বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১৪ ফাল্গুন ১৪২০
তালেবানী স্ট্র্যাটেজি ও পশ্চাৎপদতা
বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর
তালেবানী আগ্রাসনের দরুন মাদ্রাসার ঐতিহ্য থেকে মানবিকতা বহিষ্কৃত হচ্ছে। তালেবানী আগ্রাসন মানবিকতার ধারণাকে মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে উচ্ছেদ করেছে। এই ধারণা অষ্টম শতাব্দী থেকে ইসলামিক ঐতিহ্যের একটা বড় ধারা। জ্ঞানের আধুনিক সিস্টেমে যাকে বলা হয় মানবিকতা, এর উদ্ভব পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ শতাব্দীর ইতালিতে নয়, যদিও জেকব বুর্খহাউট তাই ভেবেছেন। ইসলামিক ঐতিহ্য থেকে উত্থিত মানবিকতা খ্রীস্টান ঐতিহ্যে যুক্ত হয়েছে, এই যুক্ততা থেকে তৈরি হয়েছে জ্ঞানের আধুনিকতা। এভাবেই লিগ্যাল, থিওলজিক্যাল এবং সেক্যুলার জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য ও কারিকুলা গঠিত হয়েছে। ইসলামিক ঐতিহ্য গঙ্গা-যমুনার মতো খ্রীস্টান ঐতিহ্যে মিলেছে এবং তৈরি করেছে মানবিকতার বোধ। এখান থেকে উৎসারিত হয়েছে জ্ঞানচর্চার বেশ কিছু ধ্যানধারণা, উৎসারিত হয়েছে জ্ঞানচর্চার আবহাওয়া, যেখানে বিবাদ, মতভেদ ও বিতর্ক মিলে তৈরি করেছে জ্ঞানচর্চার আবহাওয়া। মানবিকতা সেজন্য পশ্চিমের কনসেপ্ট নয়, এই কনসেপ্ট একই সঙ্গে আরবীয়, ভারতীয় এবং চৈনিক।
সেজন্য মানবিকতা পাশ্চাত্যের লিবারেলিজমের সঙ্গে একাত্মক নয়। আবার নিউলিবারেলিজম হচ্ছে বিশ্বায়ন; অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতি, যা কিনা সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং এথনিক ভিন্নতা গভীর করে তুলেছে। আজকের পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে এবং এক ধরনের আত্মনির্ভরশীলতা তৈরি করেছে, যে নির্ভরশীলতার সূত্রপাত ঊনবিংশ শতাব্দীর ধনতন্ত্র থেকে। এই ধনতন্ত্র মানবাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
ধনতন্ত্রের অন্য নাম মৌলবাদ। মৌলবাদের মধ্যে একটা কলোনিয়াল পৃথিবী তৈরির চেষ্টা আছে। এই কলোনিয়াল পৃথিবীটা শাসন করেছে ধর্মজ সাম্রাজ্যবাদ। মৌলবাদ যে কলোনিয়াল পৃথিবী তৈরির চেষ্টা করে চলেছে, সেখানে কাজ করেছে এক ধরনের ধর্মজ ডিক্টেটরশিপ। মৌলবাদী প্রবক্তারা একটা বিশেষ ধরনের ধর্মজ-সাংস্কৃতিক ভূখ-ের বাসিন্দা। এসব প্রবক্তা ধর্মজ অনুসারীদের দক্ষিণ এশিয়ার (মুসলমানদের) কলোনিয়াল স্টেটাস প্রদানের পক্ষপাতি, এসব অনুসারী সংস্কৃতির দিক থেকে মৌলবাদ প্রণীত ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল।
ইসলামের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক নেই কিংবা ডিক্টেটরশিপের সম্পর্ক নেই। অথচ মৌলবাদ ইসলামের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতন তৈরি করেছে, মৌলবাদী বিশ্বাসের বাইরে কিংবা পরপারে অন্য কোন বিশ্বাস নেই, যদি অন্য কোন বিশ্বাস থাকে (এক ধর্মপ্রসূত অন্য বিশ্বাস কিংবা অন্য ধর্মপ্রসূত বিশ্বাস), তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে লড়াই করে যেতে হবে। এর ফলে একদিকে অন্য বিশ্বাস উচ্ছেদ করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে এবং অন্যদিকে বিশ্বাস থেকে তৈরি হয়েছে বিশ্বাসের ডিক্টেটরশিপ। এখান থেকে উদ্ভূত হয় অন্ধত্ব, পিস্তল-বন্দুকের খেলা। প্রতিপক্ষকে হত্যা করে উচ্ছেদ করতে হবে, প্রতিপক্ষের কোন জায়গা নেই। প্রতিপক্ষ একই ধর্মবিশ্বাসী মুসলমান হতে পারে কিংবা ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী হতে পারে। প্রতিপক্ষ হচ্ছে সর্বতোভাবে নারীরা; তালেবানী বিশ্বাসের বাইরে তাদের কোন জায়গা নেই, তারা পুরুষের অধস্তন। তালেবানী সাম্রাজ্যে সকল কর্তৃত্ব পুরুষের।
