আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে কে? আমরা না বিদেশীরা? - ১ বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০১৩, ২২ কার্তিক ১৪২০
মুনতাসীর মামুন
হাফ হাফ বাংলা বলার জন্যই যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনাকে সাংবাদিকরা পছন্দ করেন, তা নয়। মজেনা সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। জনসমক্ষে একটা ধারণা দেন, আমেরিকা বাংলাদেশের পরম বন্ধু। তবে মজেনা নয়, যে কোন মার্কিনী দূত দেখলেই সংবাদকর্মীরা পাগল পাগল হয়ে যান। যদি নজরে পড়া যায় শ্বেত চর্মের মানুষটির, তাহলে নিত্য আমেরিকা আসা-যাওয়া, পকেটে ডলারের খসখস। আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রকের একজন সেকশন অফিসার পদমর্যাদার কেউ এলেও তা খবর হয়ে যায়। তরুণ সাংবাদিকরা জানেন কিনা জানি না, একটি প্রবচন আছে- হাসি মুখ দেখে ভুলবেন না। আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার নেই। এটি প্রমাণিত সত্য। এ প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহারের কেসটা একটু বলি। বাইরে তাঁর বেশ একটা শফি শফি ভাব কিন্তু ভেতরে যে তিনি বোমাবাজ কবি, তা এখন টের পেয়েছেন সাংবাদিকরা। অথচ বিভিন্ন চ্যানেলের টকশোর প্রযোজকরা ফরহাদ মজহারকে দিয়ে আওয়ামী-বিরোধী কথাবার্তা বলিয়ে কী আনন্দই না পেয়েছেন। এখন ব্যাম্বু খাওয়ার পর ফরহাদকে শাপশাপান্ত করছেন। মজেনা কী করছেন বা কেন এত বেচাইন, যখন জানবেন তখন ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যাবে।
তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলি যা সংবাদকর্মীদের মোটেই পছন্দ হবে না। বড় দেশের ছোট রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে সংবাদকর্মীরা সার্কাসের ভাঁড়ের যে আচরণ করেন, তা নিজ দেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। এ ধরনের মর্যাদা হানিকর ব্যাপারগুলো ১৯৭৫ সালের পরই ঘটছে। ১৯৭১-৭৫ সালে নয়।
আপনারা বলবেন- ধান ভানতে শিবের গীত কেন? সব সময় ১৯৭১ আর ১৯৭৫ কেন? কারণ আছে। যে দেশে স্বাধীনতার পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি বিরাজ করে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও, সে দেশে ধান ভানতে শিবের গীত গাইতেই হয়। এখন দেশের যে পরিস্থিতি তারও মূল কারণ ১৯৭১ সালের পক্ষ-বিপক্ষ এবং মজেনার আমেরিকা। বর্তমান যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তা দুই নেতার 'মেয়েলি জিদ' নয়। এর সঙ্গে স্বাধীনতা ও পরাধীনতার প্রশ্ন যুক্ত এবং তার সঙ্গে যুক্ত মার্কিন-চীন-ভারত দ্বন্দ্ব।
এ ভূখ- সব সময় বিদেশীদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্র ছিল এবং বিদেশীরা শাসন করেছে। যথার্থ মুক্তির সময় ছিল মাত্র চার বছর। তার পর থেকে এক ধরনের বিদেশী বন্ধনেই ছিলাম। দুঃখের বিষয় এখনও বাংলাদেশ আবার বিদেশী পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং এতে ইন্ধন দিচ্ছেন রাজনীতিবিদ, মিডিয়াসৃষ্ট সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং কিছু এনজিও ব্যক্তিবর্গ।
