মালোপাড়ার আক্রান্ত হিন্দুপল্লী ॥ একটি সরেজমিন প্রতিবেদন
গোলাম কুদ্দুছ
৫ জানুয়ারি ২০১৪ ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দল, জাতীয় পার্টি, জেপি, তরিকত ফেডারেশন ও আরও কয়েকটি ছোট দল এই নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এবং অন্য কয়েকটি ছোট দল এ নির্বাচন বর্জন করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা এই নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাবার হুঁশিয়ারি দেয়। মানুষ যাতে ভোট কেন্দ্রে না যায় তার জন্য ভয়-ভীতি, হুমকি প্রদান ছাড়াও অবরোধের নামে সারাদেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। বাসে-ট্রেনে বোমা হামলা, আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারা, ভোটকেন্দ্রে আগুন লাগিয়ে দেয়া, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার হত্যা, পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ভোট বানচাল করার একটি প্রচেষ্টা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। অপরদিকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যে আবহে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো ও ভোটারকার্ড বিতরণ, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে আগ্রহী করে তোলার কাজগুলো নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে পরিচালনা করত-এবার দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে সেক্ষেত্রে শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। ফলে নির্বাচনী আমেজ বা উৎসবের পরিবেশ সেভাবে জমে ওঠেনি।
এমনি পরিস্থিতিতে ভোটের দিন নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি-জামায়াত জোটের আহ্বান উপেক্ষা করে যে সব ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয় তাদের উপর নানাভাবে হুমকি আসতে থাকে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসে মহাদুর্যোগ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুপল্লীতে আক্রমণ, বাড়ি-ঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, শারীরিকভাবে নির্যাতন, পাশবিক অত্যাচারের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। যশোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, নীলফামারী, গাইবান্ধায় এ হামলা-আক্রমণ ছিল ভয়াবহ। একটি স্বাধীন দেশে সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এ ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিন্দা, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু হয় দেশব্যাপী। ঘটনার জন্য গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন সংগঠন নির্বাচন প্রতিরোধকারী বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট দেশব্যাপী সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বর্বর আক্রমণের প্রতিবাদে ৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসিতে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে এবং কালো পতাকা মিছিল বের করে। সমাবেশের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দু'টি দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কিছু সহায়তা প্রদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করে। জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, মানজার চৌধুরী সুইট, বাদল চৌধুরী, সুমন ও সৌরভ সমন্বয়ে একটি দল ৯ জানুয়ারি রাতে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও রওনা হয়। ১০ তারিখ ভোরবেলা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুছ, আহমদ গিয়াস, শাহাদাৎ হোসেন নিপু, আরিফ রহমান, স্বপন চৌধুরী ও ওয়াসিম আহম্মেদ সমন্বয়ে আরেকটি দল যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু এলাকা পরিদর্শনে যায়। ঐদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে যা দেখেছি, বুঝেছি, অনুধাবন করেছি সৎভাবে দেশবাসীকে তা জানানোর তাগিদ থেকেই এই নিবন্ধ রচনা।
ক. ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিচয়
গ্রামের নাম চাপাতলি, ইউনিয়ন-প্রেমবাগ, উপজেলা- অভয়নগর, জেলা- যশোর। চাপাতলী গ্রামের পশ্চিমাংশে মুসলমান এবং পূর্বদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস। হিন্দু পরিবারের সংখ্যা ১১০টি এবং লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ শ'। হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মৎস্যজীবী। পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদে মাছধরা, পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ, ছোটখাটো ঘেরে মাছের আবাদ এবং মাছ ধরাই তাদের প্রধান পেশা। অধিকাংশ নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার। গ্রামের এই হিন্দুপল্লী 'মালোপাড়া'-নামে পরিচিত।
