নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশি হাইকমিশনার
মৃনাল হাসান
আমেরিকা নরেন্দ্র মোদীকে তাদের দেশে যেতে ভিসা দেয়নি। কারণ তার হাতে রক্ত, সংখ্যালঘু মুসলিমদের রক্ত। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, 'আমি নরেন্দ্র মোদীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই না।'
২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উগ্রবাদী হিন্দুরা প্রায় দুই হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। গুজরাট বিধানসভার সাবেক সদস্য ও কংগ্রেস নেতা এহসান জাফরিও ওই দাঙ্গায় নির্মমভাবে নিহত হন। মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওই দাঙ্গায় তিনি উগ্র হিন্দুদের মদদ দিয়েছিলেন এবং ওই সময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় দাঙ্গা প্রতিরোধে কার্যকারি কোনো ব্যবস্থা তিনি নেননি।
কিছুদিন আগেও এই চরম উগ্রবাদি বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, 'রাস্তায় একটি কুকুরের মৃত্যুতেও তিনি ব্যথিত হন। কিন্তু মুসলমানের মৃত্যুতে তিনি কষ্ট পান না।'
২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। মোদীকে সামনে রেখেই বিজেপি তাদের নির্বাচনী ছক কষছে। এতে দলের ও বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের উদারপন্থি শরিকরা নাখোশ। প্রতিবাদে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার এনডিএ জোট থেকে ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছেন।
এমনকি গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, যিনি বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার অন্যতম ক্রীড়ানক এবং অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর রামমন্দির নির্মাণে বদ্ধপরিকর, তিনিও দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন- মোদিকে দলের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষ প্রচারণার দায়িত্ব দেয়ার কারণে।
পরে দলের সিনিয়র নেতা ও সভাপতির অনুরোধে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন আদভানি। নিজ দলেও মোদী একজন বিতর্কিত এবং সারা ভারতেও তিনি বিতর্কিত। তার এই বিতর্কিত অবস্থান সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এবং ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম নিধনযজ্ঞে নেতৃত্ব দেয়ায়।
কয়েকদিন আগে এই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশি হাইকমিশনার তারিক এ করিম। তার এ সাক্ষাৎ নিয়ে ভারতে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির টেলিগ্রাফ পত্রিকা মন্তব্য করেছে, এই বৈঠক বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগকে কতটা সাহায্য করবে তা বলা না গেলেও নরেন্দ্র মোদীর ওয়েবসাইটে এই সৌজন্য সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে।
অনুমান করা যায় আগামী দিনে নির্বাচনী প্রচারেও এই সাক্ষাৎকারের বিষয়টি তুলে ধরে বলা হবে যে, শুধু ভারতের মুসলমানদের কাছেই নয়, ভারতের বাইরের মুসলমানদের কাছেও নরেন্দ্র মোদী সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারিক এ করিমকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ভারতে হাইকমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারের আস্থাভাজন তারিক এ করিম সরকারের নির্দেশেই মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
আর এই সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে বিজেপিকে রাজি করানো। আওয়ামী লীগ ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু। ভারতও বাংলাদেশে এই দলটিকেই তুলনামূলক পছন্দ করে, তবে প্রকাশ্য উদারনীতি কথা বলে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে ভালো অবস্থানে।
মহাজোট সরকারের মেয়াদ প্রায় শেষ। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ এই সময়ে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধান না হওয়া সরকারের চরম ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে। তাই শেষ মুহূর্তে এসে দিল্লির সঙ্গে একটা চুক্তিতে পৌঁছাতে মরিয়া ঢাকা। মনমোহন সরকারের মনোভাবও ইতিবাচক। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর সমর্থন না পাওয়ায় সরকার কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারছে না।
কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য বিরোধী দল বিজেপি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছে। মনমোহন সরকার এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কারণ, লোকসভা ও রাজ্যসভায় তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, যার জোরে তারা কোনো চুক্তি বিল হিসেবে পাস করাতে পারবে। তাই বিরোধী দলের দারস্থ হতে হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দল না রাজি।
ভারত সরকার যখন ব্যর্থ তাদের বিরোধী দলকে রাজি করাতে, তখনই সেই প্রায় অসম্ভব মিশনে নেমেছে বিদেশ সফরে রেকর্ডধারী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মি. করিম। এই কারণেই মি. করিম নিজ উদ্যোগে সাক্ষাৎ করেছেন মোদীর সঙ্গে।
কয়েকদিন আগে দীপু মনি সাক্ষাৎ করেছেন লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজ এবং রাজ্যসভার বিরোধী নেতা অরুণ জেটলির সঙ্গে। উদ্দেশ্য তাদের সমর্থন আদায় করা। কিন্তু কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষ্যমতে, দীপু মনিকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। দীপু মনির সর্বশেষ চেষ্টা, নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মি. করিমের বৈঠক, যদি তাদের মন গলানো যায়। বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘ ইতিহাস পাঠে, মনে হয় না কিছু হবে।
তবে এই বৈঠকে লাভবান হয়েছে মোদী নিজে। সে তার কলঙ্ক আড়াল করার প্রয়াস পেয়েছে। ইতোমধ্যে বিজেপির ওয়েবসাইটে ওই বৈঠকের ছবি ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, ভোটারদের কাছে একটা বার্তা পেছানো হচ্ছে যে, মুসলিম বিশ্বের কাছেও মোদীর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রতি এই ভারতের বৈরী নীতির খেশারত দিতে হচ্ছে। আমাদের পদ্মা নদী শুকিয়ে গেছে ফারাক্কার কারণে, তিস্তা, ফেনী নদীর ন্যায্য হিস্যা আমরা পাইনি। সিলেটকে মরুভূমি বানাতে টিপাইমুখে বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা ঝুলে আছে। সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বিএসএফের নিত্যকর্ম। বাদ ছিল ট্রানজিট, সেটাও দেয়া হয়ে গেছে। বিনিময়ে তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, তাও ভারত আটকে দিয়েছে বিরোধী দলের অসম্মতির অজুহাতে।
আমাদের সরকার ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে গোপনে, বিরোধী দল এবং জনগণ তার কিছুই জানতে পারে না। আর ভারত সরকার বিরোধী দলের সমর্থন ছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তি করে না। সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস পাঠে আমাদের বোধোদয় হলো না। উদার হস্তে তাদের দিয়ে চলেছি, কিছুই আটকে রাখতে পারিনি। আর সর্বশেষ এমন একজন ব্যক্তির দারস্থ হতে হলো, যার হাতে রক্ত, যার রাজনীতি সংখ্যালঘু মুসলিম হত্যার কলঙ্কে নিমজ্জিত।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা
ই-মেইল: mreenalhasan@yahoo.com
Bangla envoy meets Modi - bdnews24.com
bdnews24.com/bangladesh/2013/07/28/bangla-envoy-meets-modiগুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দীর্ঘ বৈঠক
২৮ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২২ |
__._,_.___