তালেবানী টিরেনীয় ভিত্তি হচ্ছে জবরদস্তি, জবরদস্তি হচ্ছে সকল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আর রাজনীতি হচ্ছে কর্তৃত্বের ম্যানুয়াল। কর্তৃত্ব হচ্ছে ধর্মজ কর্তৃত্ব, স্তরবিন্যস্ত ধর্মজ শিক্ষাব্যবস্থা কর্তৃত্বের ভিত্তি শক্তিশালী করে রাখবে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ধর্মজ কর্তৃত্ব বিরোধী বলে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা জায়েজ। অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তি তালেবানী ব্যবস্থা আত্মসাত করেছে, কিন্তু আধুনিকতা নয়। সেজন্য তালেবানী ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের আধুনিক ধ্যান-ধারণা বিরোধী। পশ্চাৎপদতা থেকে আধুনিকতা তৈরি করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশের সমস্যা এক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা থেকে আধুনিকতা তৈরি করা সম্ভব হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে তালেবানী বিশ্বাসপ্রসূত বেশ সংখ্যক রাজনৈতিক দল আছে: জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি। এসব রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। বাংলাদেশে এখন, বর্তমান মুহূর্তে, যেসব সরকারবিরোধী আন্দোলন তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, (যেমন বিএনপি- জামায়াত- হেফাজতে ইসলাম) এসব আন্দোলনের প্রথম বলি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা ব্যবস্থায় বার বার আঘাত করা হচ্ছে। এই অপপ্রয়াস থেমে নেই। চলছে পরীক্ষা বন্ধ করার অপচেষ্টা। এ উপলক্ষে সাধারণ মানুষ ও সাধারণ মানুষের সন্তানসন্ততি লেখাপড়ার দিকে দুহাত বাড়িয়ে রেখেছে, অন্যদিকে বিএনপি- জামায়াত-হেফাজতে ইসলাম আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করে পরীক্ষা বন্ধকরণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সার্বিক পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে। (পরীক্ষার সময় হরতাল দিয়ে, স্কুল পুড়িয়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছে)।
সেই সুদূর আমলে, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে যে আন্দোলন কৃষকের সন্তানসন্ততি শুরু করেছিল, সেই আন্দোলন হচ্ছে বর্তমানের একুশের আন্দোলন, আধুনিক লেখাপড়ার আন্দোলন, বাংলা ভাষার চর্চার আন্দোলন। এই অর্থে ভাষার বিরুদ্ধে, আধুনিক লেখাপড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চলেছে বিএনপি- জামাতায় এবং হেফাজত। আধুনিক শিক্ষার আন্দোলন রুদ্ধ করে মানুষকে পশ্চাদমুখী ও অনগ্রসর করে রাখাই তালেবানী স্ট্রাটেজি। এর প্রমাণ আল কায়েদাপ্রধান জাওয়াহিরির বাংলাদেশ সম্পর্ক সাম্প্রতিক ভিডিও বার্তা।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক
সেজন্য মানবিকতা পাশ্চাত্যের লিবারেলিজমের সঙ্গে একাত্মক নয়। আবার নিউলিবারেলিজম হচ্ছে বিশ্বায়ন; অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতি, যা কিনা সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং এথনিক ভিন্নতা গভীর করে তুলেছে। আজকের পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে এবং এক ধরনের আত্মনির্ভরশীলতা তৈরি করেছে, যে নির্ভরশীলতার সূত্রপাত ঊনবিংশ শতাব্দীর ধনতন্ত্র থেকে। এই ধনতন্ত্র মানবাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
ধনতন্ত্রের অন্য নাম মৌলবাদ। মৌলবাদের মধ্যে একটা কলোনিয়াল পৃথিবী তৈরির চেষ্টা আছে। এই কলোনিয়াল পৃথিবীটা শাসন করেছে ধর্মজ সাম্রাজ্যবাদ। মৌলবাদ যে কলোনিয়াল পৃথিবী তৈরির চেষ্টা করে চলেছে, সেখানে কাজ করেছে এক ধরনের ধর্মজ ডিক্টেটরশিপ। মৌলবাদী প্রবক্তারা একটা বিশেষ ধরনের ধর্মজ-সাংস্কৃতিক ভূখ-ের বাসিন্দা। এসব প্রবক্তা ধর্মজ অনুসারীদের দক্ষিণ এশিয়ার (মুসলমানদের) কলোনিয়াল স্টেটাস প্রদানের পক্ষপাতি, এসব অনুসারী সংস্কৃতির দিক থেকে মৌলবাদ প্রণীত ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল।
