ফোনালাপে সরকারের আম-ছালা দুই-ই গেছে
সংলাপে ডাকার দায়ও এখন সরকারের ঘাড়ে
আবু সোহায়েল : 'আমছালা দুই-ই গেছে' বাংলা প্রবাদটি ব্যবহƒত হয় সব হারানো লোভী লোকদের ক্ষেত্রে। সব পাওয়ার নির্বিচার চেষ্টায় যারা সব কিছু হারায় তাদের ক্ষেত্রেই এই বাংলা প্রবাদটি ব্যবহƒত হয়। দুই নেত্রীর ফোনালাপের আয়োজন করে সরকার বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ট্র্যাপে ফেলে লাভের সব ফসল ঘরে তোলার যে চেষ্টা করেছিল তা বুমেরাং হয়েছে। অভিজ্ঞমহলের অভিমত সরকার ফোনালাপকে পরিকল্পিতভাবে ইচ্ছেমত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অপ্রস্তুত বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছ থেকে এমন সব কথা আদায় করতে চেয়েছিল যাতে একদিকে তিন দিনের হরতাল বানচাল হয়ে যায়, অন্যদিকে ফোনালাপটি সরকারের রাজনৈতিক পুঁজি হিসাবে ব্যবহƒত হতে পারে এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী ইমেজ সংকটেও পড়ে। কিন্তু দুই লাভের কোনটিই ঘরে তুলতে পারেনি সরকার। বরং একদিকে যেমন নিজেরা ইমেজ সংকটে পড়েছে অন্যদিকে তেমনি ব্যক্তিগত ফোনালাপ মিডিয়ায় প্রকাশ করে অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে সরকারকে। এখন আম-ছালা দুই-ই যাবার মত অবস্থা।
ফোনালাপ আয়োজনের মধ্যে আসলে নিয়ত কি ছিল তা বাইরে থেকে জানার মত বিষয় না হলেও ফোনালাপের শুরুটা অন্তত যারা দেখেছেন তাদের সকলের মনে প্রশ্ন জাগার কথা যে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ কোন ধরনের ফোনালাপ! বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপ ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। কিন্তু দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী তার ফোনালাপকে দরবারী পর্যায় নামিয়ে এনেছেন। টেলিফোন কানে ধরে প্রধানমন্ত্রী একটি ছোফায় বসেছিলেন, তাকে ঘিরে ছিল বিশাল ঘরভর্তি নেতৃবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত সাংবাদিকরা। সন্দেহ নেই সকলকেই ফোনালাপের সাক্ষী হিসাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। বিরোধীদলীয় নেত্রী এটা জানতেন না, পর্র্রতী ফোনালাপ থেকে এটা পরিষ্কার। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে এটা না জানিয়ে এ ধরনের আয়োজন কোনো শুভ উদ্দেশ্যের পরিচায়ক নয় এবং এটা অনৈতিক, এমনটাই পর্যবেক্ষমহলের অভিমত। ব্যক্তিগত ফোনালাপটি ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও ইন্টারনেটে যাওয়ার পর এই অনৈতিক বিষয়টাকে খুব বড় করে দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ব্যক্তিগত ফোনালাপের বিষয়টি বিরোধী নেত্রীর অনুমতি না নিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করে সরকার দ-নীয় অপরাধ করেছে। বিস্ময়ের সাথে দেখা যাচ্ছে সরকার এই দায়টি অন্যের ঘাড়ে চাপাবার জন্যে কে বা কারা এটা রেকর্ড করেছে, প্রচার করেছে, তা তদন্ত করে দেখার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞমহল বলছেন, সরকারের এই দায়টি অন্যের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে তার বাড়িতে ফোনালাপের সময় সাংবাদিক এবং অন্যদের ডেকেছিলেন তাতে এটা প্রমাণ হয় যে সরকার ফোনালাপটি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে না জানিয়ে রেকর্ডেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এর আর একটা প্রমাণ হলো, ২৮ অক্টোবর তারিখে ফোনালাপটি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হবার কয়েক ঘণ্টা আগে তথ্যমন্ত্রী ফোনালাপটি জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করার কথা বলেছিলেন। এতে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়; এক, ফোনালাপটি রেকর্ড করে রাখা হয়েছে, সেটা তিনি জানতেন, আর রেকর্ডের কাজটি সরকারি তত্তাবধানেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এবং দুই, সরকারের ইচ্ছা বা আয়োজনেই ফোনালাপটি মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে, যদিও তথ্যমন্ত্রী এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অভিজ্ঞমহল আরো বলছেন, অন্য কোন পক্ষ যদি ফোনালাপটি মিডিয়াতে দিয়ে থাকে তাহলেও দায়টা এই পক্ষটির উপর নয়, সরকারের উপরই বর্তায়। কারণ তথ্যমন্ত্রী একাধিক বার বলেছেন ফোনালাপটি জনগণের সম্পদ তাই প্রকাশ যোগ্য। তথ্যমন্ত্রীর এই যুক্তি সচেতন কোনো মহলই গ্রহণ করেননি। তারা প্রাইভেট ফোনালাপের বিনা অনুমতিতে প্রচারকে তথ্য আইন অনুসারে দ-নীয় অপরাধ বলার ক্ষেত্রে অনড়। তারা তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপকে ঘিরে সরকারি আয়োজনকে ডবলস্ট্যান্ডার্ড বলেও অভিহিত করছেন। ব্যক্তিগত আলোচনা বা আলাপের বিষয় সংবাদপত্রে প্রচার করার যে অপরাধে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে জেলে পুরে রাখা হয়েছে, রিমান্ডে পর্যন্ত নেয়া হয়েছে, বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ফোনালাপকে রেকর্ড করে এবং মিডিয়ায় তো প্রচার করে ইনু সাহেবরা সেই অপরাধই করেছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্যে ফোনালাপের নামে যে ফাঁদ পাতা হয়েছিল সেই ফাঁদে সরকার নিজেই ধরা পড়েছে। একদিকে দ-নীয় অপরাধের জন্যে সরকার অভিযুক্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে গোটা ফোনালাপের রেজাল্ট প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী ইমেজ সংকটে পড়ার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ইমেজ সংকটে পড়েছেন। গোটা ফোনালাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রী একই বিষয়ে দৃষ্টিকটু পুনরাবৃত্তি করেছেন জবাব পাবার পরেও। যেমন বেগম জিয়ার লাল টেলিফোন খারাপ থাকার প্রশ্ন। বেগম জিয়া তার লাল টেলিফোন বার বার কমপ্লেন করার পরও দীর্ঘদিন থেকে খারাপ রয়েছে একথা বলার পরও প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন না ধরার জন্যে বেগম জিয়াকে বার বার অভিযুক্ত করেছেন। এই প্রশ্নটি তিনি ফোনালাপের মাঝের দিকে আবারও তুলেছেন। বুঝা যায় তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যাবাদী সাজাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, যদিও বেগম খালেদা জিয়ার সুস্পষ্ট, দৃঢ় ও যুক্তিপূর্ণ জবাবে তা সম্ভব হয়নি। রেড টেলিফোন খারাপ থাকার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য যে সঠিক ছিল, তা পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে ফোনালাপ হয়েছিল ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় আর বেগম জিয়ার লাল টেলিফোনটি ঠিক হয় ২৮ অক্টোবর তারিখে। গোটা ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিকভাবে নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন, অভিযুক্ত করেছেন খালেদা জিয়াকে, আর খালেদা জিয়া ছিলেন জবাব দেয়ার ভূমিকায়। এ দিক থেকে গোটা আলোচনা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, আর জবাব দেয়ার ডিফেনসিভ ভূমিকায় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো খালেদা জিয়ার তাৎক্ষণিক, সুস্পষ্ট, দ্বিধাহীন, যথোপযুক্ত ও দৃঢ়তাপূর্ণ প্রতিটি জবাব প্রধানমন্ত্রীকে ডিফেনসিভ অবস্থানে ফেলে দিয়েছেন। গোটা ফোনালাপেই প্রধানমন্ত্রীকে এই অবস্থায় দেখা গেছে। অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার কথার তিনি জবাব দিতে পারেননি বা জবাব দেননি। প্রধানমন্ত্রী তার সংলাপ সংক্রান্ত ফোনালাপে সংলাপের সাথে সংগতিহীন কমপক্ষে ষোলটি আক্রমণাত্মক ইস্যু সামনে নিয়ে আসেন যার জবাব বেগম খালেদা জিয়া দেন। ইস্যুগুলো হলো যেমন: 'মানুষ হত্যা বন্ধ করুন', 'আমাদের গ্রেনেড হামলার কথা মনে আছে', 'হরতালের মাধ্যমে মানষ খুন করছেন', 'যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করছেন', 'আপনি জবাব দিতে পারেন, অসাংবিধানিক সরকার....', 'আপনি নয়জনকে ডিঙ্গিয়ে মইনুদ্দিনকে প্রধান