খ. হিন্দুপল্লীতে আক্রমণের সূত্রপাত ও ধরন
আক্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোট অনুষ্ঠিত হবার কয়েকদিন আগে থেকেই বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরের লোকজন তাদের ভোটকেন্দ্রে না যাবার জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়। কিন্তু তারা একে পাত্তা না দিয়ে ৫ জানুয়ারি দু'জন-চার জন করে ভোটকেন্দ্রে যেতে শুরু করে। পথিমধ্যে কিছু লোক তাদের ভোটকেন্দ্রে না যাবার জন্য হুমকি প্রদান করলে তারা ভিন্ন পথে ভোট দিতে যায়। সকাল থেকে উত্তেজনা দেখা দিলেও আক্রমণ হয়নি। বেলা তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে আনুমানিক তিন-চার শ' লোক দেশীয় অস্ত্র এবং লাঠিশোঠা নিয়ে একযোগে গ্রামের পশ্চিম এবং পূর্বদিক থেকে হিন্দুপল্লী মালোপাড়ায় আক্রমণ শুরু করে।
আক্রান্ত সুশীল সরকার আমাদের জানায়, সেদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দু'দফায় হামলা চালানো হয়। হামলায় ৪/৫ শত লোক অংশ নেয়। হামলাকারীদের মুখ ও মাথা সাদা কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল-যার কারণে চেনা যায়নি। অনেকের মুখে কাপড় ছিল না - কিন্তু তাদের কখনও এলাকায় দেখেননি। সুশীল সরকার জানাল, হামলায় বেশ কয়েকজন নারীও অংশ নেয়।
মধ্যবয়সের অলকা সরকার জানান, আক্রমণের সময় তাঁর স্বামী মঙ্গল সরকার ভোটকেন্দ্রে ছিলেন। হামলাকারীরা দু'দফায় আক্রমণ চালায়- সংখ্যায় ছিল ৩/৪ শ'। হামলায় ওই বাড়ির আশুতোষ গুরুতর আহত হন এবং তিনি এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন। হামলা হলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য অলকা সরকার তাঁর ইন্টারমেডিয়েট পড়–য়া কন্যা অর্পণা সেনকে নিয়ে দৌঁড়ে ভৈরব নদ সাঁতরিয়ে অপর পাড়ে আশ্রয় নেন। একদিন পর আতঙ্কের মধ্যেও নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
প্রতিবন্ধী মেয়ে অনিমা রাণী বিশ্বাস, পিতা-পাগল চন্দ্র বিশ্বাস। বয়স-আনুমাকি ২৪-২৫ বছর। কথা বলতে পারে না- কিন্তু অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। তার আয়ের উৎস একটি সেলাই মেশিন। বাড়িতে আক্রমণ হলে সবাই পালিয়ে যায়- আর হামলাকারীরা এই সুযোগে তার সেলাই মেশিনটিও লুট করে নিয়ে যায়। ভীত-সন্ত্রস্ত প্রতিবন্ধী অনিমা রাণীর চোখে-মুখে যেন এক রাশ প্রশ্ন- কি তার অপরাধ?
কথা হলো গৃহবধূ শিউলী বিশ্বাসের সঙ্গে। স্বামীর নাম প্রকাশ বিশ্বাস। যৌথ পরিবার তাদের। তার দুই জা-লক্ষ্মী বিশ্বাস ও স্বাতী বিশ্বাস। বিকেলবেলা তিন জা মিলে উনুনে রান্না করছিলেন। হঠাৎ হৈ-হুল্লোড়-চিৎকার-কান্নাকাটি চারদিকে। শুনলেন তাদের পাড়া আক্রান্ত হয়েছে। জীবন আর ইজ্জত বাঁচানোর জন্য তিন জা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে নদী পার হয়ে চলে গেলেন পার্শ্ববর্তী শ্রীধরপুর ইউনিয়নে। ফিরে এলেন একদিন পর। দেখলেন বাসার সব জিনিসপত্র লুট হয়ে গেছে। দরজা-জানালা সব ভেঙে চুরমার।
মালোপাড়ার বিত্তশালী যৌথ পরিবার হলো প্রবীর সরকারদের পরিবার। পাঁচ ভাইÑপ্রবীর সরকার, সান্তনু সরকার, শিরু সরকার, উত্তম সরকার ও প্রদীপ সরকার। এ বাড়িতে এসে শুনলাম আক্রমণকারীরা বোমা ফাটাল, রামদা, ছুরি নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। ঘরের সমস্ত জিনিস ভেঙ্গেচুরে ল-ভ- করে দেয়। সোনা-দানা, নগদ টাকা সব লুট করে নেয়। আক্রোশ মেটানোর জন্য ঘরে ঢুকবার সিঁড়ি এবং ইটের তৈরি দাওয়া শাবল দিয়ে উপড়িয়ে ফেলে। জীবন বাঁচানোর জন্য সবাই দৌঁড়ে নদীর ঘাটে যায় এবং ট্রলারে করে অপর পাড়ে আশ্রয় নেয়।
মাধবী বিশ্বাস বললেন, লাঠি, দা, শাবল নিয়ে আক্রমণকারীরা গ্রামের পশ্চিম দিক থেকে হামলা চালায়। তাঁর স্বামী মুনীশ বিশ্বাস গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আক্রমণ শুরু হলে তার চার ছেলেমেয়ে দৌঁড়ে নদীর পাড়ে যায় এবং সাঁতরিয়ে অপর পাড়ে যেয়ে জীবন রক্ষা করে।
পাড়ার হিন্দু মন্দিরের পাশে দুলাল বিশ্বাসের ঘর। আমরা যখন তার বাড়িতে যাই দেখি তিনি একটি চৌকির উপর বসে আছেন, সাথে দুই মেয়ে। বিমর্ষ, আতঙ্কিত মেয়ে দু'টির চেহারা। কথা বলে জানলাম দুলাল বিশ্বাসের চার মেয়ে অনিতা বিশ্বাস, নিপা বিশ্বাস, মঙ্গলী বিশ্বাস, দুর্জয় বিশ্বাস এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে খুলনা বিএল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্সের ছাত্রী। দু' মেয়ে মহাকাল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের ছাত্রী, ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে আর ছেলেটি দশম শ্রেণীতে। কন্যা নিপা বিশ্বাস আমাদের জানান, হামলাকারীরা তাদের দরজা-জানালা সব ভেঙে ফেলে, জিনিসপত্র তছনছ ও লুটপাট করে। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো আক্রমণকারীরা তাদের এসএসসি ও এইচএসসি'র সার্টিফিকেটগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে। জীবন বাঁচানোর জন্য তারা সবাই পালিয়ে নদীর অপর পাড়ে চলে যায়। এ বাড়ির সামনেই হামলকারীরা মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার সকল জাল একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেয়। আমরা পুড়ে যাওয়া ছিন্নভিন্ন জালের স্তূপ দেখতে পেয়েছি।
