ফারুকী হত্যাকা-পরিকল্পিত ॥ পরিবারের দাবি
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ধর্মীয় মতপার্থক্যগত কারণেই উগ্র মৌলবাদী বিশেষ কোন গোষ্ঠী মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক বা লেনদেনের কোন কারণে হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেনি। ডাকাতিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে খুনীরা হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে তাও নয়। হত্যাকারীরা ঘটনাটিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই ডাকাতির নাটক সাজায়। ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে ডাকাতি নয়। পরিকল্পিত হত্যাকা-। সুন্নতের বিপক্ষে থাকা ওহাবী ও খারিজী সম্প্রদায়ের বিশেষ কোন গোষ্ঠী বা উগ্র কোন মৌলবাদী গোষ্ঠী হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
বুধবার নিজবাড়িতে রীতিমতো আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে এমনটাই দাবি করেছেন নিহতের পরিবার। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মাওলানা ফারুকীর দ্বিতীয় পক্ষের বড় ছেলে ঢাকার লালবাগ আলিয়া মাদ্রাসার কামেল শ্রেণীর শিক্ষার্থী আহমেদ রেজা ফারুকী (২৬)। তিনি বলেন, ঘটনাটি খুবই পরিকল্পিত। তার পিতা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। এছাড়া টেলিভিশনে শান্তির পথে ও কাফেলা নামক দুইটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করতেন। অনুষ্ঠানে তার পিতা সুন্নতের কথা, নবী-রাসুলের কথা বেশি বেশি বলতেন। এ জন্য তাঁর ওপর ওহাবী ও খারিজী গোষ্ঠী অসন্তুষ্ট ছিল। ঘটনার দেড়বছর আগ থেকে তার পিতাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু পিতা কোন সময়ই বিষয়টি আমলে নেননি। তার জের ধরে ওহাবী বা খারিজী বা অন্যকোন বিশেষ উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী তার পিতাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করতে পারে।
তার দাবি, এটি ডাকাতি নয়। পরিকল্পিত হত্যাকা-ের মোটিভ ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতেই হত্যাকারীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পনামাফিক ডাকাতির ঘটনা ঘটায়। হত্যাকারীদের আসল উদ্দেশ্য ডাকাতি নয়। তার পিতাকে হত্যা। বিশেষ করে মহিলা ও বাড়িতে ঢোকা মেহমানদের বেঁধে রাখা এবং তাদের মারধর না করা এবং তাদের কাছ থেকে কোন কিছু না নেয়া প্রমাণ করে হত্যাকা-টি পরিকল্পিত। তার পিতাকে হত্যার জন্যই হত্যাকারীরা ঢুকেছিল। দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেই হত্যাকা-টি ঘটানো হয়েছে। মামলায় এসব ভুলবশত উল্লেখ করা হয়নি বলে বুধবার আবারও জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেছেন নিহতের মেজ ছেলে ফয়সাল ফারুকী। সংবাদ সম্মেলনে কিভাবে হত্যাকা- সংঘটিত হয় তারও বর্ণনা দেয়া হয়।
নিহতের বাড়িতে থাকা এবং ফারুকীর সঙ্গে হত্যাকারীদের আক্রমণের শিকার হওয়া মারুফ জানায়, বিকেল চারটার দিকে মাহমুদা ঢোকেন। তিনি সন্ধ্যা ৬টার দিকে বের হন। হজে যাওয়ার কথা বলে তিনি বাড়িতে ঢুকেছিলেন। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে হজে যাওয়ার কথা বলে দুই যুবক বাড়িতে ঢুকে। দুই যুবককে বাইরের ড্রইং রুমে বসতে দেয়া হয়। বসেই ফোন করে। এরপর আরও ৫-৬ জন ঢোকে। দুই যুবক হুজুর ও তাঁর গলায় পিস্তল ও ধারালো ছুরি ধরে জিম্মি করে। হত্যাকারীরা হুজুরের কাছে ৫০ লাখ টাকা আছে বলে দাবি করে। হুজুর টাকাগুলো হজযাত্রীদের টাকা এবং সেই টাকা সৌদি আরবের ব্যাংকে জমা আছে বলে জানায়। এরপর হত্যাকারীরা বিছানার চাদর কেটে তা দিয়ে রশি বানিয়ে তাদের হাত-পা মুখ বেঁধে ফেলে। বাকিরা ভেতরের রুমে চলে যায়। ভেতরে গিয়ে হত্যাকারীরা নিহতের স্ত্রী লুবনা ইসলাম (৪২), দাদী জয়গুন নেছা (৭০), গৃহকর্মী শরীফা খাতুন (৩৫) ও দুইজন মহিলা মেহমানকে একটি বেডরুমে নিয়ে হাত-পা-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। এ সময় কলিং বেল টিপে তিন পুরুষ প্রবেশ করলে তাদেরও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা-মুখ বেঁধে পাশের আরেকটি বেডরুমে আটকে রাখে। তারপর মাওলানা ফারুকীকে ড্রইংরুম থেকে ডাইনিং রুমে নিয়ে পূর্ব দিকে মাথা রেখে জবাই করে হত্যাকারীরা।
সংবাদ সম্মেলনে মাওলানা ফারুকীর স্ত্রী লুবনা ইসলাম, তার ছেলে দ্বিতীয় ছেলে রাজধানীর বনানী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফয়সাল ফারুকী (২২), তৃতীয় ছেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর কাদেরীয়া মাদ্রাসার ছাত্র ফুয়াদ ফারুকী (১৭), গৃহকর্মী শরীফা খাতুন (৩৫), নিহতের প্রথম স্ত্রী আয়েশা বেগম (৫০), তার ছেলে নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাসুদ বিন নূর (২৮), মেয়ে হুমায়রা তাবাস্সুম তুবা (২৪) ও লাবিবা হোসনা লুবা (১৯) উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর মুন্সী বাড়ির দ্বিতীয় তলায় গলা কেটে হত্যা করা হয় বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের শান্তির পথে ও কাফেলা নামক দুইটি ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও সুপ্রীমকোর্ট জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে।
ঘটনার দিন সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় নিহতের দ্বিতীয় ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-২৭। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ৭ থেকে ৮ জন খুনী তাদের বাসায় ঢুকে তার পিতা মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যার করে। হত্যার পর খুনীরা বাড়ি থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, দেড় লাখ টাকা মূল্যমানের একটি ডিজিটাল ক্যামেরা, একটি ৩৩ হাজার টাকা দামের মোবাইল (ট্যাব) ও আনুমানিক ৪ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে হত্যাকারীরা প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে যায়। হত্যাকারীদের পরনে প্যান্ট, হাফহাতা গেঞ্জি ও শার্ট ছিল। হত্যাকারীরা বিভিন্ন বয়সী। তবে কারও বয়সই ৪৫ বছরের বেশি নয়। বর্তমানে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় রহস্যময় নারী মাহমুদা খাতুন (৪৩), শরিফুল ইসলাম (৩৫) ও ইউসূফ নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মাহমুদা খাতুনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে তদন্তকারী সংস্থা।