হেফাজতের আড়ালে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ছিল জামায়াত-বিএনপির
নির্মূল কমিটির গণকমিশনের শ্বেতপত্রের সারাংশ ও সুপারিশ
(পূর্বপ্রকাশের পর)
বিভিন্ন সময়ে এসব মাদ্রাসা থেকে জঙ্গী রিক্রুট করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো, জিহাদের নামে সন্ত্রাস শিক্ষাদান, মাদ্রাসায় বোমা ও অন্যান্য মারণাস্ত্র বানানো, অনৈতিক কার্যকলাপ প্রভৃতি বিষয়ে জাতীয় দৈনিকসমূহে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও আহমদ শফীদের অনড় অবস্থানের কারণে কওম মাদ্রাসায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি কোনটাই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। আবাসিক মাদ্রাসা শিক্ষকদের অপরিসীম ক্ষমতার দাপটে ছাত্ররা একরকম বন্দী বা দাসত্বের জীবনযাপন করে। একজন মাদ্রাসা ছাত্রের সবকিছু তার ওস্তাদ বা শিক্ষকের হাতে। শিক্ষক ছাত্রের প্রতি প্রসন্ন না হলে তার সনদ মিলবে না, এমনকি তাকে মাদ্রাসা থেকেও বহিষ্কার করা যাবে। বেত্রাঘাত সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ হলেও এসব মাদ্রাসায় নয়। শুধু বেত্রাঘাত নয়, আরও অনেক কঠিন শারীরিক ও মানসিক শাস্তি 'অবাধ্য' ছাত্রকে প্রদান করা হয়। ছাত্রদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণও অনেক মাদ্রাসায় নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিবাদ করলে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার, এমন কি হত্যার ঘটনাও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, যার উল্লেখ এই শ্বেতপত্রেও রয়েছে।
শিক্ষকদের রাজনৈতিক এবং যৌন অভিলাষ চরিতার্থ করা মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং দলীয় ক্যাডারদের শক্তি একত্রিত করে ৫ মে সরকার উৎখাতের উদ্যোগ সম্ভব হয়েছিল।
দেশের কওমী মাদ্রাসায় পাঠ্যসূচীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোন স্থান নেই। এসব মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিষিদ্ধ। বড় বড় মাদ্রাসায় ছাত্ররা বাংলায় কোন দরখাস্ত লিখতে পারে না। দরখাস্ত লিখতে হয় আরবী অথবা উর্দুতে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিগতভাবে অনগ্রসর গ্রামের অসচ্ছল পরিবার থেকে যে কোমলমতি বালকরা মাদ্রাসায় পড়তে আসে তাদের কাছে অদৃশ্য আজরাইলের চেয়ে দৃশ্যমান ওস্তাদ অনেক ভয়ঙ্কর। ওস্তাদের যে কোন নির্দেশ তাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। জামায়াত-বিএনপির সহযোগিতা এবং ছাত্রদের এই অন্ধত্ব ও আনুগত্য হেফাজতের নেতাদের ৬ এপ্রিল ও ৫ মের মতো চরম উচ্চাভিলাষী কর্মসূচী প্রদানে প্রলুব্ধ করেছে। হেফাজতের অনেক নেতা আফগান জিহাদে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, ক্ষমতার স্বাদ যাদের অজানা নয়। যে কারণে তারা ৫ মে আফগান ও ইরান স্টাইলে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াত-বিএনপির টোপ সাগ্রহে গলাধঃকরণ করেছিলেন।
সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য জামায়াত ও হেফাজতের নেতারা গণজাগরণ মঞ্চের অভূতপূর্ব আন্দোলনকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল। মাদ্রাসার ছাত্রদের এবং সাধারণ মানুষকে আল্লাহ ও রাসুলের (সাঃ) অবমাননার কথা বলে সহজে যে উত্তেজিত করা যায় এই অভিজ্ঞতা জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী) নেতাদের রয়েছে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার সময় জামায়াত আবার তা যাচাই করেছে। উত্তম বড়ুয়া নামের বএক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে কীভাবে জালিয়াতি করে একজন শিবিরকর্মী কোরান অবমাননার ছবি সেঁটে দিয়েছিল এ বিষয়ে সে সময়ে জাতীয় দৈনিকসমূহে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে। মহানবীর (সাঃ) প্রতি বিদ্রƒপ বা উপহাসের ঘটনা ইউরোপে ঘটলেও এ নিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের তা-ব সৃষ্টি করা যায় এ অভিজ্ঞতাও জামায়াত-হেফাজতের নেতাদের রয়েছে।