বানিয়েছিলেন,' আপনারা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করেছেন,' '১৫ আগস্ট আপনি কেন কেক কাটেন', 'বোমা বাস্ট হবে...', 'আপনারা কি ক্যামেরায়...', 'আপনারা তো দা কুড়াল নিয়ে মানুষ হত্যার কথা বলছেন', আপনাদের ভারপ্রাপ্ত আছে। যদিও প্রটোকলে মিলে না', 'আমাদের কিন্তু ৯৬-এর কথা মনে আছে', 'আমাদের পার্টি স্ট্রং। আমোদের ভোট আছে। আমরা সংগ্রাম করেই এটা অর্জন করেছি'। সংলাপের সাথে সংগতিহীন এসব আক্রমণাত্মক বিষয়গুলো আলোচনায় নিয়ে আসার ফলেই ফোনালাপটি বিতর্ক, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে পর্যবসিত হয়। উত্থাপিত আক্রমণাত্মক বিষয়গুলোর দাদভাঙ্গা জবাব দেন বেগম খালেদা জিয়া। কোন ইস্যুই তাকে দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিতে পারেনি।
বেগম খালেদা জিয়া ফোনালাপকে তার মূল বিষয়ের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন একাধিকবার। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। আলোচনার শুরুর দিকে একবার তিনি বলেন, 'আপনি অতীতের দিকে নয় সামনের দিকে আগান। 'সৎ উদ্দেশ্য থাকলে সামনে আগান'। বেগম খালেদা জিয়ার এই আহ্বানের জবাব হিসাবে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রধানমন্ত্রী বলে উঠেন 'আপনারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করেছেন'। আরেক জায়গায় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, 'এ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসেন। আসুন নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করি'। বেগম খালেদা জিয়ার এই আহ্বানকে এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন তুলেন 'আপনি হরতাল প্রত্যাহার করবেন না' এইভাবে আলোচনাকে ফলপ্রসূ করার মূল এজেন্ডার দিকে ফিরিয়ে নেয়ার খালেদা জিয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়ার ফোনালাপের বিষয় ছিল নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপ। কিন্তু ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টাকে কোনো সময় সামনে নিয়ে আসেননি। প্রধানমন্ত্রী ২৮ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে গণভবনে দাওয়াত দিয়েছিলেন। বেগম জিয়া প্রশ্ন করেন 'দাওয়াত কেন দিচ্ছেন?' প্রধানমন্ত্রী জবাবে বলেন, 'আমার সঙ্গে রাতের খাবার খাবেন'। ফোনালাপের এক স্থানে প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করতে চাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার যে কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ কথা বলেন, তাতে এ আলোচনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে তা বুঝায় না।
ফোনালাপ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মধ্যে যে দীর্ঘ আলাপ হয় তাতে সংলাপে ডাকা এবং সংলাপের তারিখ নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তেছে। ফোনালাপে বারবার খালেদা জিয়া বলেছেন ২৯ অক্টোবরের পর যে কোন দিন যে কোন স্থানে সংলাপ হতে পারে। গোটা ফোনালাপের মধ্যে বেগম জিয়া অন্তত আটবার এ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি ২৮ তারিখে হরতালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতে সাড়া দেয়ার অপারগতার কথা জানিয়ে বলেন, '২৮ তারিখ আমি যেতে পারব না, ঐদিন হরতাল আছে', এরপর তিনি আরেক জায়গায় বলেন, 'আপনি ২৯ তারিখের পর বলেন আমরা আসব'। অন্য এক জায়গায় বলেন, 'আপনি ২৯ তারিখের পর করেন'। প্রধানমন্ত্রীর আরেক কথার জবাবে তিনি বলেন, 'আমি আপনাকে অনুরোধ করি, সদিচ্ছা থাকলে ২৯ তারিখের পর ডাকেন'। এরপর তিনি বলেন, '২৯ তারিখের পর ডাকেন। অন্য কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে। আমরা কর্মসূচি দেব না'। এরপর বেগম খালেদা জিয়া ফোনালাপের শেষের দিকে বলেন, '৩০ তারিখের পর হলে রাজি আছি'। এরপর তিনি আরো সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, '৩০ তারিখ হলে আমি রাজি'। এখানে উদ্ধৃত বেগম জিয়ার সব কথার মূল বক্তব্য হলো ২৯ তারিখের পরে ডাকলে তিনি সংলাপে যাবেন। তিনি আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী ৩০ তারিখে ডাকলেও তিনি রাজি আছেন ৩০ তারিখের পর ডাকলেও রাজি'। সুতরাং ফোনালাপ অনুসারে সংলাপে ডাকার দায়িত্ব, সংলাপের ডেট নির্ধারণের দায়িত্ব এখন সরকারের উপর। বেগম খালেদা জিয়া নিশ্চয় সংলাপের ব্যাপারে সরকারের আহ্বানের অপেক্ষা করবেন। সম্ভবত সংলাপের এই বিষয়টিকে সামনে রেখে ৫ দিন পর ৪ নবেম্বর থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া।
ফোনালাপ আয়োজনের মধ্যে আসলে নিয়ত কি ছিল তা বাইরে থেকে জানার মত বিষয় না হলেও ফোনালাপের শুরুটা অন্তত যারা দেখেছেন তাদের সকলের মনে প্রশ্ন জাগার কথা যে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ কোন ধরনের ফোনালাপ! বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপ ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। কিন্তু দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী তার ফোনালাপকে দরবারী পর্যায় নামিয়ে এনেছেন। টেলিফোন কানে ধরে প্রধানমন্ত্রী একটি ছোফায় বসেছিলেন, তাকে ঘিরে ছিল বিশাল ঘরভর্তি নেতৃবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত সাংবাদিকরা। সন্দেহ নেই সকলকেই ফোনালাপের সাক্ষী হিসাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। বিরোধীদলীয় নেত্রী এটা জানতেন না, পর্র্রতী ফোনালাপ থেকে এটা পরিষ্কার। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে এটা না জানিয়ে এ ধরনের আয়োজন কোনো শুভ উদ্দেশ্যের পরিচায়ক নয় এবং এটা অনৈতিক, এমনটাই পর্যবেক্ষমহলের অভিমত। ব্যক্তিগত ফোনালাপটি ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও ইন্টারনেটে যাওয়ার পর এই অনৈতিক বিষয়টাকে খুব বড় করে দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ব্যক্তিগত ফোনালাপের বিষয়টি বিরোধী নেত্রীর অনুমতি না নিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করে সরকার দ-নীয় অপরাধ করেছে। বিস্ময়ের সাথে দেখা যাচ্ছে সরকার এই দায়টি অন্যের ঘাড়ে চাপাবার জন্যে কে বা কারা এটা রেকর্ড করেছে, প্রচার করেছে, তা তদন্ত করে দেখার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু অভিজ্ঞমহল বলছেন, সরকারের এই দায়টি অন্যের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে তার বাড়িতে ফোনালাপের সময় সাংবাদিক এবং অন্যদের ডেকেছিলেন তাতে এটা প্রমাণ হয় যে সরকার ফোনালাপটি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে না জানিয়ে রেকর্ডেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এর আর একটা প্রমাণ হলো, ২৮ অক্টোবর তারিখে ফোনালাপটি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হবার কয়েক ঘণ্টা আগে তথ্যমন্ত্রী ফোনালাপটি জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করার কথা বলেছিলেন। এতে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়; এক, ফোনালাপটি রেকর্ড করে রাখা হয়েছে, সেটা তিনি জানতেন, আর রেকর্ডের কাজটি সরকারি তত্তাবধানেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এবং দুই, সরকারের ইচ্ছা বা আয়োজনেই ফোনালাপটি মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে, যদিও তথ্যমন্ত্রী এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অভিজ্ঞমহল আরো বলছেন, অন্য কোন পক্ষ যদি ফোনালাপটি মিডিয়াতে দিয়ে থাকে তাহলেও দায়টা এই পক্ষটির উপর নয়, সরকারের উপরই বর্তায়। কারণ তথ্যমন্ত্রী একাধিক বার বলেছেন ফোনালাপটি জনগণের সম্পদ তাই প্রকাশ যোগ্য। তথ্যমন্ত্রীর এই যুক্তি সচেতন কোনো মহলই গ্রহণ করেননি। তারা প্রাইভেট ফোনালাপের বিনা অনুমতিতে প্রচারকে তথ্য আইন অনুসারে দ-নীয় অপরাধ বলার ক্ষেত্রে অনড়। তারা তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপকে ঘিরে সরকারি আয়োজনকে ডবলস্ট্যান্ডার্ড বলেও অভিহিত করছেন। ব্যক্তিগত আলোচনা বা আলাপের বিষয় সংবাদপত্রে প্রচার করার যে অপরাধে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে জেলে পুরে রাখা হয়েছে, রিমান্ডে পর্যন্ত নেয়া হয়েছে, বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ফোনালাপকে রেকর্ড করে এবং মিডিয়ায় তো প্রচার করে ইনু সাহেবরা সেই অপরাধই করেছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্যে ফোনালাপের নামে যে ফাঁদ পাতা হয়েছিল সেই ফাঁদে সরকার নিজেই ধরা পড়েছে। একদিকে দ-নীয় অপরাধের জন্যে সরকার অভিযুক্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে গোটা ফোনালাপের রেজাল্ট প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী ইমেজ সংকটে পড়ার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ইমেজ সংকটে পড়েছেন। গোটা ফোনালাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রী একই বিষয়ে দৃষ্টিকটু পুনরাবৃত্তি করেছেন জবাব পাবার পরেও। যেমন বেগম জিয়ার লাল টেলিফোন খারাপ থাকার প্রশ্ন। বেগম জিয়া তার লাল টেলিফোন বার বার কমপ্লেন করার পরও দীর্ঘদিন থেকে খারাপ রয়েছে একথা বলার পরও প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন না ধরার জন্যে বেগম জিয়াকে বার বার অভিযুক্ত করেছেন। এই প্রশ্নটি তিনি ফোনালাপের মাঝের দিকে আবারও তুলেছেন। বুঝা যায় তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যাবাদী সাজাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, যদিও বেগম খালেদা জিয়ার সুস্পষ্ট, দৃঢ় ও যুক্তিপূর্ণ জবাবে তা সম্ভব হয়নি। রেড টেলিফোন খারাপ থাকার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য যে সঠিক ছিল, তা পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ও বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে ফোনালাপ হয়েছিল ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় আর বেগম জিয়ার লাল টেলিফোনটি ঠিক হয় ২৮ অক্টোবর তারিখে। গোটা ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিকভাবে নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন, অভিযুক্ত করেছেন খালেদা জিয়াকে, আর খালেদা জিয়া ছিলেন জবাব দেয়ার ভূমিকায়। এ দিক থেকে গোটা আলোচনা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, আর জবাব দেয়ার ডিফেনসিভ ভূমিকায় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো খালেদা জিয়ার তাৎক্ষণিক, সুস্পষ্ট, দ্বিধাহীন, যথোপযুক্ত ও দৃঢ়তাপূর্ণ প্রতিটি জবাব প্রধানমন্ত্রীকে ডিফেনসিভ অবস্থানে ফেলে দিয়েছেন। গোটা ফোনালাপেই প্রধানমন্ত্রীকে এই অবস্থায় দেখা গেছে। অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার কথার তিনি জবাব দিতে পারেননি বা জবাব দেননি। প্রধানমন্ত্রী তার সংলাপ সংক্রান্ত ফোনালাপে সংলাপের সাথে সংগতিহীন কমপক্ষে ষোলটি আক্রমণাত্মক ইস্যু সামনে নিয়ে আসেন যার জবাব বেগম খালেদা জিয়া দেন। ইস্যুগুলো হলো যেমন: 'মানুষ হত্যা বন্ধ করুন', 'আমাদের গ্রেনেড হামলার কথা মনে আছে', 'হরতালের মাধ্যমে মানষ খুন করছেন', 'যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করছেন', 'আপনি জবাব দিতে পারেন, অসাংবিধানিক সরকার....', 'আপনি নয়জনকে ডিঙ্গিয়ে মইনুদ্দিনকে প্রধান বানিয়েছিলেন,' আপনারা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করেছেন,' '১৫ আগস্ট আপনি কেন কেক কাটেন', 'বোমা বাস্ট হবে...', 'আপনারা কি ক্যামেরায়...', 'আপনারা তো দা কুড়াল নিয়ে মানুষ হত্যার কথা বলছেন', আপনাদের ভারপ্রাপ্ত আছে। যদিও প্রটোকলে মিলে না', 'আমাদের কিন্তু ৯৬-এর কথা মনে আছে', 'আমাদের পার্টি স্ট্রং। আমোদের ভোট আছে। আমরা সংগ্রাম করেই এটা অর্জন করেছি'। সংলাপের সাথে সংগতিহীন এসব আক্রমণাত্মক বিষয়গুলো আলোচনায় নিয়ে আসার ফলেই ফোনালাপটি বিতর্ক, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে পর্যবসিত হয়। উত্থাপিত আক্রমণাত্মক বিষয়গুলোর দাদভাঙ্গা জবাব দেন বেগম খালেদা জিয়া। কোন ইস্যুই তাকে দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিতে পারেনি।