ওই প্রজন্মের সাংবাদিকরা জানেন কিনা জানি না, হয়ত জানেন, মার্কিন সরকার ১৯৭১ সালে বাঙালী হত্যায় মদদ দিয়েছিল মজেনার মতো হাসিমুখেই। বাঙালীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। চীন ছিল এক্ষেত্রে তার সহযোগী। বস্তুত ১৯৭১ সালেই চীন পাকিস্তান আমেরিকার দোস্তালি মজবুত করে। এ সব প্রসঙ্গ আছে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে। গবেষক গ্যারি জে ব্যাস নতুন একটি বই লিখেছেন দি ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার এ্যান্ড ফরগটেন জেনোসাইড [আমাদের সুহৃদ জানাল আহমেদ শিকাগো থেকে পুরো বইটি ই-মেইলে পাঠিয়েছেন]। তিনি লিখেছেন- বিভিন্ন দেশে গণহত্যায় মদদদাতা কিসিঞ্জার, হানাদার পাকিদের পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে, রাগে-দুঃখে হতাশায় ভারতীয়দের 'সারমেয় শাবক' বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলছিলেন- ইয়াহিয়ার মতো চমৎকার লোক আর হয় না। কিসিঞ্জার চীনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়াকে বোঝালেন, ভারত চীনের দিকেও অগ্রসর হবে পাকিস্তান জয় করে। হুয়া তখন মার্কিনীদের সঙ্গে হুকা হুয়া শুরু করলেন। নিক্সন কিসিঞ্জারের এই জঘন্য জোরের বিরুদ্ধে সত্য নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন কনসাল আর্চার ব্লাড রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁর টেলিগ্রাম ব্লাড টেলিগ্রাম নামে এখন ইতিহাস খ্যাত তিনি আজ ইতিহাসের পাতায়। আর ভারতীয়দের যে নামে সম্বোধন করেছিলেন কিসিঞ্জার, সেই নামে সম্বোধন করা হয় নিক্সন-ইয়াহিয়া আর কিসিঞ্জারকে।
অনেকে হয়ত আমার এ মন্তব্যকে বড়াবাড়ি বলবেন, যদি বলি যে, অবস্থা এখন ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের মতো। সারাদেশ তখনকার মতো এখনও দুটি শিবিরে বিভক্ত। একটি পাকিস্তানপন্থী শিবির আরেকটি বাংলাদেশপন্থী। আমি না বললেও সবাই ধরে নেন যে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা বাংলাদেশপন্থী। বিরোধীপক্ষের কাছে ভারতপন্থী। জামায়াত পাকিস্তানপন্থী এ নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বিএনপির অনেকেও তাই মনে করেন কিন্তু খালেদা বা তারেকের ভয়ে সে কথা উচ্চারণের সাহস রাখেন না। বিএনপিকে অনেকে পাকিস্তানপন্থী বলতে নারাজ কিন্তু পাকিস্তানপন্থী বলেই বিএনপি যুদ্ধাপরাধ বিচার চায় না। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে খালেদা ঘোষণা করেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে তাদের মুক্তি দেবেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অল্প যে কয়জনের বিচার হচ্ছে তাদের মধ্যে দুইজন বিএনপির মন্ত্রী ও একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য। তারেক জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, জামায়াত-বিএনপি একই বৃন্তে দুটি ফুল। খবরে প্রকাশ, নির্বাচনকে সামনে রেখে তারেক জিয়া আইএসআইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সাকাচৌকে আইএসআই ৪০ কোটি টাকা দিয়েছিল বিডিআরের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও সেনাদের হত্যার জন্য। পাকিস্তানের একজন সংসদ সদস্য সম্প্রতি সেখানকার কাগজে লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধ বিচারের মাধ্যমে পাকিস্তানপন্থীদের নাজেহাল করা হচ্ছে বিএনপিকে, যেহেতু তারাও পাকিস্তানপন্থী।
বিএনপি-জামায়াত এখন যে কোনভাবে হলেও ক্ষমতায় যেতে চায়। না গেলে বিএনপি-জামায়াত খুবই হীনবল হয়ে পড়বে। পাকিস্তান বা আইএসআইও তা চায় না। আর এ প্রসঙ্গেই আসছে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের কথা।