আমরা কথা বলেছি আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে যার বিস্তৃত বিবরণ এ নিবন্ধে দেয়া সম্ভব নয়। তবে সবার কথা থেকে এটি স্পষ্ট যে, হামলার কারণ, উদ্দেশ্য এবং ধরন এক ও অভিন্ন। হামলার মূল কারণ রাজনৈতিক। নিষেধ অমান্য করে ভোট দিতে যাওয়া। উদ্দেশ্য-প্রতিশোধ গ্রহণ, ভীতি প্রদর্শন, সম্পদ লুটপাট। আক্রমণের ধরনÑ দেশীয় অস্ত্র সজ্জিত ও দলবদ্ধ।
গ. হামলার বিপরীতে সহমর্মিতার অপার উদাহরণ
হামলা হবার পর মালোপাড়ার অধিকাংশ মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য ট্রলার, নৌকা ও সাঁতরিয়ে পার্শ¦বর্তী ভৈরব নদ পার হয়ে অপর পাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ পাড়ের ইউনিয়নের নাম শ্রীধরপুর ইউনিয়ন। চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সমর্থিত হাবিবুর রহমান বাপ্পী এবং স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বারের নাম দিপু- যিনি বিএনপির সমর্থক। মালোপাড়ার হিন্দু পরিবারগুলোর প্রায় সকলেই বাপ্পী চেয়ারম্যান এবং দিপু মেম্বারের সাহসী ও মানবিক ভূমিকার কথা বারবার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। সবাই যখন পালিয়ে শ্রীধরপুর ইউনিয়নে চলে যায়, তখন এরা দু'জন তাদের থাকা, খাওয়া ও নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন। প্রথম দিন রাতে শত শত মানুষকে খিচুড়ি রান্না করে তারা খাওয়ালেন। পরের দিন সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবারের পর নিজেরা এসে নারী-শিশুদের মালোপাড়ায় তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেন। বিশেষ করে যুবতী মেয়ে এবং নারীরা যেন অভিভাবক খুঁজে পেয়েছিলেন নদীর অপর পাড়ে। সমাজে যে এখন ভাল মানুষ আছে, মনুষ্যত্ব-বিবেক ফুরিয়ে যায় নিÑবাপ্পী এবং দীপু সে সত্য এবং ভরসার প্রতীকই হয়ে রইলেন।
অপরদিকে আক্রান্ত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপি সমর্থিত সিরাজুল ইসলাম মান্নু বিপন্ন মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াননি। তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বলে স্থানীয়রা মনে করে।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ সাহায্য
মালোপাড়ার অধিকাংশ ঘরই হামলাকারীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে টিনের ঘরগুলো চোখে পড়েছে বেশি। দুমড়ে-মুচড়ে, কেটে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে ঘরের বেড়া ও টিনের চাল। কিছু ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। দোকান এবং বাড়িঘরের সম্পদ লুটপাট করা হয়েছে। মাছধরার জালগুলো লুটপাট এবং অনেকগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শীতের কারণে মানুষের কষ্টের পরিমাণও বেশি। ঘটনার পাঁচ দিন পরে যাওয়ার কারণে আমাদের মনে হয়েছে আক্রান্ত মানুষগুলো প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে উঠেছে। ছোটখাটো ভাংচুরের ঘটনা নিজেরাই সারিয়ে নিয়েছে। সরকারী-বেসরকারী সাহায্য আসতে শুরু করেছে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে এসেছেন ত্রাণ-সামগ্রী নিয়ে। এলাকার মঙ্গল সরকারের স্ত্রী অলকা সরকার জানান, নগদ সাহায্য হিসেবে তারা সরকারের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা পেয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সকল পরিবারই একইভাবে পেয়েছেন। সরকারীভাবে খাদ্যসাগ্রমী সরবরাহ এবং ক্ষতিগ্রস্ত গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মালোপাড়ায় আমরা বেশ কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে চাল, কাপড়- চোপড় এবং কম্বল বিতরণ করতে দেখেছি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে ৫০টি মৎস্যজীবী পরিবারের প্রত্যেককে একটি করে 'টানা জাল' এবং নগদ এক হাজার টাকা করে সহায়তা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী অনীমা রাণীকে একটি সেলাই মেশিন ক্রয়ের জন্য নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যশোর জেলা কমিটির সভাপতি হারুন-অর-রশীদ, সাধারণ সম্পাদক সুকুমার দাস, জোটনেতা মাহমুদুল হাসান বুলু ও সানোয়ার আলম দুলুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন ও সামগ্রিক কর্মকা-ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এলাকার নিরাপত্তা
