শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৩, ২৩ অগ্রহায়ন ১৪২০
বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদের উদ্ভব ॥ ইউরোপীয় ইউনিয়ন কখনই বরদাশত করবে না
শুনানিতে হোস্ট এমপি মিস লাইমা ও মিস মেইরিডের মন্তব্য
এনা, নিউইয়র্ক থেকে ॥ বেলজিয়ামে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কনফারেন্স রুমে (৬ কিউ ২) ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে অনুষ্ঠিত এক শুনানিতে বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতির অবসানে প্রধান দুই জোটের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের তাগিদ এবং পারস্পরিক সমঝোতায় সবার অংশগ্রহণে সামনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু করার কথা ব্যক্ত করা হয়। অন্যথায় বাংলাদেশ আবারও জঙ্গীবাদের কবলে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। শুনানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হোস্ট এমপি মিস লাইমা ও মিস মেইরিড বলেন, বাংলাদেশে গোটা দেশজুড়ে ইসলামী জঙ্গীরা একই সময়ে বোমাবাজি করে। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরদাশত করবে না। শুনানির পর মিলনায়তনের বাইরে বিএনপির একদল কর্মী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিটির কো-চেয়ার এইচটি ইমাম এবং সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা চালায়।
ইউরোপিয়ান পিপুলস পার্টির (ইপিপি) ব্যানারে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির প্রভাবশালী সদস্য লাইমা এ্যান্ড্রিকজিনা এ শুনানির আয়োজন করেন 'বাংলাদেশ : অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের পথে' শিরোনামে। দুইপর্বে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এ শুনানিতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচটি ইমাম এবং ড. মশিউর রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান। অপরদিকে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, মোহিদুর রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা এমএ মালেক। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন ইপিপির ভাইস চেয়ারম্যান মেইরিড ম্যাকগিনিস এমপি এবং লিথুয়ানিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি টমাস সিকরসকিস। প্রথমপর্বের বিষয় ছিল 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি : এখন কী করা দরকার? নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি দিতে পারবে?'
এ পর্বে হোস্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমন্ত্রণে প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা এবং বাংলাদেশ ইনফরমেশন কমিশনের কমিশনার ড. সাদেকা হালিম এবং বিএনপির ড. আসাদুজ্জামান রিপন। সঞ্চালনায় ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে অর্থনীতি সম্পর্কিত কমিটির ভাইস চেয়ার পাবলো জালবা বিজেগেইন।
দ্বিতীয়পর্বের বিষয় ছিল 'বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ কিভাবে সুগম করতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।' এটির সঞ্চালন করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির সদস্য লাইমা লিউসিজা এ্যান্ড্রিকিয়েন এমপি। মতামত ব্যক্ত করেন চলতি বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক টিমের প্রধান মাইকেল গ্যাহলার, ইউরোপিয়ান এক্সনারনাল এ্যাকশন সার্ভিসের ডেমক্র্যাসি এ্যান্ড ইলেকশন অবজার্ভেশন ডিভিশনের কর্মকর্তা ব্যালথাসার বেঞ্জ, দক্ষিণ এশিয়া গণতান্ত্রিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাউলো ক্যাসাকা এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান।
বাংলাদেশের ওপর এ দুটি আলোচনার সমন্বয় করেন লাইমা এ্যান্ড্রিকজিনা এমপি। এছাড়া আরও অন্তত ৭ এমপি ফ্লোরে ছিলেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এ আলোচনায় সার্বিক পরিস্থিতি উপস্থাপনের সময় প্রথমেই বাধার সম্মুখীন হন ড. সাদেকা হালিম। গত ৫ বছরে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকপাতকালে মহাজোট সরকারের প্রশংসা করলে উপস্থিত বিএনপির লোকজন হইচই করেন। সাদেকা হালিম এ সময় বলেছেন, তাঁকে সরকার পাঠায়নি কিংবা সরকারী খরচেও আসেননি। আয়োজকরাই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ড. সাদেকা হালিম উল্লেখ করেন, সামনের নির্বাচন নিয়ে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, তা অনভিপ্রেত এবং এটি গণতন্ত্রের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। ড. সাদেকা বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে নির্বাচনের আগে এবং পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কিভাবে নিগৃহীত হয়েছে, তা কারও অজানা নেই। সে সময়ও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে যা বুঝায় সেটি নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। বিচারের রায় প্রকাশিত হয়েছে। এ বিচারকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অথচ বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করছে না। ড. সাদেকা বলেন, সর্বোপরী বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন জনসাধারণ। তাঁরা যা চাইবেন সেভাবেই সবকিছু হবে বাংলাদেশে এবং সামনের নির্বাচনেও জনমতেরই প্রতিফলন ঘটবে। তবে জনগণকে অবাধে মতামত প্রকাশের পরিবেশ তৈরির জন্য বিরোধী দলেরও দায়িত্ব রয়েছে। এর পর এইচটি ইমাম তাঁর বক্তব্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করে বলেন, এক সময় সে ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। এখন তার দরকার নেই। কারণ গত ৪ বছরে প্রায় ৭ হাজার সংস্থার নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে, যা নিয়ে কেউ কোন আপত্তি তুলেনি। তাই সামনের জাতীয় নির্বাচনও ওই একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে হবে- এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। এইচটি ইমাম বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বিএনপি-জামায়াতের