১৯৯২-৯৩ সালে জামায়াতীরা 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র শীর্ষ নেতাদের 'নাস্তিক', 'মুরতাদ', 'ভারতের এজেন্ট', 'ইসলামের দুষমন' ইত্যাদি বলে বিএনপি সরকারকে দিয়ে জাহানারা ইমামকে পিটিয়ে সংজ্ঞাহীন করেছিল। ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার অজুহাত সৃষ্টির জন্য একইভাবে জামায়াত তাদের 'দুষ্কৃতকারী', 'ইসলামের দুষমন', 'ভারতের এজেন্ট' ইত্যাদি বলত। জামায়াত-হেফাজতের নেতারা সেই একই কৌশল অবলম্বন করেছেন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ নেতাদের হত্যা ও লাঞ্ছিত করবার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য।
চার
হাটহাজারীর শফী-বাবুনগরীর হেফাজতে ইসলাম ২০১০-এর জানুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করলেও রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপের নিচে এসেছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হওয়ার চৌদ্দ দিন পর। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি (২০১৩) জামায়াত-বিএনপির দৈনিক 'নয়া দিগন্ত', 'আমার দেশ', 'দিনকাল' ও 'সংগ্রাম'-এ প্রথম পাতায় অর্ধপৃষ্ঠা জুড়ে হেফাজতপ্রধান আহমদ শফীর এক খোলা চিঠি ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা শতাধিক। এর ভেতর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপত্র অর্ধ ডজনের বেশি নয়। খোলা চিঠি প্রকাশের জন্য 'অরাজনৈতিক' সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রধান জামায়াত ও বিএনপির মুখপত্রকেই বেছে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেন রাজনৈতিক প্রয়োজনে তার মতে ইসলামবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা জায়েজ। এই শ্বেতপত্রে আমরা দেখব এককালের জামায়াতবিরোধী হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলাম কীভাবে জামায়াতের দেহে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
জামায়াত ও বিএনপির দৈনিকে আহমদ শফীর খোলা চিঠির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল শাহবাগের 'গণজাগরণ মঞ্চে'র আন্দোলন এবং এর তরুণ নেতৃত্ব। এর সঙ্গে তিনি 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র নেতা বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, মানবাধিকার আন্দোলনের পুরোগামী নেতা অধ্যাপক অজয় রায় ও জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতিও বিষোদ্গার করেছেন গণজাগরণ মঞ্চকে পৃষ্ঠপোষকতা করবার জন্য। তিনি গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে কাদিয়ানীদের সম্পৃক্তি আবিষ্কার করেছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গেও কাদিয়ানীদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছেন।
হেফাজতপ্রধান মওলানা শাহ্ আহ্মদ শফীকে অনেকে শ্রদ্ধা করেন বুযুর্গ আলেম হিসেবে। তিনি যখন কোন কথা বলেন, কিংবা লিখিতভাবে মতপ্রকাশ করেন সেখানে কোন মিথ্যাচার বা শঠতা কেউ আশা করে না। 'গণজাগরণ মঞ্চ'-এর অন্দোলন আরম্ভ হওয়ার ছয় মাস আগে বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী তাঁর নাতনির চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন এবং দেশে ফিরেছেন এক বছর পর। তাঁকে কেউ 'গণজাগরণ মঞ্চে' দেখছে এমন কথা বলবার মতো একজন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। 'গণজাগরণ মঞ্চ' যখন আরম্ভ হয় তখন শাহরিয়ার কবিরও দেশে ছিলেন না। তবে লাখ লাখ ছাত্র জনতার মতো তিনি, মুনতাসীর মামুন, অজয় রায় ও জাফর ইকবালও কয়েকবার 'গণজাগরণ মঞ্চে'র সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য গিয়েছিলেন। 'গণজাগরণ মঞ্চ' থেকে ১১ জন কাদিয়ানীকে গ্রেফতার করা হয়েছে আহমদ শফীর এ দাবিও সম্পূর্ণ মিথ্যা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবিতে 'গণজাগরণ মঞ্চ'-এর সমাবেশ যখন একটানা একুশ দিন অব্যাহত ছিল তখন এমন কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ ছিল না সেখানে যায়নি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত-লিঙ্গ-বয়স নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সকল মানুষ শাহবাগে এবং তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত শত শত গণজাগরণ মঞ্চে সমবেত হয়ে জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সন্তানদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসানের মতো বহু বরেণ্য আলেম-ওলামা এবং ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ 'গণজাগরণ মঞ্চে' এসে সন্তানতুল্য তরুণদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাদের জন্য দোয়া করেছেন। এমন কি প্রথম দিকে বিএনপির কয়েকজন নেতা এসেও 'গণজাগরণ মঞ্চে'র সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। তখন বিএনপি বলেছে 'গণজাগরণ মঞ্চ' তাদের ছয় দফা দাবির সঙ্গে সরকারের দুর্নীতিসহ বিএনপির কিছু দাবি যুক্ত করলে এর আবেদন আরও বাড়ত। অবশ্য পরে বিএনপি এই অবস্থান থেকে সরে এসে হেফাজত-জামায়াতের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে 'গণজাগরণ মঞ্চে'র সমালোচনা করেছে। এই শ্বেতপত্রে হেফাজতপ্রধান আহমদ শফীর বহুল আলোচিত খোলা চিঠির পাশাপাশি এ বিষয়ে গণজাগরণ মঞ্চের বক্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে।
এই খোলা চিঠির ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি, যা তারা ঘোষণা করেছেন ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচী পালনের সময় মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সমাবেশে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, তাদের ১৩ দফা দাবি মানা না হলে তারা সরকারপতনের ১ দফা আন্দোলন আরম্ভ করবেন, যার মহড়া আমরা ৫ মে দেখেছি।
হেফাজতের ১৩ দফার অধিকাংশ দাবি জামায়াতে ইসলামীর, যা তারা দীর্ঘকাল ধরে বলছে। এসব দাবির ভেতর আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, কাদিয়ানীদের সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষণা, নারীনীতি বাতিল করা, সংবিধানে আল্লাহ-র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্¯'াপন করা, রাজধানী ঢাকা ও অন্যত্র ভাস্কর্যের নামে মূর্তি নির্মাণ বন্ধ, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ প্রভৃতি জামায়াত নেতাদের বিভিন্ন ভাষণে ও ওয়াজে সব সময় শোনা যায়।
১৩ দফার প্রধান দাবি হচ্ছে আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননার জন্য মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে আইন অর্থাৎ 'ব্লাসফেমি আইন' পাস করতে হবে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত কারাগারে অন্তরীণ জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ১৯৯৩ সালে জাতীয় সংসদে এই একই দাবি জানিয়ে একটি বিল জমা দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকার গ্রহণ করেনি। এর কয়েক মাস আগে ১৯৯২-এর নবেম্বরে জামায়াতে ইসলামী কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিরীহ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ, পাঠাগার, দফতর ধ্বংস করেছিল।
জামায়াত যখন কোণঠাসা হয় তখনই তারা 'কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা' কিংবা 'ব্লাসফেমি আইন পাস' করার জন্য হৈচৈ করে। এই জামায়াত যখন ক্ষমতায় থাকে তখন এসব বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করে না। যে নিজামী ১৯৯৩ সালে জাতীয় সংসদে 'ব্লাসফেমি আইন' প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন ২০০১-এর খালেদা জিয়ার কৃপায় মন্ত্রী হয়ে এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। একইভাবে জামায়াত আহমদীয়াদের ওপর হামলা, হত্যা, নির্যাতন অব্যাহত রাখলেও ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের কাফের ঘোষণার উদ্যোগ নেয়নি। কারণ জামায়াত জানে এই দাবি পূরণের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং এটি জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদেরও পরিপন্থী। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে বা বিদেশে এসব মানবাধিকারবিরোধী দাবি কাউকে গেলানো যাবে না; বাড়াবাড়ি করলে পরিণাম যে জামায়াতের জন্য সুখকর হবে না এ বিষয়ে মন্ত্রী নিজামীরা সম্যকরূপে অবগত আছেন।
(অসমাপ্ত)
