, যা কার্যকর করা হয় ২১ জুলাই, ১৯৭৬। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০১০ সালে পরিবারের পক্ষ থেকে এই অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হয়। সমস্ত আইনী প্রক্রিয়া শেষে সামরিক আদালতের বিচারের রায়কে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১১ সালের ২২ মার্চ হাইকোর্ট রায় দেয়। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন সোমবার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা ও রায়ে স্বাক্ষর করেন। উচ্চ আদালতের এই রায় প্রমাণ করল যে, ইতিহাসের সত্য অনিবার্য; সেই সত্যের গতিধারাকে কখনও রুদ্ধ করা যায় না বা তার গতিপথ ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন করা যায় না। রায়ে বলা হয়েছে, 'কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- একটি হত্যাকা-, কারণ ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- প্রদানের বিষয়ে মনস্থির করেন।' রায়ের এই ছোট্ট অংশটির মাধ্যমে এক অস্থির, অরাজক ও বৈরী সময়ের ভয়াবহ আভাস ফুটে উঠেছে। বস্তুত, কর্নেল তাহেরের প্রহসনের বিচার এবং অবৈধভাবে মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের একশ্রেণীর ক্ষমতালোভী সামরিক ব্যক্তির কুটিল ষড়যন্ত্র আর অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখলের হীন অভিলাষেরই বহির্প্রকাশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যার যাত্রা শুরু এবং জেলহত্যাকা- যার আরেকটি ধাপ। ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বরের ঘটনার পর বিপদাপন্ন জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন কর্নেল তাহের। সময়ের বিবর্তনে, পরিস্থিতির পরিবর্তনে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সেই জিয়াউর রহমানের ইচ্ছাতেই সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারে ফাঁসি হয় তাহেরের। বিচারক যেমনটি বলেছেন: সেই বিচার ছিল প্রভুদের কণ্ঠস্বর। উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াই সে সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ-মু-ের কর্তা। ইতিহাসের কী অমোঘ নিয়তি, জিয়াউর রহমান '৮১ সালে চট্টগ্রামে নিহত হন সেনা সদস্যদের হাতে। হত্যা কেবল হত্যাকেই আবাহন করে এবং তার পুনরাবৃত্তি কখনও রোধ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- দিয়ে এদেশে যে হত্যার রাজনীতি, সামরিকতন্ত্র ও অনিয়মতান্ত্রিকতার উত্থান শুরু হয়েছিল, তা গণতন্ত্রের ভিতকে তছনছ করে দেয়Ñ যার অবশেষ এখনও নানাভাবে ক্রিয়াশীল। তাহের হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন হত্যাকা-ের বিচার ন্যায় ও সত্যের পতাকাকেই শুধু যে উড্ডীন করেছে তাই নয়, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা সৃজনেও তার অবদান অপরিসীম। হত্যা, ক্যু কিংবা অসাংবিধানিক পন্থায় যারা ক্ষমতা দখল করতে চায়, এসব বিচার তাদের জন্য এক সতর্কসঙ্কেত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা ইতিহাসের এসব নির্মম সত্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে তা হবে সবার জন্য মঙ্গলজনক। |