হিংসাত্মক আচরণকে দায়ী করেন এবং বলেন, সরকার শক্ত হাতে তা প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে। তিনি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজে তার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে না। ফ্লোর থেকে সাবের হোসেন চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে কোন কোন মহল নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যাদের আচরণে ধর্মীয় কোন বালাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না- তেমন লোকজন ধর্মের নামে অরাজক অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় বাংলাদেশ সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মকা-ের নামে সেই সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদকে আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে সংশিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি। কারণ গণতন্ত্র এবং জঙ্গীবাদ কখনই একত্রে চলতে পারে না। বর্তমান সরকার কখনই জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। ড. সিদ্দিকুর রহমান বিএনপি-জামায়াতকে গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ওরা হরতালের নামে সারা বাংলাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবতারণা করেছে। ওরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অভিপ্রায়ে নাশকতামূলক কাজ করছে।
বিএনপি নেতা ড. আসাদুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে রামুর ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বার বার আক্রান্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী দ্বারা।
হোস্ট এমপি মিস লাইমা এবং মিস মেইরিড তাদের মতামতে বলেন, সহিংসতা পরিহার করে গঠনমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পথ বের করতে হবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে। বর্তমানের সংঘাত দেশকে আরও অবনতির পথে নিয়ে যায়- এমন সমস্ত কর্মসূচী থেকেও বিরত হওয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের। বিগত বছরগুলোতে ইসলামিক সন্ত্রাসীরা নানাভাবে আক্রমণ চালায় বাংলাদেশে। ওদের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের হাইকমিশনার। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের হত্যার ষড়যন্ত্রে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এছাড়া মারা গেছেন কয়েক এমপি ওই সন্ত্রাসী হামলায়। শুধু তাই নয়, প্রায় একই সময় সারা বাংলাদেশে ইসলামিক জঙ্গীরা বোমাবাজি করেছে। হামলা করেছে বিচারকের ওপর। এ সব নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ ছিল সব সময়। তেমন কোন পরিস্থিতি আবার তৈরি হতে পারে- এমন কিছুকে কখনই বরদাশত করবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ সময় মিস লাইমা উল্লেখ করেন, 'বাংলাদেশ আবারও খাদের কিনারে পৌঁছেছে। সামনের নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যকার বিরোধের অবসানে ফলপ্রসূ সংলাপ না হলে বাংলাদেশ আবারও মারাত্মক একটি সঙ্কটে নিপতিত হতে পারে।' তিনি উল্লেখ করেন, 'বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকরী সংলাপের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে হবে এবং একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিও অনুসরণ করতে হবে। একইভাবে, বিরোধী দল বা জোটকেও প্রতিবাদের নামে সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে, যা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।' ইপিপির ভাইস চেয়ারম্যান মেইরিড ম্যাকগিনিস এমপি তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করার স্বার্থে অবশ্যই অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে চমতকার একটি নির্বাচনের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক অস্থিতি এবং অনিশ্চয়তা সব সময়ই উন্নয়ন-অগ্রগতির শত্রু হিসেবে বিবেচিত, এ জন্যই আমরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে সব সময় কথা বলে আসছি। যদিও উভয়পক্ষ নিজ নিজ মতবাদের প্রতি অনড় থাকায় গত কয়েক দিনে কমপক্ষে ৩০ ব্যক্তির প্রাণ গেছে। এ ছাড়া আরও শ' শ' মানুষ আহত হয়ে হাসপাতাল-ক্লিনিকে কাতরাচ্ছে। আর এ ধরনের সহিংস আচরণের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের গরিব আর অসহায় নারী-পুরুষরা।
শুনানির সময় বিএনপির লোকজনের আচরণকে সভ্যতার পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করে বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের নেতা বজলুর রশিদ বুলু টেলিফোনে এ সংবাদদাতাকে বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়নের এমপিরা প্রত্যক্ষ করেছেন ওদের আচরণ। এতে বিএনপির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশে বিএনপি আন্দোলনের নামে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে- এটি বুঝতে আর বাকি থাকল না ইউরোপীয় ইউনিয়নের এমপিদের।'
ইউরোপিয়ান পিপুলস পার্টির (ইপিপি) ব্যানারে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির প্রভাবশালী সদস্য লাইমা এ্যান্ড্রিকজিনা এ শুনানির আয়োজন করেন 'বাংলাদেশ : অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের পথে' শিরোনামে। দুইপর্বে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এ শুনানিতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচটি ইমাম এবং ড. মশিউর রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান। অপরদিকে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, মোহিদুর রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা এমএ মালেক। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন ইপিপির ভাইস চেয়ারম্যান মেইরিড ম্যাকগিনিস এমপি এবং লিথুয়ানিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি টমাস সিকরসকিস। প্রথমপর্বের বিষয় ছিল 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি : এখন কী করা দরকার? নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি দিতে পারবে?'
