ইউরোপীয় ইউনিয়নে মাথাপিছু দুর্নীতি কত?
ড. আর এম দেবনাথ
তিনটি বিষয়ের ওপর আজকে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমেই দুর্নীতি, পরে জনশক্তি রফতানি এবং সবশেষে রেমিটেন্সের ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করব। দুর্নীতি, মানে বাংলাদেশের দুর্নীতি ওপর নয়। আমি আজকের নিবন্ধে চীনের দুর্নীতি, রাশিয়ার দুর্নীতি সম্বন্ধে কিছু বলব না অথচ এরা ছিল আদর্শ মানুষের দেশ বলে পরিচিত, সমাজতান্ত্রিক মানুষ। আমি থাইল্যান্ড-ব্যাঙ্কক অথবা মিয়ানমারের দুর্নীতি নিয়েও আজ লিখব না। ভারত, পাকিস্তান, আরববিশ্বের দুর্নীতির কথা আমরা সবাই জানি। যে খবরটি আমরা জানি না সেটা হচ্ছে যারা আমাদের দুর্নীতির ওপর বাল্যশিক্ষা দেয় তাদের অবস্থা কী? যারা সারা পৃথিবীর বিশেষ করে গরিব দেশগুলোর দুর্নীতির ওপর প্রতিবছর খবর ছাপায় তাদের অবস্থা কী, তাও আমরা সঠিক জানি না। গত মঙ্গলবার হঠাৎ নিতান্তই ঘটনাক্রমে একটা খবর আমার দৃষ্টিগোচর হয়। ছোট্ট খবর, ইংরেজী দৈনিকে। ভাল করে লক্ষ্য না করলে খবরটি দৃষ্টির আড়ালেই থাকবে বলে আমার ধারণা। খবরটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ টি দেশে বছরে দুর্নীতির পরিমাণ কত? এই প্রশ্নটিই 'বেতালা' প্রশ্ন। আমাদের ধারণা দেয়া হয়, তারা হচ্ছে 'সাধুসন্তের' দেশ। সেখানে বছরে দুর্নীতির পরিমাণ কতÑএই প্রশ্নে আমি ভড়কে যাই প্রথমে। খবরটি পড়ে দেখি, যারা ইউনিয়নভুক্ত দেশে দুর্নীতির হিসাব বের করেছে তারা কোন প্রাইভেট সংস্থা নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হোম এ্যাফেয়ার্স কমিশনার সিসিলা মামস্ট্রোম বলছেন, ইউনিয়নের ২৮টি দেশে বছরে দুর্নীতি হয় ১২০ বিলিয়ন ইউরো (এক বিলিয়ন সমান এক হাজার মিলিয়ন)। তার মানে ১২০০০ কোটি ইউরো। এক 'ইউরো'র (ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারণ মুদ্রার নাম) যদি ১০০ টাকা মূল্য ধরা হয় তাহলে ২৮টি দেশে বছরে দুর্নীতি হয় ১২ লাখ কোটি টাকা। সভ্য জগতে এত বড় দুর্নীতি, ভাবা যায়! ভাবা না গেলেও বাস্তবতা এটাই। হিসেবে দেখা যায়, দেশপ্রতি দুর্নীতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২,৮৫৭ কোটি টাকা। ২৮টি দেশের লোকসংখ্যা কত? এই মুহূর্তে জানা নেই। তবু এসব পরিসংখ্যান খুঁজছিলাম বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করার জন্য। আসলে তুলনার দরকার নেই। দুর্নীতি দুর্নীতিই। এটা ইউরোপে হলেও যা বাংলাদেশে হলেও তা। শুধু দুঃখ, যারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত তারা প্রতিবছর তাদের বাংলাদেশী বশংবদদের দিয়ে আমাদের বদনাম দেয়। ভাবটা এমন, যেন আমরাই একমাত্র দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতি সব দেশেÑকম আর বেশি। যে রাশিয়া, চীন সমাজতন্ত্র চর্চা করে সোনার মানুষ, আদর্শ মানুষ তৈরি করার কথা ছিল; তারাই দেখছি এখন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। ঐ দুর্নীতিগ্রস্ত নতুন নতুন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকরাই চীন-রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি বলে শুনতে পাই। বাংলাদেশের বেলায় কী এ কথাটি অসত্য?
