আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী test@gmail.com |
চায়ের পেয়ালায় তুফান
31 July 2013, Wednesday
মাছের শরীরে যেমন পচন ধরে মাথা থেকে, তেমনি কোন মানব সমাজে পচন ধরলে তার শুরুও মাথা থেকে। অর্থাৎ সমাজের মাথাওয়ালা শ্রেণী- শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী (রাজনীতিকসহ) বলে যা দেয় আমরা জানি সেই শ্রেণী থেকে। বাংলাদেশে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কিছুকাল যাবত বাংলাদেশে যা চলছে, তাতে এই মনীষী বাক্যটির সত্যতা প্রমাণিত হয়। গত কিছুদিন ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য আমি ঢাকায় বাংলা কাগজগুলোতে নিয়মিত কলাম লিখিনি। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সজীব জয়ের একটি মামুলি বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে, বিগ মিডিয়াতেও কী তুলকালাম চলছে।
সুবিধাবাদী এলিট ক্লাসের মুখপাত্র ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামতো স্বনামে দুই নেত্রীর ছেলে জয় ও তারেকের রাজনীতিতে পদার্পণ সম্পর্কে মঙ্গলবার ৩০ জুলাইয়ের কাগজে এক নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন লিখে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে গণকঠাকুর সেজে বসে আছেন। জয়ের বক্তব্য নিয়ে বিএনপি-জামায়াত মহলেই শোরগোল বেশি। এ কথা অস্বীকার করব না, গলাবাজির রাজনীতিতে বিএনপি অদ্বিতীয়। আওয়ামী লীগও এবার তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে।
কী বলেছেনÑ সজীব জয়, যা নিয়ে এত হৈচৈ? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দু'পক্ষ থেকেই তার এত ব্যাখ্যা, পাল্টা ব্যাখ্যা? এর কি কোন প্রয়োজন ছিল, না আছে? ঢাকায় যুবলীগের সভায় জয় বলেছেন, 'আমার কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতবে।' সজীব জয় আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের কেউ নন। সাধারণ সদস্য কি না তাও জানি না। তাঁর মাতা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই মায়ের পক্ষ থেকেও যুবলীগের সভায় বক্তব্য তিনি রাখেননি। বলেছেন, তাঁর কাছে তথ্য আছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে।
ব্যক্তিগতভাবে এমন দাবি যে কেউ করতে পারেন। জয় এক্ষেত্রে তাঁর কাছে তথ্য আছে বলেছেন। মিডিয়া তাঁর কাছে জানতে চাইতে পারত, তার এই তথ্য এবং তথ্যের উৎস কী? তিনি তা জানাতে না পারলে বা জানাতে না চাইলে এটাকে বালোকোচিত উক্তি বলে উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু 'আমার কাছে তথ্য আছে' জয়ের এই কথার মধ্যে বিএনপির নেতারা এবং তাদের সমর্থক একশ্রেণীর মিডিয়া ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন এবং বেসামালভাবে হৈচৈ শুরু করেছেন।
কথায় বলে জন্ডিস রোগী তার হলুদ চোখে সারা পৃথিবীকে হলুদ রঙের দেখে। যে রাজনৈতিক দলটির জন্ম ষড়যন্ত্রের শিবিরে; যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেশে হত্যার রাজনীতির প্রবর্তক; যার পুত্র হাওয়া ভবনের প্রতিষ্ঠা থেকে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র চালান মামলা প্রভৃতি অসংখ্য দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত, আদালতে যে অভিযোগগুলো তিনি মোকাবেলা করতে না পেরে বিদেশে পালিয়ে আছেন এবং নানা ধরনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সেই দল কথায় কথায় আওয়ামী লীগের প্রতিটি কথায় ও কাজে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে?
তবে বিএনপি তার গলাবাজি দ্বারা একটি সাফল্য অর্জন করেছে। সজীব জয়ের উক্তিটিকে নিয়ে অনাবশ্যক এবং অতিরিক্ত শোরগোল তুলে তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের এই বিতর্কে জড়াতে পেরেছেন। ফলে এমন একটি নন ইস্যু, রাজনৈতিক মহলে এবং প্রচারমাধ্যমে একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিতর্কের মুনাফাটা যাচ্ছে বিএনপির ঘরে। আওয়ামী লীগও অহেতুক জয়কে বিতর্কে জড়াচ্ছেন। বিএনপি উদ্দেশ্যমূলকভাবে জয়ের উক্তির যে অপব্যাখ্যা দিচ্ছে, আওয়ামী লীগের কি উচিত ছিল, সেই অপব্যাখ্যায় জবাব দেয়ার জন্য পাল্টা ব্যাখ্যা দেয়ার এবং বাজার আরও গরম করার? এমনকি এই পাল্টা ব্যাখ্যায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও টেনে আনার?
