উন্নয়নের বিস্ময় বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অগ্রগতি উদাহরণ দেওয়ার মতোই। অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়াকে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে ছাড়িয়েছে তো অনেক আগেই।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত সপ্তাহেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, একটি জনবহুল ও নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেভাবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূর এবং বৈষম্য কমানোকে সংযুক্ত করেছে, তা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি দেশ।
আবার আরেকটি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক একটি টেবিল উপস্থাপন করে দেখিয়েছে, প্রধান ১২টি সূচকের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্য নিম্ন আয়ের দেশের তুলনায় এগিয়ে গেছে বা যাচ্ছে।
তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের বড় ধরনের সাফল্য থাকলেও রাজনীতি চলছে ঠিক উল্টো পথে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির অভাবে অর্থনীতির সাফল্য পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। অচল হয়ে পড়ছে দেশের অর্থনীতি, কমছে প্রবৃদ্ধি। ফলে সামাজিক সূচকগুলোও হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। এ রকম এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যেই নতুন বছরে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের শুরুতে অর্থনীতি নিয়ে ইতিবাচক ভাবনার সুযোগ খুব নেই। হরতাল-অবরোধের সাময়িক ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই, তবে বিগত প্রায় দুই দশকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কতখানি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময়: গত দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যেকোনো সূচকের বিচারে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০-এর পর সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। দারিদ্র্যের হার অর্ধেক হয়ে গেছে। মেয়েদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদানের হার দ্রুত বেড়েছে, জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার, সক্ষম দম্পতিদের জন্মনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গ্রহণের হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকে পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য যে বেশি, নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তা বারবার লিখেছেন। তিনি তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যান আনসারটেইন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশনস বইয়ে বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ও রেখেছেন।
বিশ্বব্যাংকের তৈরি করা তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এখন গড় মাথাপিছু আয় হচ্ছে ৫২৮ ডলার। আর দক্ষিণ এশিয়ার গড় আয় এক হাজার ১৭৬ ডলার। এক হাজার ৪৪ ডলার নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে প্রায় ধরে ফেলেছে বাংলাদেশ। সাফল্য আছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারেও। বাংলাদেশে এখন এই হার মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ আর দক্ষিণ এশিয়ার গড় ১ দশমিক ৪ শতাংশ। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই গড় অনেক বেশি, ২ দশমিক ১ শতাংশ।
স্বাধীনতার ঠিক পরেই দেশের মানুষ গড়ে বেঁচে থাকত ৪৬ বছর, এখন সেই গড় ৬৯ বছর। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার গড় হচ্ছে ৬৫ বছর। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এক হাজার নবজাতকের মধ্যে মারা যায় ৭০ জন, দক্ষিণ এশিয়ায় ৫২, আর বাংলাদেশে ৩৫ জন। মেয়েরা সবচেয়ে বেশি স্কুলে যায় এই বাংলাদেশেই। বাংলাদেশ কেবল পিছিয়ে আছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের এই অর্জন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ শুধু যে মুসলিমপ্রধান দেশ, তা নয়, এটি উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত এমন একটি অঞ্চলের অংশ, যেখানে রয়েছে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এ কারণে বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের এই অগ্রগতিকে একটি 'উন্নয়ন বিস্ময়' বলে আখ্যায়িত করা হয়। এর পেছনে কাজ করেছে জনগণের উন্নয়ন-সচেতনতা, গোত্র-বর্ণ ভেদাভেদহীন সমাজ এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর নানা কার্যকর কর্মসূচি ও সামাজিক উদ্যোগ।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন আরও বলেন, মাঠপর্যায়ের এসব কর্মসূচির মাধ্যমেই দেশের মানুষ নানা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্ক, তা দেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় উপাদান হিসেবে তেমন কাজ করেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন ধর্মের নতুন করে রাজনৈতিকীকরণ বাংলাদেশের সামাজিক বিপ্লবকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
ঝুঁকির মধ্যে দেশ: ১৯৯০ এর দশকেও বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। এখন করছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বলছে, ৬ শতাংশ হারে অব্যাহত প্রবৃদ্ধি অর্জন গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করেছে। মূলত ৮০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো আয়, তৈরি পোশাক খাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এবং কৃষির সবুজ বিপ্লব বা এক জমিতে দুই ফসল দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। আবার সরকারও পিছিয়ে পড়া ও অতিদরিদ্রদের জন্য সামাজিক কর্মসূচি খাতে অব্যাহতভাবে বাজেট বাড়িয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশ অতি দরিদ্র মানুষ এখন এই কর্মসূচির আওতায়। এ খাতে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অংশ হিসেবে যে অর্থ ব্যয় করছে, তা বড় অর্থনীতির দেশ ভারতের সমপর্যায়ের। নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এর চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যয় করে।
বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের জন্য নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইএমএফও বলছে, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান মূলত মেয়েদের লক্ষ্য করে ক্ষুদ্রঋণ দেয়। আরও রয়েছে ব্র্যাকের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করার কারণে মেয়েদের সন্তান জন্ম দেওয়ার হার কমে যাওয়ায় তাঁরা এখন অনেক বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছেন। ফলে পরিবারের সদস্যসংখ্যা নির্ধারণে মেয়ের ভূমিকাও বেড়েছে। পোশাক খাতের ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। এঁরাই বাংলাদেশকে অনেকখানি এগিয়ে নিচ্ছেন।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) ঠিক করা হয়েছিল ১৯৯০ সালে। বাংলাদেশও ওই সময় থেকেই ক্রমান্বয়ে এগিয়েছে। এমডিজি পূরণের বছর ২০১৫। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আটটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বাংলাদেশ এরই মধ্যে অনেকগুলোতে সঠিক পথে আছে, কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। বয়স্ক শিক্ষার হার বাড়ানোর মতো কিছু বিষয়ে পিছিয়ে আছে। এমডিজি পূরণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে একটি উদাহরণ।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, এত অর্জনের পরও দিনে এক ডলারের কম আয় করে এমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখনো ৪৩ শতাংশ। যদিও তা ১৯৯০ সময়ে ছিল ৭০ শতাংশ। সুতরাং এখনো অনেক দূর যেতে হবে বাংলাদেশকে। আইএমএফ বলছে, বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ হয়ে যাবে। অর্থাৎ অর্থনীতির অগ্রগতি থমকে যাচ্ছে।
সামগ্রিক বিষয়ে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, এমন একটি সময়ে আমরা রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি, যখন দেশের অর্থনীতি একটি বড় ধরনের সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দরকার একটি শক্তিশালী জনসমর্থনমূলক সরকার। শুধু নিয়ম রক্ষার খাতিরে ৫ জানুয়ারি যে একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তার মাধ্যমে এ ধরনের জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শক্তিশালী সরকার গঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী দল কার্যত গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে থেকে যাবে। এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। সরকারের পক্ষেও শাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বলিষ্ঠ কোনো ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে না, কোনো রূপকল্প বাস্তবায়ন তো দূরের কথা।
http://www.prothom-alo.com/economy/article/112795/উন্নয়নের_বিস্ময়_বাংলাদেশ
__._,_.___