ইসলামের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক নেই কিংবা ডিক্টেটরশিপের সম্পর্ক নেই। অথচ মৌলবাদ ইসলামের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতন তৈরি করেছে, মৌলবাদী বিশ্বাসের বাইরে কিংবা পরপারে অন্য কোন বিশ্বাস নেই, যদি অন্য কোন বিশ্বাস থাকে (এক ধর্মপ্রসূত অন্য বিশ্বাস কিংবা অন্য ধর্মপ্রসূত বিশ্বাস), তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে লড়াই করে যেতে হবে। এর ফলে একদিকে অন্য বিশ্বাস উচ্ছেদ করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে এবং অন্যদিকে বিশ্বাস থেকে তৈরি হয়েছে বিশ্বাসের ডিক্টেটরশিপ। এখান থেকে উদ্ভূত হয় অন্ধত্ব, পিস্তল-বন্দুকের খেলা। প্রতিপক্ষকে হত্যা করে উচ্ছেদ করতে হবে, প্রতিপক্ষের কোন জায়গা নেই। প্রতিপক্ষ একই ধর্মবিশ্বাসী মুসলমান হতে পারে কিংবা ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী হতে পারে। প্রতিপক্ষ হচ্ছে সর্বতোভাবে নারীরা; তালেবানী বিশ্বাসের বাইরে তাদের কোন জায়গা নেই, তারা পুরুষের অধস্তন। তালেবানী সাম্রাজ্যে সকল কর্তৃত্ব পুরুষের।
তালেবানী টিরেনীয় ভিত্তি হচ্ছে জবরদস্তি, জবরদস্তি হচ্ছে সকল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আর রাজনীতি হচ্ছে কর্তৃত্বের ম্যানুয়াল। কর্তৃত্ব হচ্ছে ধর্মজ কর্তৃত্ব, স্তরবিন্যস্ত ধর্মজ শিক্ষাব্যবস্থা কর্তৃত্বের ভিত্তি শক্তিশালী করে রাখবে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ধর্মজ কর্তৃত্ব বিরোধী বলে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা জায়েজ। অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তি তালেবানী ব্যবস্থা আত্মসাত করেছে, কিন্তু আধুনিকতা নয়। সেজন্য তালেবানী ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের আধুনিক ধ্যান-ধারণা বিরোধী। পশ্চাৎপদতা থেকে আধুনিকতা তৈরি করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশের সমস্যা এক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা থেকে আধুনিকতা তৈরি করা সম্ভব হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে তালেবানী বিশ্বাসপ্রসূত বেশ সংখ্যক রাজনৈতিক দল আছে: জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি। এসব রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। বাংলাদেশে এখন, বর্তমান মুহূর্তে, যেসব সরকারবিরোধী আন্দোলন তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, (যেমন বিএনপি- জামায়াত- হেফাজতে ইসলাম) এসব আন্দোলনের প্রথম বলি শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা ব্যবস্থায় বার বার আঘাত করা হচ্ছে। এই অপপ্রয়াস থেমে নেই। চলছে পরীক্ষা বন্ধ করার অপচেষ্টা। এ উপলক্ষে সাধারণ মানুষ ও সাধারণ মানুষের সন্তানসন্ততি লেখাপড়ার দিকে দুহাত বাড়িয়ে রেখেছে, অন্যদিকে বিএনপি- জামায়াত-হেফাজতে ইসলাম আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করে পরীক্ষা বন্ধকরণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সার্বিক পরিবেশ নষ্ট করে চলেছে। (পরীক্ষার সময় হরতাল দিয়ে, স্কুল পুড়িয়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছে)।
সেই সুদূর আমলে, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে যে আন্দোলন কৃষকের সন্তানসন্ততি শুরু করেছিল, সেই আন্দোলন হচ্ছে বর্তমানের একুশের আন্দোলন, আধুনিক লেখাপড়ার আন্দোলন, বাংলা ভাষার চর্চার আন্দোলন। এই অর্থে ভাষার বিরুদ্ধে, আধুনিক লেখাপড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চলেছে বিএনপি- জামাতায় এবং হেফাজত। আধুনিক শিক্ষার আন্দোলন রুদ্ধ করে মানুষকে পশ্চাদমুখী ও অনগ্রসর করে রাখাই তালেবানী স্ট্রাটেজি। এর প্রমাণ আল কায়েদাপ্রধান জাওয়াহিরির বাংলাদেশ সম্পর্ক সাম্প্রতিক ভিডিও বার্তা।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক
প্রকাশ : বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১৪ ফাল্গুন ১৪২০
__._,_.___