সজীব জয়কে আমি যতটুকু জানি, তিনি একজন শিক্ষিত সজ্জন যুবক। মা প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তারেক রহমানের মতো হাওয়া ভবনের ন্যায় দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের আস্তাবল তৈরি করার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। পিতার মতোই জয় একজন টেকনোক্র্যাট। রাজনীতিতে পরিপক্বতা নেই। মাকে প্রয়োজনে পরামর্শ দেয়া ছাড়া রাজনীতিতে মাথা গলান না। তারেক রহমানের মতো তাঁর কোন পারিষদ দল নেই, যাদের ভয়াবহ দুষ্টচক্র আখ্যা দেয়া যেতে পারে।
মা খালেদা দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সুতরাং পুত্র তারেকের দাপট কতটা বেড়েছিল তার একটা সামান্য উদাহরণ দিচ্ছি। এর চাইতে বড় উদাহরণও আছে। তারেক রহমানের এক পেয়ারের দোস্তের নাম মামুন। যার দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এখন লোকের মুখে মুখে। এই মামুন এখন জেলে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই মামুন একদিন গাড়ি হাঁকিয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনজন এমপি (মিলিটারি পুলিশ) তাঁকে দেখে স্যালুট দেয়নি। মামুন গাড়ি থামিয়ে তাদের স্যালুট দেয়ার হুকুম দেন। এমপিরা বলেন, তারা সামরিক ও অসামরিক অফিসারদের স্যালুট দিতে পারেন। কোন বেসরকারী ব্যক্তিকে নয়। মামুন তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে চলে যান এবং বিষয়টি তারেক রহমানকে জানান। তিনজন এমপিকেই তখন বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এর চাইতেও আরও বড় উদাহরণ আছে। লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। লেখাপড়ায় ঢু ঢু, এই তারেক রহমান এখন অসংখ্য দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলা মাথায় নিয়ে লন্ডনে রাজার হালে বাস করছেন এবং দলীয় রাজনীতি করছেন। তাঁর 'রাজনৈতিক দর্শন' নিয়ে বাংলাদেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বই লিখেছেন এবং সেই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করা হয় তারেক রহমানের উপস্থিতিতে অক্সফোর্ডে। এসব দেখে প্রাচীন কবির কবিতা মনে পড়ে, 'বানরে সঙ্গীত গায়, শিলা জলে ভেসে যায়/দেখিলেও না হয় প্রত্যয়।'
বাংলাদেশের এই দুষ্ট গ্রহটির কথা রেখে সজীব জয়ের কথায় ফিরে আসি। আগেই বলেছি, আমার বিবেচনায় জয়ের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতা কম। নিজেও বিদেশে থাকেন। রাজনৈতিক কূটকৌশল তিনি জানেন না। রাজনৈতিক কথা গুছিয়ে বলাও রপ্ত করেননি। যুবলীগের সভায় তাঁর বিতর্কিত উক্তিটিই তার প্রমাণ। এই সামান্য কথা নিয়ে যে চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলা হয়েছে, তার আসল উদ্দেশ্য জয়কে রাজনীতিতে নামার আগেই বিতর্কিত ও নিন্দিত করা।
তারেক রহমানের যত সন্ত্রাস ও দুর্নীতি, তার কোনটাই সজীব জয়ের বিরুদ্ধে তোলা যাচ্ছে না। একবার তোলার চেষ্টা করেছিল বিএনপি। তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন চলছে তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা। মাত্র কিছুদিন আগেই তাঁর দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে মিথ্যা, কুৎসা রটনা করা হয়েছে। এ ধরনের জঘন্য কুৎসা রটনা একমাত্র বিএনপির মতো দলের নেতাদের পক্ষেই সম্ভব। কোন ভদ্র ও শিক্ষিত নেতা বা দলের পক্ষে সম্ভব নয়, জয়কে বিতর্কিত ও লোকচক্ষে হেয় করতে পারলে বিএনপিসহ অশুভ চক্রগুলোর ধারণা, শেখ হাসিনার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ পরিবারের লেগাসি বহনকারী আর কেউ থাকবে না। এখনও শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের লড়তে হচ্ছে। সজীব জয়কে রাজনীতি থেকে সরাতে পারলে অথবা জয় রাজনীতিতে না এলে তাদের আর পায় কে?