এ পর্বে হোস্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমন্ত্রণে প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা এবং বাংলাদেশ ইনফরমেশন কমিশনের কমিশনার ড. সাদেকা হালিম এবং বিএনপির ড. আসাদুজ্জামান রিপন। সঞ্চালনায় ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে অর্থনীতি সম্পর্কিত কমিটির ভাইস চেয়ার পাবলো জালবা বিজেগেইন।
দ্বিতীয়পর্বের বিষয় ছিল 'বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ কিভাবে সুগম করতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।' এটির সঞ্চালন করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে মানবাধিকার বিষয়ক সাব কমিটির সদস্য লাইমা লিউসিজা এ্যান্ড্রিকিয়েন এমপি। মতামত ব্যক্ত করেন চলতি বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক টিমের প্রধান মাইকেল গ্যাহলার, ইউরোপিয়ান এক্সনারনাল এ্যাকশন সার্ভিসের ডেমক্র্যাসি এ্যান্ড ইলেকশন অবজার্ভেশন ডিভিশনের কর্মকর্তা ব্যালথাসার বেঞ্জ, দক্ষিণ এশিয়া গণতান্ত্রিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাউলো ক্যাসাকা এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান।
বাংলাদেশের ওপর এ দুটি আলোচনার সমন্বয় করেন লাইমা এ্যান্ড্রিকজিনা এমপি। এছাড়া আরও অন্তত ৭ এমপি ফ্লোরে ছিলেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এ আলোচনায় সার্বিক পরিস্থিতি উপস্থাপনের সময় প্রথমেই বাধার সম্মুখীন হন ড. সাদেকা হালিম। গত ৫ বছরে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকপাতকালে মহাজোট সরকারের প্রশংসা করলে উপস্থিত বিএনপির লোকজন হইচই করেন। সাদেকা হালিম এ সময় বলেছেন, তাঁকে সরকার পাঠায়নি কিংবা সরকারী খরচেও আসেননি। আয়োজকরাই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ড. সাদেকা হালিম উল্লেখ করেন, সামনের নির্বাচন নিয়ে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, তা অনভিপ্রেত এবং এটি গণতন্ত্রের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। ড. সাদেকা বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে নির্বাচনের আগে এবং পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কিভাবে নিগৃহীত হয়েছে, তা কারও অজানা নেই। সে সময়ও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে যা বুঝায় সেটি নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছিল। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। বিচারের রায় প্রকাশিত হয়েছে। এ বিচারকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অথচ বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করছে না। ড. সাদেকা বলেন, সর্বোপরী বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন জনসাধারণ। তাঁরা যা চাইবেন সেভাবেই সবকিছু হবে বাংলাদেশে এবং সামনের নির্বাচনেও জনমতেরই প্রতিফলন ঘটবে। তবে জনগণকে অবাধে মতামত প্রকাশের পরিবেশ তৈরির জন্য বিরোধী দলেরও দায়িত্ব রয়েছে। এর পর এইচটি ইমাম তাঁর বক্তব্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করে বলেন, এক সময় সে ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। এখন তার দরকার নেই। কারণ গত ৪ বছরে প্রায় ৭ হাজার সংস্থার নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে, যা নিয়ে কেউ কোন আপত্তি তুলেনি। তাই সামনের জাতীয় নির্বাচনও ওই একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে হবে- এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। এইচটি ইমাম বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বিএনপি-জামায়াতের হিংসাত্মক আচরণকে দায়ী করেন এবং বলেন, সরকার শক্ত হাতে তা প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে। তিনি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজে তার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে না। ফ্লোর থেকে সাবের হোসেন চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে কোন কোন মহল নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যাদের আচরণে ধর্মীয় কোন বালাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না- তেমন লোকজন ধর্মের নামে অরাজক অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় বাংলাদেশ সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মকা-ের