নির্বাচন নিয়ে যখন চাপান-উতোর চলছে তখন মজেনা হঠাৎ চলে গেলেন দিল্লী, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করতে, যা খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ছোট দেশ বলে বাংলাদেশের ওপর সব রাষ্ট্রই ডা-া ঘুরাতে চায়। আমেরিকা তো আবার এক কাঠি সরেস, তারা সবাইকেই পদানত রাখতে চায়। সম্প্রতি, ইউরোপে মার্কিনীদের গুপ্তচরবৃত্তি ইউরোপীয় নেতাদের হতচকিত করেছে। যদিও আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আচরণ সামন্তদের মতো, তার পরও তারা এখন খানিকটা ক্রুদ্ধ।
যাক সে প্রসঙ্গ। ১৯৭৫ সালের পর সব সরকারই মার্কিনপন্থী। বাংলাদেশের প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর মতেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এক চিলতে হাসি। তবে মার্কিনীদের পছন্দ সামরিক/ মৌলবাদী/ জঙ্গীবাদী সরকার। সে কারণে শেখ হাসিনার ইচ্ছে থাকলেও তাঁর দুই আমলে মার্কিনীদের সঙ্গে সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিল বলা যাবে না। বর্তমান আমলে ড. ইউনূসকে নিয়ে বরং সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ড. ইউনূস খোলাখুলি এবং খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমেরিকার ইঙ্গিত হয়ত আছে তাতে। আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, লুঙ্গিপরা খালি গায়ের কৃষ্ণবর্ণ কিছু লোকের কাছে আমেরিকার মানসপুত্রদের ১৯৭১ প্রবল পরাজয় আমেরিকা এখনও ভোলেনি। পাকিস্তানের মতো একটি প্রতিশোধ নিতে তারা এখনও উন্মুখ। ১৯৭৫ সালে একটি প্রতিশোধ নিয়েছে বটে! কিন্তু প্রতিশোধ স্পৃহা এখনও তাদের কমেনি।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশে সামরিক সরকার চেয়েছে এ কারণে যে, সামরিক সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকে। অস্ত্র কিনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ওই প্রতিশোধ স্পৃহা ও নিজ ব্যবসা-স্বার্থ সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সে আইন ভূমিকা রেখেছিল এবং ওই একই কারণে এরশাদের মতো একটি লোককে সমর্থন করেছিল। এ ছাড়া এই দুইজনের রাজাকার বা পাকিস্তানপ্রীতি ছিল জবরদস্ত। অবশ্য, এরশাদ এখন শেখ হাসিনার প্রভাবে পড়ে রাজকারপ্রীতি আর প্রকাশ্যে দেখান না। মৌলবাদী জঙ্গীদেরও যুক্তরাষ্ট্রের ভারি পছন্দ। নানা অজুহাতে তারা এর যৌক্তিকতা দেখায়। আফগানে তালেবান তাদের সৃষ্টি, মিসরে ব্রাদারহুডের তারা সমর্থন করেছে, ইরাকে সেক্যুলার সরকার উৎখাত করেছে কিন্তু সৌদিতে মৌলবাদী সরকারকে সমর্থন করেছে।
আমেরিকার এ সব নীতি না থাকলে পৃথিবী অনেক নিরাপদ হতো। একই সূত্র ধরে বলা যায়, নিজামী খালেদার তালেবানী রাজাকার শাসন আমেরিকাই বেশি সমর্থন করেছিল। শাহরিয়ার কবির জানিয়েছেন তাঁর সাক্ষাতকারে যে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ধারণা- জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক ইসলামী দল। এতে সব কর্মকা-ের পরও জামায়াত হচ্ছে মধ্যপন্থী ও ইসলামী দল। চোখ থাকতেও যখন কেউ অন্ধ সেজে থাকে, তখন তাকে কোন যুক্তি দেয়া অবান্তর। এর পর আছে টাকা। আমেরিকার যে কোন নীতিনির্ধারককে টাকা দিয়ে কেনা যায়।