বিভিন্ন সময়ে এসব মাদ্রাসা থেকে জঙ্গী রিক্রুট করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো, জিহাদের নামে সন্ত্রাস শিক্ষাদান, মাদ্রাসায় বোমা ও অন্যান্য মারণাস্ত্র বানানো, অনৈতিক কার্যকলাপ প্রভৃতি বিষয়ে জাতীয় দৈনিকসমূহে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও আহমদ শফীদের অনড় অবস্থানের কারণে কওম মাদ্রাসায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি কোনটাই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। আবাসিক মাদ্রাসা শিক্ষকদের অপরিসীম ক্ষমতার দাপটে ছাত্ররা একরকম বন্দী বা দাসত্বের জীবনযাপন করে। একজন মাদ্রাসা ছাত্রের সবকিছু তার ওস্তাদ বা শিক্ষকের হাতে। শিক্ষক ছাত্রের প্রতি প্রসন্ন না হলে তার সনদ মিলবে না, এমনকি তাকে মাদ্রাসা থেকেও বহিষ্কার করা যাবে। বেত্রাঘাত সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ হলেও এসব মাদ্রাসায় নয়। শুধু বেত্রাঘাত নয়, আরও অনেক কঠিন শারীরিক ও মানসিক শাস্তি 'অবাধ্য' ছাত্রকে প্রদান করা হয়। ছাত্রদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণও অনেক মাদ্রাসায় নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিবাদ করলে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার, এমন কি হত্যার ঘটনাও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, যার উল্লেখ এই শ্বেতপত্রেও রয়েছে।
শিক্ষকদের রাজনৈতিক এবং যৌন অভিলাষ চরিতার্থ করা মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং দলীয় ক্যাডারদের শক্তি একত্রিত করে ৫ মে সরকার উৎখাতের উদ্যোগ সম্ভব হয়েছিল।
দেশের কওমী মাদ্রাসায় পাঠ্যসূচীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোন স্থান নেই। এসব মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিষিদ্ধ। বড় বড় মাদ্রাসায় ছাত্ররা বাংলায় কোন দরখাস্ত লিখতে পারে না। দরখাস্ত লিখতে হয় আরবী অথবা উর্দুতে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিগতভাবে অনগ্রসর গ্রামের অসচ্ছল পরিবার থেকে যে কোমলমতি বালকরা মাদ্রাসায় পড়তে আসে তাদের কাছে অদৃশ্য আজরাইলের চেয়ে দৃশ্যমান ওস্তাদ অনেক ভয়ঙ্কর। ওস্তাদের যে কোন নির্দেশ তাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। জামায়াত-বিএনপির সহযোগিতা এবং ছাত্রদের এই অন্ধত্ব ও আনুগত্য হেফাজতের নেতাদের ৬ এপ্রিল ও ৫ মের মতো চরম উচ্চাভিলাষী কর্মসূচী প্রদানে প্রলুব্ধ করেছে। হেফাজতের অনেক নেতা আফগান জিহাদে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, ক্ষমতার স্বাদ যাদের অজানা নয়। যে কারণে তারা ৫ মে আফগান ও ইরান স্টাইলে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াত-বিএনপির টোপ সাগ্রহে গলাধঃকরণ করেছিলেন।
সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য জামায়াত ও হেফাজতের নেতারা গণজাগরণ মঞ্চের অভূতপূর্ব আন্দোলনকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল। মাদ্রাসার ছাত্রদের এবং সাধারণ মানুষকে আল্লাহ ও রাসুলের (সাঃ) অবমাননার কথা বলে সহজে যে উত্তেজিত করা যায় এই অভিজ্ঞতা জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী) নেতাদের রয়েছে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার সময় জামায়াত আবার তা যাচাই করেছে। উত্তম বড়ুয়া নামের বএক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে কীভাবে জালিয়াতি করে একজন শিবিরকর্মী কোরান অবমাননার ছবি সেঁটে দিয়েছিল এ বিষয়ে সে সময়ে জাতীয় দৈনিকসমূহে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে। মহানবীর (সাঃ) প্রতি বিদ্রƒপ বা উপহাসের ঘটনা ইউরোপে ঘটলেও এ নিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের তা-ব সৃষ্টি করা যায় এ অভিজ্ঞতাও জামায়াত-হেফাজতের নেতাদের রয়েছে।
১৯৯২-৯৩ সালে জামায়াতীরা 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র শীর্ষ নেতাদের 'নাস্তিক', 'মুরতাদ', 'ভারতের এজেন্ট', 'ইসলামের দুষমন' ইত্যাদি বলে বিএনপি সরকারকে দিয়ে জাহানারা ইমামকে পিটিয়ে সংজ্ঞাহীন করেছিল। ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার অজুহাত সৃষ্টির জন্য একইভাবে জামায়াত তাদের 'দুষ্কৃতকারী', 'ইসলামের দুষমন', 'ভারতের এজেন্ট' ইত্যাদি বলত। জামায়াত-হেফাজতের নেতারা সেই একই কৌশল অবলম্বন করেছেন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তরুণ নেতাদের হত্যা ও লাঞ্ছিত করবার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য।