এই চক্রান্ত ব্যর্থ করার জন্যই জয় রাজনীতিতে আসুন আর না আসুন, তাঁর রাজনৈতিক কথাবার্তা বলার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। আমি তাকে উপদেশ দিচ্ছি না, একজন প্রবীণ রাজনৈতিক কলামিস্টের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, 'আমার কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতবে' এ কথা সরাসরি না বলে তাঁর বলা উচিত ছিল, এ পর্যন্ত যত তথ্য-উপাত্ত আমি জেনেছি, তাতে মনে হয় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। এ কথা বলা হলেও বিএনপির নেতা-নেত্রীরা তাদের অভ্যাস অনুযায়ী চিৎকার জুড়তো; কিন্তু আওয়ামী লীগকে তার বক্তব্যের পাল্টা ব্যাখ্যা নিয়ে বাজারে নেমে পানি আরও ঘোলা করতে হতো না।
সজীব জয়ের বক্তব্যের অপব্যাখ্যার জবাব তিনি নিজেই দিতে পারতেন। এখন দাবি করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা আগামী নির্বাচন সম্পর্কিত একটি জরিপ করিয়ে তাতে নির্বাচন জয় সম্পর্কিত তথ্যটি পেয়েছে। এই জরিপের ফল তারা প্রকাশ করেননি। জয় এই জরিপের তথ্য জেনে তাঁর বিতর্কিত উক্তিটি করে থাকলে এই জরিপের ফল এখন প্রকাশ করা উচিত, অথবা সজীব জয়ই এই জরিপের ফল প্রকাশ করে দৃঢ়ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন। এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের একের পর এক সজীব জয়কে সমর্থন দানের নামে পরস্পরবিরোধী উক্তি করার কোন দরকার ছিল না এবং এখনও নেই।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যেখানে বলেন, আওয়ামী লীগ যে আগামী নির্বাচনে জয়ী হবে সে সম্পর্কে তাঁর কাছে তথ্য (নির্বাচন সংক্রান্ত জরিপের ফল) আছে; সেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, 'আমার কাছে কোন তথ্য নেই, তবে গন্ধ পাচ্ছি আওয়ামী লীগ জয়ী হবে।' তাঁর উক্তি শুনে লন্ডনের এক ইফতার পার্টিতে বিএনপির এক সমর্থক বলেছেন, তাঁর নাকে অন্য গন্ধের বদলে নির্বাচন জয়ের গন্ধ কী করে ঢুকল?
সজীব জয়ের উক্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ডিফেনসিভ। বিএনপির ভূমিকা অফেনসিভ। অনবরত ডিফেনসিভ খেলা খেলে আওয়ামী লীগ বিএনপির আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে না। একশ্রেণীর মন্ত্রী দ্বারা জয়ের জন্য ডিফেন্স পার্টি গঠন করেও লাভ হবে না। তারা পরস্পরবিরোধী উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। তারা মুখ বন্ধ করলেই মাত্র বিতর্কটির উপশম হবে। বিএনপি এই বিতর্ক থেকে কোন সুবিধা লুটতে পারবে না।
ঢাকায় যুবলীগের সভায় সজীব জয় এমন কোন অন্যায় কথা বলেননি যে, তার জন্য অঘোষিত ডিফেন্স কমিটি খাড়া করতে হবে এবং তারা পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলে বিতর্কটি থেকে ফায়দা লোটার জন্য বিএনপিকে আরও সুবিধা করে দেবেন। এর প্রতিকার নির্বাচনের ফল সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা যে জরিপের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন অথবা তাদের নিজস্ব কোন জরিপের ফল হাতে থাকলে সেটি প্রকাশ করা এবং প্রমাণ করা সজীব জয় কোন মনগড়া তথ্যের ভিত্তিতে কথাটা বলেননি।
আর এ ধরনের কোন জরিপের রিপোর্ট সজীব জয়ের জানা না থাকলে এবং আবেগের বশে তিনি কথাটা বলে থাকলে বিনা দ্বিধায় তিনি বলতে পারেন, এটা তার সিøপ অব টাংÑ বা মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। সেজন্যে তাঁর লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। এই ধরনের সিøপ অব টাং চার্চিল, গান্ধী, জিন্নার মতো নেতাদেরও ঘটেছে। জয় তো তাদের মতো বাগ্মী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিকও নন।