এবার আসি রেমিটেন্সের প্রশ্নে। রেমিটেন্সের প্রশ্নে এই কারণে যে, এটা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম লাইফলাইন। এতে উত্থানপতন আমাদের পথে বসিয়ে দিতে পারে। দেখা যাচ্ছে, এমন একটা বিষয়ে আমরা গত সাত মাস যাবত উত্থানপতনের মধ্যে আছি। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে যে পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে এসেছিল আগস্ট মাসে এসেছে তার চেয়ে কম। সেপ্টেম্বরে কমেওনি বাড়েওনি। পরবর্তী অক্টোবরে একটু বাড়ে, আবার নবেম্বরে একটু কমে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রেমিটেন্স কিছুটা বেড়েছে কিন্তু তার পরিমাণ আহামরি কিছু নয়। সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এর পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনীয় সাত মাসের চেয়ে কম রেমিটেন্স এসেছে। এবারের সাত মাসে এসেছে ৮ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। পূর্ববর্তী বছরের সাত মাসে এসেছিল ৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। হ্রাসের পরিমাণ শতাংশের হিসেবে ৮ শতাংশ। এটা আতঙ্কের খবর না হলেও সিরিয়াস ভাবনার বিষয়। প্রথমত দেখা যাচ্ছে জনশক্তি রফতানি মন্দার শিকার। ২০১২ সালে জনশক্তি রফতানি হয়েছিল ৬,০৭,৭৯৮ জন। সেই স্থলে ২০১৩ সালে রফতানি হয়েছে মাত্র ৩,৯৯,৩৩৩ জন। এর কারণ অনেক। রফতানির নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না। পুরনো বাজার ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছে। শুধু যে জনশক্তি রফতানি হ্রাসের জন্যই রেমিট্যান্সের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, তা নয়। এখানেও দুটো বিষয় জড়িত। আমরা রফতানি করি অদক্ষ জনশক্তি যাদের বেতন-ভাতা কম। যেসব দেশ দক্ষ জনশক্তি রফতানি করে তাদের রেমিট্যান্স বেশি। পাঁচজনের রোজগার একজনই কর। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা জনশক্তি রফতানি বাজারে আছি অনেকদিন হয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি রফতানির ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। দেশের ভেতরেই প্লাম্বার ইলেক্ট্রিশিয়ান, ভাল কাঠমিস্ত্রি, ভাল নির্মাণকর্মী, ওভারসিয়ার, হিসাবরক্ষক পাওয়া যায় না। বিদেশেও এদের চাহিদা প্রচুর। অথচ এ ধরনের দক্ষ জনশক্তি তৈরির ব্যবস্থা অপ্রতুল। আমাদের দেশের প্রভাবশালীরা খালি বিশ্ববিদ্যালয় করে, মেডিক্যাল কলেজ করে। গাড়ি-বারান্দায়ও বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এর মালিকানা নিয়ে মারামারি, বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবরণে জঙ্গী তৈরির ব্যবস্থা হচ্ছে। অথচ কেউ ৫-১০ টা প্রাইমারী স্কুল, কারিগরি স্কুল করতে প্রস্তুত নয়। সবাই এমবিএ, বিবিএ তৈরি করছে, যাদের অধিকাংশই ব্যাকরণ কাকে বলে জানে না। যাদের অঙ্ক, বিজ্ঞানের কোন চর্চা নেই। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে চলছে দোতলা দিয়ে। এক তলার কাজ নেই, ফাউন্ডেশনের দরকার নেই। দরকার দোতলা। ঢাকা শহরও হচ্ছে দোতলা শহর। এক তলায় রিক্সা চলার মতো পথ নেই, খানাখন্দে ভর্তি। দ্বিতীয় যে কারণে রেমিটেন্স কম হচ্ছে সে বিষয়েও ভাবার দরকার আছে। আজকাল সোনার বাংলার প্রচুরসংখ্যক ব্যবসায়ী- শিল্পপতির বিদেশে ব্যবসা আছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুরিজম, গার্মেন্টস, নির্মাণশিল্প ইত্যাদি জাতীয় ব্যবসা বহু লোকের। শোনা যায়, তারা বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিদেশে অর্জিত ডলার কিনে নিয়ে নিচ্ছে বেশি দরে। স্বল্প সময়ে নিরাপদে সেই সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশের আজ পাড়াগাঁয়ে পৌঁছে দিচ্ছে আত্মীয়স্বজনদের কাছে। দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের এটা অন্যতম নতুন মাধ্যম। আগে এসব কাজ ভারতীয় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা করত। এটা হুন্ডি ব্যবসা। তারাই ছিল এই কাজে দক্ষ। ছিল ঢাকাতে দক্ষিণ ভারতীয় কিছু ব্যবসায়ী, যারা এই ব্যবসা করত। বাঙালী ব্যবসায়ীরা এখন সাবালক হয়েছে। তারা এখন নতুন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সেজেছে। তারা মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ প্রভৃতি অঞ্চলে অফিস-কার্যালয় খুলে এই ব্যবসা করছে। এতেও সরকারী চ্যানেলে এখন টাকা কম আসছে বলে অনেকের ধারণা। এতে ইন্ধন যোগাচ্ছে ডলারের নিম্ন দাম। একদিকে নিম্নদামী ডলার আমদানি বাজারকে স্থিতিশীল রাখছে, অন্যদিকে ডলার চলে যাচ্ছে হুন্ডিওয়ালাদের হাতে; যে ব্যবসা অবৈধ। সবশেষে যে বিষয়টির ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা দরকার সেটি হচ্ছে রেমিটেন্সের টাকার ব্যবহার। দীর্ঘদিন যাবত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রেমিটেন্সের টাকার বিপুল অংশ অপব্যয় হচ্ছে। এর কোন উৎপাদনমূলক (প্রোডাকটিভ) ব্যবহার নেই। সকল গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে, এই টাকার একটা বড় অংশ যাচ্ছে জমি কেনাতে। কিছুদিন আগে আমার পরিচিত একটা উপজেলায় যাই। যাই উপজেলা শহরে সরু রাস্তাÑরিক্সা করে যাচ্ছি। দুইদিকে দেখি ভীষণ সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং। চোখ জুড়িয়ে যায়। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার বাড়ি-ঘরের মতো বাড়ি-ঘর। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই বাড়ির মালিক ইতালির বাসিন্দা। তারা খুব গরিব লোক ছিল। এখন ঐ অঞ্চলের লোকেরা প্রচুর টাকার মালিক। অনেকেই থাকে ইতালিতে। এইসব বাড়িতে কে থাকে? বুড়ো-বুড়ি বাপ-মা এই শ্রেণীর লোক। এক একটা বাড়ি করতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, জমির দাম কত? এখন কাঠা হিসেবে দাম হয় না। শতাংশের হিসেবে দাম (এক শ' শতাংশে এক একর)। এক শতাংশ জমির দাম কমপক্ষে ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা। জমির দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। কোন মধ্যবিত্ত, সৎ লোকের পক্ষে এখন উপজেলা শহরেও বাড়ি করা সম্ভব নয়। রেমিট্যান্সওয়াদের কর্মকা-ে উপজেলা পর্যায়ের মধ্যবিত্তের মধ্যেও টাকা রোজগারের প্রবণতা বাড়ছে বলে খবর। শুধু বাড়ি-ঘর বানানো, জমি কেনা নয়; প্রতিযোগিতা করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা রেমিটেন্সওয়ালাদের কাজ। আগে গান-বাজনা, সঙ্গীত, খেলাধুলা, আবৃত্তি অনুষ্ঠান, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, সাংস্কৃতিক