৫ তারিখ বিকেলে হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঘটনার পরদিন মালোপাড়ার 'কৃষ্ণ বাড়ি'তে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। এসআই গৌতম এবং এএসআই মোঃ লিয়াকত আলীর অধীনে বাইশজন পুলিশ এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। আপাতত নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেও মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। সবাই বলছেন, পুলিশ ক্যাম্প উঠে গেলে আবার যে হামলা হবে না তার নিশ্চয়তা কি? সকলের দাবি দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এখানে যেন পুলিশ ক্যাম্প রাখা হয়।
স্থানীয় অভয়নগর উপজেলার চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক আমাদের জানিয়েছেন, স্থানীয় ওসির ভূমিকা বিতর্কিত। তার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রকৃত হামলাকারীদের গ্রেফতারে শৈথিল্যের অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, ঘটনার পর আওয়ামী লীগ প্রার্থী রনজিৎ কুমার ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক হুইপ আবদুল ওহাব আক্রান্তদের পাশে এসে দাঁড়াননি। উপজেলা চেয়ারম্যান এই হামলার জন্য ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের দায়ী করেন।
চাপাতলি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও চাপাতলি সার্বজনীন পূজা মন্দিরের সভাপতি শেখর কুমার বর্মণ আমাদের জানান যে, অতীতে কখনও এ এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়নি। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ভোট দিতে যাওয়ার সময় অনেককে রাস্তা থেকে ফিরিয়ে দেয়। আক্রমণকারীরা অচেনা হলেও এরা জামায়াত-শিবিরের কর্মী বলে তাঁর ধারণা। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি বলেন- এ দেশ আমাদের মাতৃভূমি, আমরা এ দেশের নাগরিক, আমাদের কি মত প্রকাশের অধিকার থাকবে না?
সুপারিশ
১. সরেজমিনে পরিদর্শন, আক্রান্ত ব্যক্তি এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছে, উত্তপ্ত রাজনৈতিক অবস্থা, পরিস্থিতির গুরুত্ব ও ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে পূর্ব থেকে সংখ্যালঘু এলাকায় নজরদারি এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সহজ হতো। সংখ্যালঘু এলাকায় স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করা যায় কিনা সে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
২. মালোপাড়ার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার এবং বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তদন্ত, গ্রেফতার এবং বিচার প্রক্রিয়ার কোন ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তদের শৈথিল্য এবং দায়িত্বহীনতার অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। হামলাকারীরা দলীয়, গোত্র ও সম্প্রদায়ের পরিচয়ের বাইরে দুস্কৃতকারী হিসেবেই চিহ্নিত হবে এবং কঠিন শাস্তি পাবেÑ সমাজে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে।
৩. সাম্প্রদায়িক এবং গোষ্ঠীগত নির্যাতন, নিপীড়ন, ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতি এবং মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষকে পশ্চাৎপদ মনুষ্যত্ব বিনাশী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা ও জনঐক্য গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবেশী এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে।
৪. ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন এবং আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
সবশেষে বলতে চাই, ১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন এবং কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তি এবং সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু মানুষের সে আকাক্সক্ষা বার বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালু এবং ক্ষমতার মোহে মানুষে মানুষে হিংসা ও বিদ্বেষ তৈরি করে যারা দেশের এক বড় অংশ মানুষকে দেশান্তরী করতে চায় তাদের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন আমাদের করতেই হবে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ, কিংবা মান-অভিমানের চাইতে জাতির অস্তিত্ব, মানুষের জীবন এবং সত্য-ন্যায়ের বিজয় অনেক বেশি জরুরী- এ সত্য আমাদের মানতেই হবে। মালোপাড়ার প্রতিবন্ধী অনিমা রাণী বিশ্বাসের জীবন যন্ত্রণা আমাদের চৈতন্যকে জাগ্রত করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
gquddusbd@gmail.com
__._,_.___