তারেক রহমানের চাইতে অনেক উন্নত ও শিক্ষিত মানসিকতার পরিচয় সজীব জয়কে দিতে হবে। তিনি যদি রাজনীতি করতে চান রাজনীতির ভাষাও তাকে শিখতে হবে। কেবল মেধা ও প্রতিভা দ্বারা রাজনীতিতে সাফল্য অর্জন করা যায় না।
সুবিধাবাদী এলিট ক্লাসের মুখপাত্র ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামতো স্বনামে দুই নেত্রীর ছেলে জয় ও তারেকের রাজনীতিতে পদার্পণ সম্পর্কে মঙ্গলবার ৩০ জুলাইয়ের কাগজে এক নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন লিখে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে গণকঠাকুর সেজে বসে আছেন। জয়ের বক্তব্য নিয়ে বিএনপি-জামায়াত মহলেই শোরগোল বেশি। এ কথা অস্বীকার করব না, গলাবাজির রাজনীতিতে বিএনপি অদ্বিতীয়। আওয়ামী লীগও এবার তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে।
কী বলেছেনÑ সজীব জয়, যা নিয়ে এত হৈচৈ? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দু'পক্ষ থেকেই তার এত ব্যাখ্যা, পাল্টা ব্যাখ্যা? এর কি কোন প্রয়োজন ছিল, না আছে? ঢাকায় যুবলীগের সভায় জয় বলেছেন, 'আমার কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতবে।' সজীব জয় আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের কেউ নন। সাধারণ সদস্য কি না তাও জানি না। তাঁর মাতা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই মায়ের পক্ষ থেকেও যুবলীগের সভায় বক্তব্য তিনি রাখেননি। বলেছেন, তাঁর কাছে তথ্য আছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে।
ব্যক্তিগতভাবে এমন দাবি যে কেউ করতে পারেন। জয় এক্ষেত্রে তাঁর কাছে তথ্য আছে বলেছেন। মিডিয়া তাঁর কাছে জানতে চাইতে পারত, তার এই তথ্য এবং তথ্যের উৎস কী? তিনি তা জানাতে না পারলে বা জানাতে না চাইলে এটাকে বালোকোচিত উক্তি বলে উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু 'আমার কাছে তথ্য আছে' জয়ের এই কথার মধ্যে বিএনপির নেতারা এবং তাদের সমর্থক একশ্রেণীর মিডিয়া ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন এবং বেসামালভাবে হৈচৈ শুরু করেছেন।
কথায় বলে জন্ডিস রোগী তার হলুদ চোখে সারা পৃথিবীকে হলুদ রঙের দেখে। যে রাজনৈতিক দলটির জন্ম ষড়যন্ত্রের শিবিরে; যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেশে হত্যার রাজনীতির প্রবর্তক; যার পুত্র হাওয়া ভবনের প্রতিষ্ঠা থেকে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র চালান মামলা প্রভৃতি অসংখ্য দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত, আদালতে যে অভিযোগগুলো তিনি মোকাবেলা করতে না পেরে বিদেশে পালিয়ে আছেন এবং নানা ধরনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সেই দল কথায় কথায় আওয়ামী লীগের প্রতিটি কথায় ও কাজে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে?
তবে বিএনপি তার গলাবাজি দ্বারা একটি সাফল্য অর্জন করেছে। সজীব জয়ের উক্তিটিকে নিয়ে অনাবশ্যক এবং অতিরিক্ত শোরগোল তুলে তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের এই বিতর্কে জড়াতে পেরেছেন। ফলে এমন একটি নন ইস্যু, রাজনৈতিক মহলে এবং প্রচারমাধ্যমে একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিতর্কের মুনাফাটা যাচ্ছে বিএনপির ঘরে। আওয়ামী লীগও অহেতুক জয়কে বিতর্কে জড়াচ্ছেন। বিএনপি উদ্দেশ্যমূলকভাবে জয়ের উক্তির যে অপব্যাখ্যা দিচ্ছে, আওয়ামী লীগের কি উচিত ছিল, সেই অপব্যাখ্যায় জবাব দেয়ার জন্য পাল্টা ব্যাখ্যা দেয়ার এবং বাজার আরও গরম করার? এমনকি এই পাল্টা ব্যাখ্যায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও টেনে আনার?