জামায়াত-বিএনপি যে সব সোর্স থেকে টাকা পাচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তা আরও ১০ বছর অকাতরে খরচ করলেও কমবে না। এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রবাসী বন্ধুরা একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ ককাসের একজন সদস্য খালেদা-নিজামীর তালেবানী শাসনে ঢাকা আসবেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু এ্যাক্টিভিস্ট চাচ্ছেন, তিনি যেন হিন্দু নিধনের বিষয়টি দেখেন। সদস্যের সচিব জানালেন, কিছু টাকা-পয়সা দরকার নির্বাচনী ফান্ডের জন্য। তাঁরা ৫০০০ ডলার চাঁদা দেন ফান্ডে। সেই বিখ্যাত সদস্য আসেন ঢাকা। লেহ্যপেয় খেয়ে ওয়াশিংটন গিয়ে বললেন, তালেবানী শাসনে হিন্দুদের উন্নতি হচ্ছে। সেই এ্যাক্টিভিস্টরা ক্রুদ্ধ হয়ে দেখা করতে গেলেন সদস্যের সেক্রেটারির সঙ্গে। তিনি বললেন, তোমরা যাওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত এসেছিল। তারা ২৫০০০ ডলার দিয়েছে। এই নাও তোমাদের ৫০০০ ডলার। (চলবে)
তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলি যা সংবাদকর্মীদের মোটেই পছন্দ হবে না। বড় দেশের ছোট রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে সংবাদকর্মীরা সার্কাসের ভাঁড়ের যে আচরণ করেন, তা নিজ দেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। এ ধরনের মর্যাদা হানিকর ব্যাপারগুলো ১৯৭৫ সালের পরই ঘটছে। ১৯৭১-৭৫ সালে নয়।
আপনারা বলবেন- ধান ভানতে শিবের গীত কেন? সব সময় ১৯৭১ আর ১৯৭৫ কেন? কারণ আছে। যে দেশে স্বাধীনতার পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি বিরাজ করে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও, সে দেশে ধান ভানতে শিবের গীত গাইতেই হয়। এখন দেশের যে পরিস্থিতি তারও মূল কারণ ১৯৭১ সালের পক্ষ-বিপক্ষ এবং মজেনার আমেরিকা। বর্তমান যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তা দুই নেতার 'মেয়েলি জিদ' নয়। এর সঙ্গে স্বাধীনতা ও পরাধীনতার প্রশ্ন যুক্ত এবং তার সঙ্গে যুক্ত মার্কিন-চীন-ভারত দ্বন্দ্ব।
এ ভূখ- সব সময় বিদেশীদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্র ছিল এবং বিদেশীরা শাসন করেছে। যথার্থ মুক্তির সময় ছিল মাত্র চার বছর। তার পর থেকে এক ধরনের বিদেশী বন্ধনেই ছিলাম। দুঃখের বিষয় এখনও বাংলাদেশ আবার বিদেশী পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং এতে ইন্ধন দিচ্ছেন রাজনীতিবিদ, মিডিয়াসৃষ্ট সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং কিছু এনজিও ব্যক্তিবর্গ।
ওই প্রজন্মের সাংবাদিকরা জানেন কিনা জানি না, হয়ত জানেন, মার্কিন সরকার ১৯৭১ সালে বাঙালী হত্যায় মদদ দিয়েছিল মজেনার মতো হাসিমুখেই। বাঙালীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। চীন ছিল এক্ষেত্রে তার সহযোগী। বস্তুত ১৯৭১ সালেই চীন পাকিস্তান আমেরিকার দোস্তালি মজবুত করে। এ সব প্রসঙ্গ আছে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে। গবেষক গ্যারি জে ব্যাস নতুন একটি বই লিখেছেন দি ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার এ্যান্ড ফরগটেন জেনোসাইড [আমাদের সুহৃদ জানাল আহমেদ শিকাগো থেকে পুরো বইটি ই-মেইলে পাঠিয়েছেন]। তিনি লিখেছেন- বিভিন্ন দেশে গণহত্যায় মদদদাতা কিসিঞ্জার, হানাদার পাকিদের পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে, রাগে-দুঃখে হতাশায় ভারতীয়দের 'সারমেয় শাবক' বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলছিলেন- ইয়াহিয়ার মতো চমৎকার লোক আর হয় না। কিসিঞ্জার চীনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়াকে বোঝালেন, ভারত চীনের দিকেও অগ্রসর হবে পাকিস্তান জয় করে। হুয়া তখন মার্কিনীদের সঙ্গে হুকা হুয়া শুরু করলেন। নিক্সন কিসিঞ্জারের এই জঘন্য জোরের বিরুদ্ধে সত্য নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন কনসাল আর্চার ব্লাড রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁর টেলিগ্রাম ব্লাড টেলিগ্রাম নামে এখন ইতিহাস খ্যাত তিনি আজ ইতিহাসের পাতায়। আর ভারতীয়দের যে নামে সম্বোধন করেছিলেন কিসিঞ্জার, সেই নামে সম্বোধন করা হয় নিক্সন-ইয়াহিয়া আর কিসিঞ্জারকে।
