বাংলাদেশ পরাধীন কোনো রাষ্ট্র নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম এই দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশের এক দশমাংশ অঞ্চল। সাংবিধানিক অধিকার মতে, এইখানে যারা বসবাস করছে তারা প্রত্যেকে স্বাধীন দেশের নাগরিক। পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ যেমন ঢাকাসহ সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার অধিকার রাখে ঠিক অনুরূপভাবে সমতল অঞ্চলের মানুষও এখানে বসবাস করার অধিকার রাখে। দেশের এই অবিচ্ছেদ্য অংশের মাটি ও মানুষের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাদের মাথা ঘামানো কতটুকু কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে, তা ভেবে দেখা দরকার। তাদের জানা থাকা উচিত, পাহাড়ের কোনো পোষ্যপুত্র নেই। এখানে পাহাড়ি-বাঙালি যারাই বসবাস করছে প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে এখানে এসেছে। কেউ এসেছে জুম চাষ করতে, আবার কেউ এসেছে পুনর্বাসিত হবার স্বপ্নে। তবে কেউ আগে, কেউ পরে- তফাৎ শুধু এখানেই। তাদের এ দেশীয় দোসর, এনজিও মার্কা সুশীল সমাজ নামধারী যাদেরকে নিয়ে এখান থেকে বাঙালি খেদানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে- তা এখনি বন্ধ করা উচিত। তা না হলে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ এরূপ ক্ষেত্রে সমুচিত জবাব দিতে আগেও ভুল করেনি, ভবিষ্যতেও ভুল করবে না। বীর বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চলে পুনরায় জেগে উঠলে তারা পালিয়ে যাবার পথ খুঁজে পাবে না। কমিশনের জানা উচিত পার্বত্যাঞ্চলে কাউকে রেখে, কাউকে তাড়িয়ে দিয়ে এখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা হবে অলীক স্বপ্ন মাত্র, যা কখনোই বাস্তবায়ন হতে পারে না। পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হবার থেকে সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা গং দাবি করে আসছে- এই অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী ও বাঙালিদেরকে বহিষ্কার করতে সরকারের সাথে তাদের অলিখিত চুক্তি হয়েছে। সেই অলিখিত চুক্তির বলেই এদের প্রভূরা বিদেশের মাটিতে বসে চুক্তি বাস্তবায়নের নামে বাঙালিদের ভাগ্য নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের নিয়ে যেতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সন্তু লারমা গংদের এই ধরনের দাবির প্রেক্ষিতে চুক্তি সম্পাদনকারী তৎকালীন সরকার বর্তমান মহাজোট সরকার একাধিকবার বলেছে, অলিখিত চুক্তি নামে কোনো চুক্তি হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি উচ্ছেদ করার প্রশ্নেই উঠে না। তবে শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রশ্নে পাহাড়ি-বাঙালিদের নানা বিষয় নিয়ে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের নামে বাঙালি প্রত্যাহারে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাসের যে বাসা বেঁধেছিল তা এখনো বলবৎ রয়েছে। ঋণদাতা সংস্থা কিংবা বিদেশী প্রভূ যাই-ই বলি না কেন, তাদের চাপে হোক কিংবা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেরর জন্যই হোক, সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র ৬ মাসের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা বন্ধ এবং স্বায়ত্তশাসনের নামে গেরিলা তৎপরতা, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, হত্যা, রাহাজানি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে তড়িঘড়ি করে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করায় এ অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে নতুন করে সন্দেহ অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল। অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের মোক্ষম সেই সময়কে বেছে নিয়ে বিদেশী মিশনারীরা ব্যাপক সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। যদিও তাদের সেই সব স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সন্তু লারমা গং ও সিএইচটি কমিশনের উপলব্ধি করা উচিত, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন, আবার কোনো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে এতদাঞ্চলের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বরং যে কোনো সময়ের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আরো বেশি বিস্ফোরণেœামুখ হয়ে উঠবে। সন্তু লারমা গং ও সিএইচটি কমিশন যদি মনে করে যে, উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা সৃষ্টি করে সকলের নজর ঘুরিয়ে ফায়দা হাসিল করবে, তবে তারা তা ভুলে যাক। তাদের মনে থাকা উচিত- ১৯০ বৎসর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে মধ্য আগস্টে হানাদার ব্রিটেন এদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত যে, এদেশের প্রতি বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনাবিষ্কৃত থাকা থাকা প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদসহ এ অঞ্চলের মাটির প্রতি তাদের লোলুপ দৃষ্টি, এদেশবাসীকে শাসন-শোষণ করার নেশা এখনো কাটেনি। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ও বাঙালি বিতাড়িত করে উপজাতীয়দেরকে খ্রিস্টান ধর্মের দীক্ষা দিয়ে পার্বত্যঞ্চলকে নিরাপদ খ্রিস্টান অঞ্চল বানানোর চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে তারা। পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে কুচক্রী বিদেশীরা নানা মিশন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত জনপদে অবাধে চলাফেরার লাইসেন্স পেয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিদেশী ইউএন লগো লাগানো গাড়িতে চড়ে এন্টেনা ও শক্তিশালী ওয়ার্লেস সেট লাগিয়ে এরা নিজেদের মিশন বাস্তবায়নে পার্বত্যাঞ্চলের প্রত্যন্ত দুর্গম জনপদ চষে বেড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে এই অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী উন্নয়ন, আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে অনেক দূর পিছিয়ে রয়েছে। তাই পিছিয়ে পড়া এই সব জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের কথা বলে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আনা হয়েছে। পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের নামে তাদের মিশন বাস্তবায়নে এই সব অর্থ ব্যয় হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালে ইউএনডিপি'র দ্বিতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কাজ শেষ হবে। অথচ কি কাজ করেছে, কোথায় করেছে, কার জন্য করেছে তাদের কিছুই জানে না পার্বত্যবাসী। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনও এদের মিশন সম্পর্কে তেমন কোনো খোঁজ খবর রাখে না। দেশী-বিদেশী এসব এনজিওগুলোর কাজের মনিটরিং করার দায়িত্ব পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের। জেলা প্রশাসন মাস শেষে এনজিওদের নিয়ে সমন্বয় সভা করলেও তাদের কর্মকা- নিয়ে তেমন কোনো বিতর্কে জড়াতে চায় না। তবে ইউএনডিপিসহ ঋণদাতা সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে আমাদের উন্নয়নে যেমন বাধা সৃষ্টি করছে, একইভাবে তারা যে উন্নয়নের কথা বলছে তা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। অনেকের মতে, পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান স্থানীয় সংসদ সদস্যদেরকে কোটি কোটি টাকার বিলাসবহুল বিদেশী গাড়ি উপহার দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেসব টাকা বিদেশ থেকে আনা হয়েছে সেই টাকায় কাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে, তা পাহাড়ের মানুষ জানে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিদেশী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের উন্নয়ন ছাড়াও আর কারো উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে হয় না। এরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না, পুনর্বাসিত বাঙালিদের কল্যাণে দীর্ঘ বা স্বল্প মেয়াদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বা তাদের কল্যাণে কোনো টাকা ব্যয় করেছে। যে পরিমাণ টাকা বিদেশীরা এখানে ব্যয় করেছে বলে দাবি করছে তার শত ভাগের একভাগও যদি সঠিকভাবে কাজে লাগতো তাহলে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হতো না। মূলত কুচক্রী বিদেশীরা তাদের এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে খ্রিস্টান অঞ্চল বানানোর পিছনে আনীত অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছে। সেবামূলক নানামুখী কর্মকা-ের আড়ালে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিন পার্বত্য জেলাকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল গড়ে তোলার অপতৎপরতা চালাচ্ছে বিদেশী কয়েকটি ঋণদাতা সংস্থাসহ এনজিওগুলো। দরিদ্র উপজাতীয় সম্প্রদায়কে অর্থবিত্তের লোভ দেখিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার হার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমান্ত এলাকার উপজাতীয় দরিদ্র পরিবারগুলো খ্রিস্টান মিশনারিদের অর্থবিত্তে প্রলুব্ধ হয়ে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে বর্তমানে ১৯৪টি গির্জা উপজাতীয়দের ধর্মান্তরিত করে খ্রিস্টান বানানোর ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এ গির্জাগুলোকে কেন্দ্র করেই দেশী-বিদেশী এনজিও ও অন্যান্য সংস্থা তাদের সব তৎপরতা চালায়। খ্রিস্টান ধর্মবিস্তারে কাজ করছে ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি), গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন (গ্রাউস), কারিতাস বাংলাদেশ, অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চ অব বাংলাদেশ, ইভেনজেলিক্যাল ক্রিশ্চিয়ান চার্চ (ইসিসি) ইত্যাদি। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনগুলো বান্দরবানে ৬ হাজার ৪৮০টি উপজাতীয় পরিবারকে খ্রিস্টান পরিবারে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। রাঙামাটিতে ক্যাথলিক মিশন চার্চ, রাঙামাটি হোমল্যান্ড ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ও রাঙামাটি ব্যাপ্টিস্ট চার্চ প্রায় ১ হাজার ৬৯০ উপজাতীয় পরিবারকে খ্রিস্টান পরিবারে পরিণত করেছে। গত দুই দশকের ব্যবধানে শুধু খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ১২ হাজার ২শ' উপজাতীয় পরিবারকে খ্রিস্টান করা হয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই খ্রিস্টানিকরণ ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গত বহন করছে; যা অদূর ভবিষ্যতে দেশের স্বাধীনতা-সাবেভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে। |
__._,_.___