সজীব জয়কে আমি যতটুকু জানি, তিনি একজন শিক্ষিত সজ্জন যুবক। মা প্রধানমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তারেক রহমানের মতো হাওয়া ভবনের ন্যায় দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের আস্তাবল তৈরি করার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। পিতার মতোই জয় একজন টেকনোক্র্যাট। রাজনীতিতে পরিপক্বতা নেই। মাকে প্রয়োজনে পরামর্শ দেয়া ছাড়া রাজনীতিতে মাথা গলান না। তারেক রহমানের মতো তাঁর কোন পারিষদ দল নেই, যাদের ভয়াবহ দুষ্টচক্র আখ্যা দেয়া যেতে পারে।
মা খালেদা দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সুতরাং পুত্র তারেকের দাপট কতটা বেড়েছিল তার একটা সামান্য উদাহরণ দিচ্ছি। এর চাইতে বড় উদাহরণও আছে। তারেক রহমানের এক পেয়ারের দোস্তের নাম মামুন। যার দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এখন লোকের মুখে মুখে। এই মামুন এখন জেলে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই মামুন একদিন গাড়ি হাঁকিয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনজন এমপি (মিলিটারি পুলিশ) তাঁকে দেখে স্যালুট দেয়নি। মামুন গাড়ি থামিয়ে তাদের স্যালুট দেয়ার হুকুম দেন। এমপিরা বলেন, তারা সামরিক ও অসামরিক অফিসারদের স্যালুট দিতে পারেন। কোন বেসরকারী ব্যক্তিকে নয়। মামুন তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে চলে যান এবং বিষয়টি তারেক রহমানকে জানান। তিনজন এমপিকেই তখন বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এর চাইতেও আরও বড় উদাহরণ আছে। লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। লেখাপড়ায় ঢু ঢু, এই তারেক রহমান এখন অসংখ্য দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলা মাথায় নিয়ে লন্ডনে রাজার হালে বাস করছেন এবং দলীয় রাজনীতি করছেন। তাঁর 'রাজনৈতিক দর্শন' নিয়ে বাংলাদেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বই লিখেছেন এবং সেই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করা হয় তারেক রহমানের উপস্থিতিতে অক্সফোর্ডে। এসব দেখে প্রাচীন কবির কবিতা মনে পড়ে, 'বানরে সঙ্গীত গায়, শিলা জলে ভেসে যায়/দেখিলেও না হয় প্রত্যয়।'
বাংলাদেশের এই দুষ্ট গ্রহটির কথা রেখে সজীব জয়ের কথায় ফিরে আসি। আগেই বলেছি, আমার বিবেচনায় জয়ের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতা কম। নিজেও বিদেশে থাকেন। রাজনৈতিক কূটকৌশল তিনি জানেন না। রাজনৈতিক কথা গুছিয়ে বলাও রপ্ত করেননি। যুবলীগের সভায় তাঁর বিতর্কিত উক্তিটিই তার প্রমাণ। এই সামান্য কথা নিয়ে যে চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলা হয়েছে, তার আসল উদ্দেশ্য জয়কে রাজনীতিতে নামার আগেই বিতর্কিত ও নিন্দিত করা।
তারেক রহমানের যত সন্ত্রাস ও দুর্নীতি, তার কোনটাই সজীব জয়ের বিরুদ্ধে তোলা যাচ্ছে না। একবার তোলার চেষ্টা করেছিল বিএনপি। তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন চলছে তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা। মাত্র কিছুদিন আগেই তাঁর দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে মিথ্যা, কুৎসা রটনা করা হয়েছে। এ ধরনের জঘন্য কুৎসা রটনা একমাত্র বিএনপির মতো দলের নেতাদের পক্ষেই সম্ভব। কোন ভদ্র ও শিক্ষিত নেতা বা দলের পক্ষে সম্ভব নয়, জয়কে বিতর্কিত ও লোকচক্ষে হেয় করতে পারলে বিএনপিসহ অশুভ চক্রগুলোর ধারণা, শেখ হাসিনার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ পরিবারের লেগাসি বহনকারী আর কেউ থাকবে না। এখনও শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের লড়তে হচ্ছে। সজীব জয়কে রাজনীতি থেকে সরাতে পারলে অথবা জয় রাজনীতিতে না এলে তাদের আর পায় কে?
