সমস্যাটি সরকারকে অতি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার এবং নকল ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং বাজারজাতকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা দরকার। এক্ষেত্রে ওষুধের দোকানগুলোতে এর কারখানাগুলোতে অভিযান চালিয়ে যদি কারও দোকানে বা কারখানায় নকল বা বিদেশী চোরাই ওষুধ পাওয়া যায়, তাহলে ওইসব দোকানের বা কারখানার লাইসেন্স বাতিল ও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশে ওষুধ শিল্পের আকার একদিকে যেমন বড় হচ্ছে, অন্যদিকে সমান্তরালভাবে বড় হচ্ছে নকল ও নিম্নমানের ওষুধের বাজার। বর্তমানে ওষুধ শিল্পের আকার ১০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে নকল ও নিম্নমানের ওষুধের দখলে রয়েছে দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার বাজার।
রাজধানীতে নিম্নমানের নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে বাজার ছেয়ে গেছে। নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করায় শুধু জটিল রোগ-ব্যাধি নয়, ঘটছে মৃত্যুর মতো ঘটনাও। সারাদেশে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি প্রায় ২০ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ওষুধই ওষুধ প্রশাসনের কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অবাধে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ফলে ভেজাল ওষুধ অতি সহজেই হাতে চলে আসছে।
সংশ্লষ্টি সূত্র মতে, বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার ওষুধ নকল হচ্ছে বাংলাদেশে। দেশে ৮ শতাধিক বেশি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৭০০ প্রতিষ্ঠানই নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে। সূত্রমতে, দেশে বছরে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে আড়াইশ কোটি টাকার ওষুধই ভেজাল হচ্ছে। ফলে রোগীরা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি গুরুতর শারীরিক ক্ষতিরও শিকার হচ্ছে।
রাজধানীতে বিভিন্ন ভেজালবিরোধী অভিযানে দেখা যায়, নকল কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে জীবন রক্ষায় সহায়তাকারী ওষুধ হাইড্রোকরটসিন ইনজেকশন। নকল হচ্ছে মিথাইল প্রডেনিসোলন গ্রুপের একটি ইনজেকশন। এছাড়া বিভিন্ন তরল ওষুধেরও নকল হচ্ছে অহরহ। মাত্র ৩০ টাকা মূল্যের অ্যান্টিবায়োটিক এমোক্সিসিলিন ড্রাই সিরাপের বোতলে দামি অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাই সিরাপের লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে। নকল হচ্ছে যক্ষ্মা রোগের ওষুধ রিফিমপিসিন ট্যাবলট। এ ট্যাবলেটের মধ্যে রাসায়নিক কোনো উপাদান নেই। শুধু ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয় এ ওষুধ। কিডনি ও ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইপরেক্স ইনজেকশন এবং এর সঙ্গে মেশানো পানির অ্যাম্পুলেও ভেজাল ধরা পড়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ২৪৬টি অ্যালোপ্যাথিক, ২২৪টি আয়ুর্বেদিক, ২৯৫টি ইউনানী ও ৭৭টি হোমিও প্যাথিকসহ ৮৪২টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ওষুধ উৎপাদনকারী পাশাপাশি কয়েক হাজার নকল ওষুধ তৈরি কারখানা রয়েছে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, লালবাগ, ইসলামবাগ, মিরহাজীরবাগ, জিগাতলা, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, জিঞ্জিরা, বাড্ডা, রামপুরা, সাভার ও টঙ্গীতে।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশে প্রায় সোয়া দুই লাখ ওষুধের দোকান রয়েছ। এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৬০ হাজার দোকানের। এরা অবাধে নকল ওষুধ বিক্রি করছে। এছাড়াও স্থলপথ ও আকাশপথেও ভারত, মিয়ানমার, দুবাই, সউদী আরব, পকিস্তান ও থাইল্যান্ড থেকে নিষিদ্ধ ওষুধ দেশে আসছে। চোরাইপথে আসা এসব ওষুধ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ঢাকার মিটফোর্ড, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
বাংলাদশে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সূত্রে আরো জানা যায়, আটক ওষুধ পরীক্ষা করে দেখা গেছে আটা, ময়দা, চিনি, বেসন, পানি ও অ্যারারোডের সঙ্গে তরলজাতীয় পদার্থ মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল। এসব নকল ওষুধের গায়ে লাগানো হচ্ছে দামি প্রতিষ্ঠানের লেবেল। কম দামি ওষুধ ও ক্যাপসুল কিনে বোতলের গায়ে লেখা হচ্ছে দামি ওষুধের নাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স ও বায়ো কেমিস্টি সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে ১ হাজার ৭০৭টি বাণিজ্যিক ওষুধকে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাতিল করা হয়েছিল। এর ফলে, নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বাজারে খুবই কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে ওষুধনীতিতে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধকে চিহ্নিত করা হয়নি। এর ফলে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো বেশি মুনাফার জন্য নকল, ভেজাল ও নিম্নমারে ওষুধ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
ওষুধের ক্ষেত্রে অনাচারের অর্থই হচ্ছে মানুষের জীবন নিয়ে বাণিজ্য। জীবন নিয়ে প্রতারণা। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিইয়ীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, "যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়।" পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে- "মানুষকে হত্যা করা কুফরী।"
মূলত, চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রতারণার দ্বারা উপরোক্ত দু'অপরাধ বা তদপেক্ষা বেশি অপরাধও প্রযোজ্য হয়। যে অপরাধবোধ ওষুধ প্রস্তুতকারী মালিক, বিক্রয় প্রতিনিধি, বিক্রয়কারী এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তার তথা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কারো মধ্যেই নেই বললেই চলে।
__._,_.___