বেগম খালেদা জিয়া ফোনালাপকে তার মূল বিষয়ের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন একাধিকবার। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। আলোচনার শুরুর দিকে একবার তিনি বলেন, 'আপনি অতীতের দিকে নয় সামনের দিকে আগান। 'সৎ উদ্দেশ্য থাকলে সামনে আগান'। বেগম খালেদা জিয়ার এই আহ্বানের জবাব হিসাবে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রধানমন্ত্রী বলে উঠেন 'আপনারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করেছেন'। আরেক জায়গায় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, 'এ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসেন। আসুন নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করি'। বেগম খালেদা জিয়ার এই আহ্বানকে এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন তুলেন 'আপনি হরতাল প্রত্যাহার করবেন না' এইভাবে আলোচনাকে ফলপ্রসূ করার মূল এজেন্ডার দিকে ফিরিয়ে নেয়ার খালেদা জিয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়ার ফোনালাপের বিষয় ছিল নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপ। কিন্তু ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টাকে কোনো সময় সামনে নিয়ে আসেননি। প্রধানমন্ত্রী ২৮ অক্টোবর খালেদা জিয়াকে গণভবনে দাওয়াত দিয়েছিলেন। বেগম জিয়া প্রশ্ন করেন 'দাওয়াত কেন দিচ্ছেন?' প্রধানমন্ত্রী জবাবে বলেন, 'আমার সঙ্গে রাতের খাবার খাবেন'। ফোনালাপের এক স্থানে প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করতে চাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার যে কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ কথা বলেন, তাতে এ আলোচনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে তা বুঝায় না।
ফোনালাপ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মধ্যে যে দীর্ঘ আলাপ হয় তাতে সংলাপে ডাকা এবং সংলাপের তারিখ নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তেছে। ফোনালাপে বারবার খালেদা জিয়া বলেছেন ২৯ অক্টোবরের পর যে কোন দিন যে কোন স্থানে সংলাপ হতে পারে। গোটা ফোনালাপের মধ্যে বেগম জিয়া অন্তত আটবার এ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি ২৮ তারিখে হরতালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতে সাড়া দেয়ার অপারগতার কথা জানিয়ে বলেন, '২৮ তারিখ আমি যেতে পারব না, ঐদিন হরতাল আছে', এরপর তিনি আরেক জায়গায় বলেন, 'আপনি ২৯ তারিখের পর বলেন আমরা আসব'। অন্য এক জায়গায় বলেন, 'আপনি ২৯ তারিখের পর করেন'। প্রধানমন্ত্রীর আরেক কথার জবাবে তিনি বলেন, 'আমি আপনাকে অনুরোধ করি, সদিচ্ছা থাকলে ২৯ তারিখের পর ডাকেন'। এরপর তিনি বলেন, '২৯ তারিখের পর ডাকেন। অন্য কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে। আমরা কর্মসূচি দেব না'। এরপর বেগম খালেদা জিয়া ফোনালাপের শেষের দিকে বলেন, '৩০ তারিখের পর হলে রাজি আছি'। এরপর তিনি আরো সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, '৩০ তারিখ হলে আমি রাজি'। এখানে উদ্ধৃত বেগম জিয়ার সব কথার মূল বক্তব্য হলো ২৯ তারিখের পরে ডাকলে তিনি সংলাপে যাবেন। তিনি আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী ৩০ তারিখে ডাকলেও তিনি রাজি আছেন ৩০ তারিখের পর ডাকলেও রাজি'। সুতরাং ফোনালাপ অনুসারে সংলাপে ডাকার দায়িত্ব, সংলাপের ডেট নির্ধারণের দায়িত্ব এখন সরকারের উপর। বেগম খালেদা জিয়া নিশ্চয় সংলাপের ব্যাপারে সরকারের আহ্বানের অপেক্ষা করবেন। সম্ভবত সংলাপের এই বিষয়টিকে সামনে রেখে ৫ দিন পর ৪ নবেম্বর থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া।
__._,_.___