মেলা, গ্রামীণ মেলা হতো ঘটা করে। এখন শোনা যায় এসবের কদর কমছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন বেশি। গ্রামে সেচের জন্য মেশিন লাগে একটি। কিন্তু না, এতে হবে না। আরেকজনের পাম্প থেকে সেচের জল আমার বাবা নেবে, তা হয় না। কেনা হোক নতুন মেশিন। প্রয়োজন না থাকলেও। চাকচিক্যে ভর্তি গ্রামের বাজার। যে উপজেলা শহরে আগে হয়ত সোনার দোকান ছিল একটা বা দুটো সেখানে এখন বহুসংখ্যক সোনার দোকান। আগে 'কর্মকার'ই এই কাজ করত। পুরনো সোনা ভেঙ্গে, অলঙ্কার ভেঙ্গে নতুন অলঙ্কার তৈরি হতো। এখন গ্রামে সোনার বার বিক্রি হয়। কারা এর ক্রেতা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর ক্রেতা রেমিট্যান্স প্রাপকরা। কত উদাহরণ দেব? দেখা যাচ্ছে 'রেমিট্যান্স' কামীয় সোনার হাঁসটি আমরা আস্তে আস্তে মেরে ফেলছি। কৃষিতে কোন বিনিয়োগ নেই। রেমিট্যান্সের টাকা এই খাতে বিনিয়োজিত হতে পারত। না তা হচ্ছে না। যারা পারছে তারা করছে দোকান। দোকান আর দোকানে গ্রামগঞ্জ সয়লাব। এত কষ্টের ডলার ,গরিবের অর্জিত ডলার যাচ্ছে জমিতে, আর মালয়েশিয়ার পরোটা এবং ব্যাঙ্ককের বরই খেতে। আত্মঘাতী বাঙালী কাকে বলে।
লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
এবার আসি রেমিটেন্সের প্রশ্নে। রেমিটেন্সের প্রশ্নে এই কারণে যে, এটা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম লাইফলাইন। এতে উত্থানপতন আমাদের পথে বসিয়ে দিতে পারে। দেখা যাচ্ছে, এমন একটা বিষয়ে আমরা গত সাত মাস যাবত উত্থানপতনের মধ্যে আছি। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে যে পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে এসেছিল আগস্ট মাসে এসেছে তার চেয়ে কম। সেপ্টেম্বরে কমেওনি বাড়েওনি। পরবর্তী অক্টোবরে একটু বাড়ে, আবার নবেম্বরে একটু কমে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রেমিটেন্স কিছুটা বেড়েছে কিন্তু তার পরিমাণ আহামরি কিছু নয়। সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এর পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনীয় সাত মাসের চেয়ে কম রেমিটেন্স এসেছে। এবারের সাত মাসে এসেছে ৮ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। পূর্ববর্তী বছরের সাত মাসে এসেছিল ৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। হ্রাসের পরিমাণ শতাংশের হিসেবে ৮ শতাংশ। এটা আতঙ্কের খবর না হলেও সিরিয়াস ভাবনার বিষয়। প্রথমত দেখা যাচ্ছে জনশক্তি রফতানি মন্দার শিকার। ২০১২ সালে জনশক্তি রফতানি হয়েছিল ৬,০৭,৭৯৮ জন। সেই স্থলে ২০১৩ সালে রফতানি হয়েছে মাত্র ৩,৯৯,৩৩৩ জন। এর কারণ অনেক। রফতানির নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না। পুরনো বাজার ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছে। শুধু যে জনশক্তি রফতানি হ্রাসের জন্যই রেমিট্যান্সের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, তা নয়। এখানেও দুটো বিষয় জড়িত। আমরা রফতানি করি অদক্ষ জনশক্তি যাদের বেতন-ভাতা কম। যেসব দেশ দক্ষ জনশক্তি রফতানি করে তাদের রেমিট্যান্স বেশি। পাঁচজনের রোজগার একজনই কর। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা জনশক্তি রফতানি বাজারে আছি অনেকদিন হয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি রফতানির ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। দেশের ভেতরেই প্লাম্বার ইলেক্ট্রিশিয়ান, ভাল কাঠমিস্ত্রি, ভাল নির্মাণকর্মী, ওভারসিয়ার, হিসাবরক্ষক পাওয়া যায় না। বিদেশেও এদের চাহিদা প্রচুর। অথচ এ ধরনের দক্ষ জনশক্তি তৈরির ব্যবস্থা অপ্রতুল। আমাদের দেশের প্রভাবশালীরা খালি বিশ্ববিদ্যালয় করে, মেডিক্যাল কলেজ করে। গাড়ি-বারান্দায়ও বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এর মালিকানা নিয়ে মারামারি, বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবরণে জঙ্গী তৈরির ব্যবস্থা হচ্ছে। অথচ কেউ ৫-১০ টা প্রাইমারী স্কুল, কারিগরি স্কুল করতে প্রস্তুত নয়। সবাই এমবিএ, বিবিএ তৈরি করছে, যাদের অধিকাংশই ব্যাকরণ কাকে বলে জানে না। যাদের অঙ্ক, বিজ্ঞানের কোন চর্চা নেই। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে চলছে দোতলা দিয়ে। এক তলার কাজ নেই, ফাউন্ডেশনের দরকার নেই। দরকার দোতলা। ঢাকা শহরও হচ্ছে দোতলা শহর। এক তলায় রিক্সা চলার মতো পথ নেই, খানাখন্দে ভর্তি। দ্বিতীয় যে কারণে রেমিটেন্স কম হচ্ছে সে বিষয়েও ভাবার দরকার আছে। আজকাল সোনার বাংলার প্রচুরসংখ্যক ব্যবসায়ী- শিল্পপতির বিদেশে ব্যবসা আছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুরিজম, গার্মেন্টস, নির্মাণশিল্প ইত্যাদি জাতীয় ব্যবসা বহু লোকের। শোনা যায়, তারা বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিদেশে অর্জিত ডলার কিনে নিয়ে নিচ্ছে বেশি দরে। স্বল্প সময়ে নিরাপদে সেই সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশের আজ পাড়াগাঁয়ে পৌঁছে দিচ্ছে আত্মীয়স্বজনদের কাছে। দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের এটা অন্যতম নতুন মাধ্যম। আগে এসব কাজ ভারতীয় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা করত। এটা হুন্ডি ব্যবসা। তারাই ছিল এই কাজে দক্ষ। ছিল ঢাকাতে দক্ষিণ ভারতীয় কিছু ব্যবসায়ী, যারা এই ব্যবসা করত। বাঙালী ব্যবসায়ীরা এখন সাবালক হয়েছে। তারা এখন নতুন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সেজেছে। তারা মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ প্রভৃতি অঞ্চলে অফিস-কার্যালয় খুলে এই ব্যবসা করছে। এতেও সরকারী চ্যানেলে এখন টাকা কম আসছে বলে অনেকের ধারণা। এতে ইন্ধন যোগাচ্ছে ডলারের নিম্ন দাম। একদিকে নিম্নদামী ডলার আমদানি বাজারকে স্থিতিশীল রাখছে, অন্যদিকে ডলার চলে যাচ্ছে হুন্ডিওয়ালাদের হাতে; যে ব্যবসা অবৈধ। সবশেষে যে বিষয়টির ওপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা দরকার সেটি হচ্ছে রেমিটেন্সের টাকার ব্যবহার। দীর্ঘদিন যাবত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রেমিটেন্সের টাকার বিপুল অংশ অপব্যয় হচ্ছে। এর কোন উৎপাদনমূলক (প্রোডাকটিভ) ব্যবহার নেই। সকল গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে, এই টাকার একটা বড় অংশ যাচ্ছে জমি কেনাতে। কিছুদিন আগে আমার পরিচিত একটা উপজেলায় যাই। যাই উপজেলা শহরে সরু রাস্তাÑরিক্সা করে যাচ্ছি। দুইদিকে দেখি ভীষণ সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং। চোখ জুড়িয়ে যায়। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার বাড়ি-ঘরের মতো বাড়ি-ঘর। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই বাড়ির মালিক ইতালির বাসিন্দা। তারা খুব গরিব লোক ছিল। এখন ঐ অঞ্চলের লোকেরা প্রচুর টাকার মালিক। অনেকেই থাকে ইতালিতে। এইসব বাড়িতে কে থাকে? বুড়ো-বুড়ি বাপ-মা এই শ্রেণীর লোক। এক একটা বাড়ি করতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, জমির দাম কত? এখন কাঠা হিসেবে দাম হয় না। শতাংশের হিসেবে দাম (এক শ' শতাংশে এক একর)। এক শতাংশ জমির দাম কমপক্ষে ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা। জমির দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। কোন মধ্যবিত্ত, সৎ লোকের পক্ষে এখন উপজেলা শহরেও বাড়ি করা সম্ভব নয়। রেমিট্যান্সওয়াদের কর্মকা-ে উপজেলা পর্যায়ের মধ্যবিত্তের মধ্যেও টাকা রোজগারের প্রবণতা বাড়ছে বলে খবর। শুধু বাড়ি-ঘর বানানো, জমি কেনা নয়; প্রতিযোগিতা করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা রেমিটেন্সওয়ালাদের কাজ। আগে গান-বাজনা, সঙ্গীত, খেলাধুলা, আবৃত্তি অনুষ্ঠান, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, সাংস্কৃতিক মেলা, গ্রামীণ মেলা হতো ঘটা করে। এখন শোনা যায় এসবের কদর কমছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন বেশি। গ্রামে সেচের জন্য মেশিন লাগে একটি। কিন্তু না, এতে হবে না। আরেকজনের পাম্প থেকে সেচের জল আমার বাবা নেবে, তা হয় না। কেনা হোক নতুন মেশিন। প্রয়োজন না থাকলেও। চাকচিক্যে ভর্তি গ্রামের বাজার। যে উপজেলা শহরে আগে হয়ত সোনার দোকান ছিল একটা বা দুটো সেখানে এখন বহুসংখ্যক সোনার দোকান। আগে 'কর্মকার'ই এই কাজ করত। পুরনো সোনা ভেঙ্গে, অলঙ্কার ভেঙ্গে নতুন অলঙ্কার তৈরি হতো। এখন গ্রামে সোনার বার বিক্রি হয়। কারা এর ক্রেতা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর ক্রেতা রেমিট্যান্স প্রাপকরা। কত উদাহরণ দেব? দেখা যাচ্ছে 'রেমিট্যান্স' কামীয় সোনার হাঁসটি আমরা আস্তে আস্তে মেরে ফেলছি। কৃষিতে কোন বিনিয়োগ নেই। রেমিট্যান্সের টাকা এই খাতে বিনিয়োজিত হতে পারত। না তা হচ্ছে না। যারা পারছে তারা করছে দোকান। দোকান আর দোকানে গ্রামগঞ্জ সয়লাব। এত কষ্টের ডলার ,গরিবের অর্জিত ডলার যাচ্ছে জমিতে, আর মালয়েশিয়ার পরোটা এবং ব্যাঙ্ককের বরই খেতে। আত্মঘাতী বাঙালী কাকে বলে।
লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
দুর্নীতি কুরে খাচ্ছে ইউরোপের অর্থনীতি
- ec.europa.eu/.../corruption/index_en.htm
- Corruption remains one of the biggest challenges for all societies, including European societies. Although the nature and scope of corruption may differ from one ...
Corruption Costs European Union 120 Billion Euros a Year, Study ...
www.nytimes.com/.../European-Union-Report-on-...7 hours ago - Cecilia Malmstrom, the European commissioner for home affairs, said corruption "hurts the European economy and deprives states of ...The New York Times
- http://bangla.bdnews24.com/world/article738996.bdnews
__._,_.___