অনেকে হয়ত আমার এ মন্তব্যকে বড়াবাড়ি বলবেন, যদি বলি যে, অবস্থা এখন ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের মতো। সারাদেশ তখনকার মতো এখনও দুটি শিবিরে বিভক্ত। একটি পাকিস্তানপন্থী শিবির আরেকটি বাংলাদেশপন্থী। আমি না বললেও সবাই ধরে নেন যে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা বাংলাদেশপন্থী। বিরোধীপক্ষের কাছে ভারতপন্থী। জামায়াত পাকিস্তানপন্থী এ নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বিএনপির অনেকেও তাই মনে করেন কিন্তু খালেদা বা তারেকের ভয়ে সে কথা উচ্চারণের সাহস রাখেন না। বিএনপিকে অনেকে পাকিস্তানপন্থী বলতে নারাজ কিন্তু পাকিস্তানপন্থী বলেই বিএনপি যুদ্ধাপরাধ বিচার চায় না। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে খালেদা ঘোষণা করেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে তাদের মুক্তি দেবেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অল্প যে কয়জনের বিচার হচ্ছে তাদের মধ্যে দুইজন বিএনপির মন্ত্রী ও একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য। তারেক জিয়া ঘোষণা করেছিলেন, জামায়াত-বিএনপি একই বৃন্তে দুটি ফুল। খবরে প্রকাশ, নির্বাচনকে সামনে রেখে তারেক জিয়া আইএসআইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সাকাচৌকে আইএসআই ৪০ কোটি টাকা দিয়েছিল বিডিআরের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও সেনাদের হত্যার জন্য। পাকিস্তানের একজন সংসদ সদস্য সম্প্রতি সেখানকার কাগজে লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধ বিচারের মাধ্যমে পাকিস্তানপন্থীদের নাজেহাল করা হচ্ছে বিএনপিকে, যেহেতু তারাও পাকিস্তানপন্থী।
বিএনপি-জামায়াত এখন যে কোনভাবে হলেও ক্ষমতায় যেতে চায়। না গেলে বিএনপি-জামায়াত খুবই হীনবল হয়ে পড়বে। পাকিস্তান বা আইএসআইও তা চায় না। আর এ প্রসঙ্গেই আসছে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের কথা।
নির্বাচন নিয়ে যখন চাপান-উতোর চলছে তখন মজেনা হঠাৎ চলে গেলেন দিল্লী, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করতে, যা খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ছোট দেশ বলে বাংলাদেশের ওপর সব রাষ্ট্রই ডা-া ঘুরাতে চায়। আমেরিকা তো আবার এক কাঠি সরেস, তারা সবাইকেই পদানত রাখতে চায়। সম্প্রতি, ইউরোপে মার্কিনীদের গুপ্তচরবৃত্তি ইউরোপীয় নেতাদের হতচকিত করেছে। যদিও আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আচরণ সামন্তদের মতো, তার পরও তারা এখন খানিকটা ক্রুদ্ধ।