এই চক্রান্ত ব্যর্থ করার জন্যই জয় রাজনীতিতে আসুন আর না আসুন, তাঁর রাজনৈতিক কথাবার্তা বলার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। আমি তাকে উপদেশ দিচ্ছি না, একজন প্রবীণ রাজনৈতিক কলামিস্টের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, 'আমার কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতবে' এ কথা সরাসরি না বলে তাঁর বলা উচিত ছিল, এ পর্যন্ত যত তথ্য-উপাত্ত আমি জেনেছি, তাতে মনে হয় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। এ কথা বলা হলেও বিএনপির নেতা-নেত্রীরা তাদের অভ্যাস অনুযায়ী চিৎকার জুড়তো; কিন্তু আওয়ামী লীগকে তার বক্তব্যের পাল্টা ব্যাখ্যা নিয়ে বাজারে নেমে পানি আরও ঘোলা করতে হতো না।
সজীব জয়ের বক্তব্যের অপব্যাখ্যার জবাব তিনি নিজেই দিতে পারতেন। এখন দাবি করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা আগামী নির্বাচন সম্পর্কিত একটি জরিপ করিয়ে তাতে নির্বাচন জয় সম্পর্কিত তথ্যটি পেয়েছে। এই জরিপের ফল তারা প্রকাশ করেননি। জয় এই জরিপের তথ্য জেনে তাঁর বিতর্কিত উক্তিটি করে থাকলে এই জরিপের ফল এখন প্রকাশ করা উচিত, অথবা সজীব জয়ই এই জরিপের ফল প্রকাশ করে দৃঢ়ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন। এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের একের পর এক সজীব জয়কে সমর্থন দানের নামে পরস্পরবিরোধী উক্তি করার কোন দরকার ছিল না এবং এখনও নেই।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যেখানে বলেন, আওয়ামী লীগ যে আগামী নির্বাচনে জয়ী হবে সে সম্পর্কে তাঁর কাছে তথ্য (নির্বাচন সংক্রান্ত জরিপের ফল) আছে; সেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, 'আমার কাছে কোন তথ্য নেই, তবে গন্ধ পাচ্ছি আওয়ামী লীগ জয়ী হবে।' তাঁর উক্তি শুনে লন্ডনের এক ইফতার পার্টিতে বিএনপির এক সমর্থক বলেছেন, তাঁর নাকে অন্য গন্ধের বদলে নির্বাচন জয়ের গন্ধ কী করে ঢুকল?
সজীব জয়ের উক্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ডিফেনসিভ। বিএনপির ভূমিকা অফেনসিভ। অনবরত ডিফেনসিভ খেলা খেলে আওয়ামী লীগ বিএনপির আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে না। একশ্রেণীর মন্ত্রী দ্বারা জয়ের জন্য ডিফেন্স পার্টি গঠন করেও লাভ হবে না। তারা পরস্পরবিরোধী উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। তারা মুখ বন্ধ করলেই মাত্র বিতর্কটির উপশম হবে। বিএনপি এই বিতর্ক থেকে কোন সুবিধা লুটতে পারবে না।
ঢাকায় যুবলীগের সভায় সজীব জয় এমন কোন অন্যায় কথা বলেননি যে, তার জন্য অঘোষিত ডিফেন্স কমিটি খাড়া করতে হবে এবং তারা পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলে বিতর্কটি থেকে ফায়দা লোটার জন্য বিএনপিকে আরও সুবিধা করে দেবেন। এর প্রতিকার নির্বাচনের ফল সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা যে জরিপের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন অথবা তাদের নিজস্ব কোন জরিপের ফল হাতে থাকলে সেটি প্রকাশ করা এবং প্রমাণ করা সজীব জয় কোন মনগড়া তথ্যের ভিত্তিতে কথাটা বলেননি।
আর এ ধরনের কোন জরিপের রিপোর্ট সজীব জয়ের জানা না থাকলে এবং আবেগের বশে তিনি কথাটা বলে থাকলে বিনা দ্বিধায় তিনি বলতে পারেন, এটা তার সিøপ অব টাংÑ বা মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। সেজন্যে তাঁর লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। এই ধরনের সিøপ অব টাং চার্চিল, গান্ধী, জিন্নার মতো নেতাদেরও ঘটেছে। জয় তো তাদের মতো বাগ্মী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিকও নন।
তারেক রহমানের চাইতে অনেক উন্নত ও শিক্ষিত মানসিকতার পরিচয় সজীব জয়কে দিতে হবে। তিনি যদি রাজনীতি করতে চান রাজনীতির ভাষাও তাকে শিখতে হবে। কেবল মেধা ও প্রতিভা দ্বারা রাজনীতিতে সাফল্য অর্জন করা যায় না।
উৎসঃ জনকন্ঠ
__._,_.___