চার
হাটহাজারীর শফী-বাবুনগরীর হেফাজতে ইসলাম ২০১০-এর জানুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করলেও রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপের নিচে এসেছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হওয়ার চৌদ্দ দিন পর। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি (২০১৩) জামায়াত-বিএনপির দৈনিক 'নয়া দিগন্ত', 'আমার দেশ', 'দিনকাল' ও 'সংগ্রাম'-এ প্রথম পাতায় অর্ধপৃষ্ঠা জুড়ে হেফাজতপ্রধান আহমদ শফীর এক খোলা চিঠি ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা শতাধিক। এর ভেতর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপত্র অর্ধ ডজনের বেশি নয়। খোলা চিঠি প্রকাশের জন্য 'অরাজনৈতিক' সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রধান জামায়াত ও বিএনপির মুখপত্রকেই বেছে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি মনে করেন রাজনৈতিক প্রয়োজনে তার মতে ইসলামবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা জায়েজ। এই শ্বেতপত্রে আমরা দেখব এককালের জামায়াতবিরোধী হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলাম কীভাবে জামায়াতের দেহে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
জামায়াত ও বিএনপির দৈনিকে আহমদ শফীর খোলা চিঠির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল শাহবাগের 'গণজাগরণ মঞ্চে'র আন্দোলন এবং এর তরুণ নেতৃত্ব। এর সঙ্গে তিনি 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র নেতা বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, মানবাধিকার আন্দোলনের পুরোগামী নেতা অধ্যাপক অজয় রায় ও জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতিও বিষোদ্গার করেছেন গণজাগরণ মঞ্চকে পৃষ্ঠপোষকতা করবার জন্য। তিনি গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে কাদিয়ানীদের সম্পৃক্তি আবিষ্কার করেছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গেও কাদিয়ানীদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছেন।
হেফাজতপ্রধান মওলানা শাহ্ আহ্মদ শফীকে অনেকে শ্রদ্ধা করেন বুযুর্গ আলেম হিসেবে। তিনি যখন কোন কথা বলেন, কিংবা লিখিতভাবে মতপ্রকাশ করেন সেখানে কোন মিথ্যাচার বা শঠতা কেউ আশা করে না। 'গণজাগরণ মঞ্চ'-এর অন্দোলন আরম্ভ হওয়ার ছয় মাস আগে বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী তাঁর নাতনির চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন এবং দেশে ফিরেছেন এক বছর পর। তাঁকে কেউ 'গণজাগরণ মঞ্চে' দেখছে এমন কথা বলবার মতো একজন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। 'গণজাগরণ মঞ্চ' যখন আরম্ভ হয় তখন শাহরিয়ার কবিরও দেশে ছিলেন না। তবে লাখ লাখ ছাত্র জনতার মতো তিনি, মুনতাসীর মামুন, অজয় রায় ও জাফর ইকবালও কয়েকবার 'গণজাগরণ মঞ্চে'র সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য গিয়েছিলেন। 'গণজাগরণ মঞ্চ' থেকে ১১ জন কাদিয়ানীকে গ্রেফতার করা হয়েছে আহমদ শফীর এ দাবিও সম্পূর্ণ মিথ্যা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবিতে 'গণজাগরণ মঞ্চ'-এর সমাবেশ যখন একটানা একুশ দিন অব্যাহত ছিল তখন এমন কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ ছিল না সেখানে যায়নি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত-লিঙ্গ-বয়স নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সকল মানুষ শাহবাগে এবং তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত শত শত গণজাগরণ মঞ্চে সমবেত হয়ে জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সন্তানদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও হাফেজ মওলানা জিয়াউল হাসানের মতো বহু বরেণ্য আলেম-ওলামা এবং ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ 'গণজাগরণ মঞ্চে' এসে সন্তানতুল্য তরুণদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাদের জন্য