যাক সে প্রসঙ্গ। ১৯৭৫ সালের পর সব সরকারই মার্কিনপন্থী। বাংলাদেশের প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর মতেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এক চিলতে হাসি। তবে মার্কিনীদের পছন্দ সামরিক/ মৌলবাদী/ জঙ্গীবাদী সরকার। সে কারণে শেখ হাসিনার ইচ্ছে থাকলেও তাঁর দুই আমলে মার্কিনীদের সঙ্গে সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিল বলা যাবে না। বর্তমান আমলে ড. ইউনূসকে নিয়ে বরং সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ড. ইউনূস খোলাখুলি এবং খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমেরিকার ইঙ্গিত হয়ত আছে তাতে। আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, লুঙ্গিপরা খালি গায়ের কৃষ্ণবর্ণ কিছু লোকের কাছে আমেরিকার মানসপুত্রদের ১৯৭১ প্রবল পরাজয় আমেরিকা এখনও ভোলেনি। পাকিস্তানের মতো একটি প্রতিশোধ নিতে তারা এখনও উন্মুখ। ১৯৭৫ সালে একটি প্রতিশোধ নিয়েছে বটে! কিন্তু প্রতিশোধ স্পৃহা এখনও তাদের কমেনি।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশে সামরিক সরকার চেয়েছে এ কারণে যে, সামরিক সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকে। অস্ত্র কিনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ওই প্রতিশোধ স্পৃহা ও নিজ ব্যবসা-স্বার্থ সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সে আইন ভূমিকা রেখেছিল এবং ওই একই কারণে এরশাদের মতো একটি লোককে সমর্থন করেছিল। এ ছাড়া এই দুইজনের রাজাকার বা পাকিস্তানপ্রীতি ছিল জবরদস্ত। অবশ্য, এরশাদ এখন শেখ হাসিনার প্রভাবে পড়ে রাজকারপ্রীতি আর প্রকাশ্যে দেখান না। মৌলবাদী জঙ্গীদেরও যুক্তরাষ্ট্রের ভারি পছন্দ। নানা অজুহাতে তারা এর যৌক্তিকতা দেখায়। আফগানে তালেবান তাদের সৃষ্টি, মিসরে ব্রাদারহুডের তারা সমর্থন করেছে, ইরাকে সেক্যুলার সরকার উৎখাত করেছে কিন্তু সৌদিতে মৌলবাদী সরকারকে সমর্থন করেছে।
আমেরিকার এ সব নীতি না থাকলে পৃথিবী অনেক নিরাপদ হতো। একই সূত্র ধরে বলা যায়, নিজামী খালেদার তালেবানী রাজাকার শাসন আমেরিকাই বেশি সমর্থন করেছিল। শাহরিয়ার কবির জানিয়েছেন তাঁর সাক্ষাতকারে যে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ধারণা- জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক ইসলামী দল। এতে সব কর্মকা-ের পরও জামায়াত হচ্ছে মধ্যপন্থী ও ইসলামী দল। চোখ থাকতেও যখন কেউ অন্ধ সেজে থাকে, তখন তাকে কোন যুক্তি দেয়া অবান্তর। এর পর আছে টাকা। আমেরিকার যে কোন নীতিনির্ধারককে টাকা দিয়ে কেনা যায়।
জামায়াত-বিএনপি যে সব সোর্স থেকে টাকা পাচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তা আরও ১০ বছর অকাতরে খরচ করলেও কমবে না। এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রবাসী বন্ধুরা একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ ককাসের একজন সদস্য খালেদা-নিজামীর তালেবানী শাসনে ঢাকা আসবেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু এ্যাক্টিভিস্ট চাচ্ছেন, তিনি যেন হিন্দু নিধনের বিষয়টি দেখেন। সদস্যের সচিব জানালেন, কিছু টাকা-পয়সা দরকার নির্বাচনী ফান্ডের জন্য। তাঁরা ৫০০০ ডলার চাঁদা দেন ফান্ডে। সেই বিখ্যাত সদস্য আসেন ঢাকা। লেহ্যপেয় খেয়ে ওয়াশিংটন গিয়ে বললেন, তালেবানী শাসনে হিন্দুদের উন্নতি হচ্ছে। সেই এ্যাক্টিভিস্টরা ক্রুদ্ধ হয়ে দেখা করতে গেলেন সদস্যের সেক্রেটারির সঙ্গে। তিনি বললেন, তোমরা যাওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত এসেছিল। তারা ২৫০০০ ডলার দিয়েছে। এই নাও তোমাদের ৫০০০ ডলার। (চলবে)
আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে কে? আমরা না বিদেশীরা? - ২ বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর ২০১৩, ২৩ কার্তিক ১৪২০
মুনতাসীর মামুন
০
__._,_.___