নামে সেই সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদকে আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে সংশিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি। কারণ গণতন্ত্র এবং জঙ্গীবাদ কখনই একত্রে চলতে পারে না। বর্তমান সরকার কখনই জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। ড. সিদ্দিকুর রহমান বিএনপি-জামায়াতকে গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ওরা হরতালের নামে সারা বাংলাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবতারণা করেছে। ওরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অভিপ্রায়ে নাশকতামূলক কাজ করছে।
বিএনপি নেতা ড. আসাদুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে রামুর ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বার বার আক্রান্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী দ্বারা।
হোস্ট এমপি মিস লাইমা এবং মিস মেইরিড তাদের মতামতে বলেন, সহিংসতা পরিহার করে গঠনমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পথ বের করতে হবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে। বর্তমানের সংঘাত দেশকে আরও অবনতির পথে নিয়ে যায়- এমন সমস্ত কর্মসূচী থেকেও বিরত হওয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের। বিগত বছরগুলোতে ইসলামিক সন্ত্রাসীরা নানাভাবে আক্রমণ চালায় বাংলাদেশে। ওদের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের হাইকমিশনার। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের হত্যার ষড়যন্ত্রে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এছাড়া মারা গেছেন কয়েক এমপি ওই সন্ত্রাসী হামলায়। শুধু তাই নয়, প্রায় একই সময় সারা বাংলাদেশে ইসলামিক জঙ্গীরা বোমাবাজি করেছে। হামলা করেছে বিচারকের ওপর। এ সব নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ ছিল সব সময়। তেমন কোন পরিস্থিতি আবার তৈরি হতে পারে- এমন কিছুকে কখনই বরদাশত করবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ সময় মিস লাইমা উল্লেখ করেন, 'বাংলাদেশ আবারও খাদের কিনারে পৌঁছেছে। সামনের নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যকার বিরোধের অবসানে ফলপ্রসূ সংলাপ না হলে বাংলাদেশ আবারও মারাত্মক একটি সঙ্কটে নিপতিত হতে পারে।' তিনি উল্লেখ করেন, 'বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকরী সংলাপের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে হবে এবং একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিও অনুসরণ করতে হবে। একইভাবে, বিরোধী দল বা জোটকেও প্রতিবাদের নামে সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে, যা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।' ইপিপির ভাইস চেয়ারম্যান মেইরিড ম্যাকগিনিস এমপি তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে নিরাপদ করার স্বার্থে অবশ্যই অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে চমতকার একটি নির্বাচনের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক অস্থিতি এবং অনিশ্চয়তা সব সময়ই উন্নয়ন-অগ্রগতির শত্রু হিসেবে বিবেচিত, এ জন্যই আমরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে সব সময় কথা বলে আসছি। যদিও উভয়পক্ষ নিজ নিজ মতবাদের প্রতি অনড় থাকায় গত কয়েক দিনে কমপক্ষে ৩০ ব্যক্তির প্রাণ গেছে। এ ছাড়া আরও শ' শ' মানুষ আহত হয়ে হাসপাতাল-ক্লিনিকে কাতরাচ্ছে। আর এ ধরনের সহিংস আচরণের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের গরিব আর অসহায় নারী-পুরুষরা।
শুনানির সময় বিএনপির লোকজনের আচরণকে সভ্যতার পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করে বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের নেতা বজলুর রশিদ বুলু টেলিফোনে এ সংবাদদাতাকে বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়নের এমপিরা প্রত্যক্ষ করেছেন ওদের আচরণ। এতে বিএনপির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশে বিএনপি আন্দোলনের নামে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে- এটি বুঝতে আর বাকি থাকল না ইউরোপীয় ইউনিয়নের এমপিদের।'
শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৩, ২৩ অগ্রহায়ন ১৪২০
__._,_.___