দোয়া করেছেন। এমন কি প্রথম দিকে বিএনপির কয়েকজন নেতা এসেও 'গণজাগরণ মঞ্চে'র সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। তখন বিএনপি বলেছে 'গণজাগরণ মঞ্চ' তাদের ছয় দফা দাবির সঙ্গে সরকারের দুর্নীতিসহ বিএনপির কিছু দাবি যুক্ত করলে এর আবেদন আরও বাড়ত। অবশ্য পরে বিএনপি এই অবস্থান থেকে সরে এসে হেফাজত-জামায়াতের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে 'গণজাগরণ মঞ্চে'র সমালোচনা করেছে। এই শ্বেতপত্রে হেফাজতপ্রধান আহমদ শফীর বহুল আলোচিত খোলা চিঠির পাশাপাশি এ বিষয়ে গণজাগরণ মঞ্চের বক্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে।
এই খোলা চিঠির ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি, যা তারা ঘোষণা করেছেন ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচী পালনের সময় মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সমাবেশে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, তাদের ১৩ দফা দাবি মানা না হলে তারা সরকারপতনের ১ দফা আন্দোলন আরম্ভ করবেন, যার মহড়া আমরা ৫ মে দেখেছি।
হেফাজতের ১৩ দফার অধিকাংশ দাবি জামায়াতে ইসলামীর, যা তারা দীর্ঘকাল ধরে বলছে। এসব দাবির ভেতর আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, কাদিয়ানীদের সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষণা, নারীনীতি বাতিল করা, সংবিধানে আল্লাহ-র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্¯'াপন করা, রাজধানী ঢাকা ও অন্যত্র ভাস্কর্যের নামে মূর্তি নির্মাণ বন্ধ, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ প্রভৃতি জামায়াত নেতাদের বিভিন্ন ভাষণে ও ওয়াজে সব সময় শোনা যায়।
১৩ দফার প্রধান দাবি হচ্ছে আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননার জন্য মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে আইন অর্থাৎ 'ব্লাসফেমি আইন' পাস করতে হবে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত কারাগারে অন্তরীণ জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ১৯৯৩ সালে জাতীয় সংসদে এই একই দাবি জানিয়ে একটি বিল জমা দিয়েছিলেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকার গ্রহণ করেনি। এর কয়েক মাস আগে ১৯৯২-এর নবেম্বরে জামায়াতে ইসলামী কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিরীহ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ, পাঠাগার, দফতর ধ্বংস করেছিল।
জামায়াত যখন কোণঠাসা হয় তখনই তারা 'কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা' কিংবা 'ব্লাসফেমি আইন পাস' করার জন্য হৈচৈ করে। এই জামায়াত যখন ক্ষমতায় থাকে তখন এসব বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করে না। যে নিজামী ১৯৯৩ সালে জাতীয় সংসদে 'ব্লাসফেমি আইন' প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন ২০০১-এর খালেদা জিয়ার কৃপায় মন্ত্রী হয়ে এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। একইভাবে জামায়াত আহমদীয়াদের ওপর হামলা, হত্যা, নির্যাতন অব্যাহত রাখলেও ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের কাফের ঘোষণার উদ্যোগ নেয়নি। কারণ জামায়াত জানে এই দাবি পূরণের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং এটি জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদেরও পরিপন্থী। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে বা বিদেশে এসব মানবাধিকারবিরোধী দাবি কাউকে গেলানো যাবে না; বাড়াবাড়ি করলে পরিণাম যে জামায়াতের জন্য সুখকর হবে না এ বিষয়ে মন্ত্রী নিজামীরা সম্যকরূপে অবগত আছেন।
(অসমাপ্ত)
রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০১৩, ২৬ কার্তিক ১৪২০
Also Read:
হেফাজতের আড়ালে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ছিল জামায়াত-বিএনপির - ১
নির্মূল কমিটির গণকমিশনের শ্বেতপত্রের সারাংশ ও সুপারিশ
২০১৩-এর ৬ এপ্রিল ও ৫ মে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার শাপলা চত্বরে '
শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৩, ২৫ কার্তিক ১৪২০
__._,_.___