পরিকল্পনাটি বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠানো হয়েছিল
04 Sep, 2014
ফেব্রুয়ারি মাসের বিভিন্ন ঘটনা দেখে আমার মনে হয়েছিল, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ইতিমধ্যেই তারা গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য নিয়ে আসা শুরু করে। পাকিস্তানিদের এ ধরনের খারাপ মতলব বা কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ বা রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। এমনকি বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের কাছেও বিষয়টা খুব গোপন রাখা হতো। সম্ভবত বাঙালি হিসেবে আমিই প্রথম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য নিয়ে আসার বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ অবরসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীরউত্তমের লেখা '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' শীর্ষক বইয়ে এ সব কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক নেতৃত্বদানকারী এ কে খন্দকার সদ্য প্রকাশিত বইতে আরও লিখেছেন, ২৫শে মার্চ রাতে হাজার হাজার মানুষ বেঁচে যেতেন, যদি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ঠিক সময়ে যুদ্ধ শুরু করতে পারতাম। বারবার মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধু কেন ওই রাতে কাউকে কিছু বলে গেলেন না? আবার ভাবি, উনি কাদের বলবেন? হয় তাজউদ্দীন সাহেব, না হয় নজরুল ইসলাম সাহেবকে। তিনি হয়তো বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদেরও বলে যেতে পারতেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা তাঁর (মুজিব সাহেবের) নির্দেশনা জানতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলেননি বা আমরা কিছুই জানতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে জানতে পেরেছি, চট্টগ্রামে অবস্থিত ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের নেতৃত্বে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা একটি সামরিক পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনাটি ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (বীরবিক্রম, পরে মেজর জেনারেল) মারফত বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠানো হয়েছিল। সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে চলে এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন। এসময় চট্টগ্রামসহ সারা পূর্ব পাকিস্তানেই বাঙালি সেনাদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল, ফলে যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এ কে খন্দকার লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আসার সংবাদ আমি নিজের ভেতরে রাখিনি, বরং চেষ্টা করেছি সবাইকে জানাতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছি। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র এক ডিভিশন (১৪তম ডিভিশন) সৈন্য ছিল। এই ডিভিশনের জনবল ছিল প্রায় ১৪ হাজার। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ডিভিশন হিসেবে পরিচিত ৯ ডিভিশন ও কোয়েটা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৬ ডিভিশনকে এভাবে গোপনে বেসামরিক পোশাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। অন্যদিকে ২ মার্চ 'এমভি সোয়াত' নামের একটি পাকিস্তানি জাহাজ প্রায় সাত হাজার টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। এতে বোঝা যায়, পাকিস্তানিরা কিভাবে দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করছিল। এ সংবাদ আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে জানতেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাদের (পাকিস্তানিদের) শক্তি বৃদ্ধির দিকে ছিল না। তাঁদের একটি ধারণা ছিল, তাঁরা সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করে ফেলবেন। আমি মনে করি, জাতির এ ধরনের ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়াও একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল, যাতে একটি ব্যর্থ হলে অন্যটি প্রয়োগ করা যায়। আমি এমন কোন তথ্য পাইনি, যাতে মনে করতে পারি যে রাজনৈতিক পন্থা ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ নেতারা বিকল্প পন্থা হিসেবে অন্য কোন উপায় ভেবে রেখেছিলেন। সম্ভবত মার্চ মাসের শুরুতে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সেনা আনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন বাঙালি বৈমানিক ক্যাপ্টেন নিজাম চৌধুরী। তিনি পিআইএর কো-পাইলট ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি পিআইএর বিমানে সৈনিক পরিবহনে অস্বীকৃতি জানান এবং বিমান থেকে নেমে চলে যান। সামরিক কর্তৃপক্ষ এটাকে সহজভাবে নেয়নি। তারা ক্যাপ্টেন নিজামকে বরখাস্ত এবং অন্তরীণ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
একাত্তরের ১লা মার্চ শাহীন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছিল। ওই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ঢাকা এয়ার বেসের কমান্ডার এয়ার কমোডর জাফর মাসুদের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। এয়ার কমোডর মাসুদ হঠাৎ ওই দিন সকাল প্রায় আটটার দিকে আমাকে বলেন, খন্দকার, তুমি আজকের অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থেকো এবং সভাপতিত্ব করো। যাহোক, ১ মার্চ বেলা একটার দিকে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। অধিবেশন বাতিলের ঘোষণাটি যখন এলো, আমি তখন শাহীন স্কুলের ভেতরে। তখন কোথায় অনুষ্ঠান, কোথায় পুরস্কার! সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। দ্রুত ঢাকার চেহারা পাল্টে যেতে লাগলো। ইয়াহিয়ার ঘোষণার পরপরই জনতা রাজপথে নেমে আসে। ঢাকায় বিক্ষোভ শুরু হলে কলেজের অনুষ্ঠানটি ভেস্তে যায়। ইয়াহিয়া খান জাতীয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করলে জবাবে আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির তৎপরতা- এ দুটি বিষয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যরা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। আমি নিজেও গভীরভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করতাম। সরকারের ভেতরের খবরগুলো উইং কমান্ডার এস আর মীর্জা, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা ও অন্যদের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতাম 'আমাদের কি করতে হবে?' এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোন নির্দেশ পাইনি। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতারা আমাদের কিছু জানাননি। যদি কেউ বলেন যে তখন আওয়ামী লীগের নেতারা যুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তবে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় যে তা সঠিক নয়। অন্তত আমি কোন নির্দেশনা পাইনি। শোনা যায়, মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে পুরনো ৩০৩ রাইফেল দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো তখন তথ্যপ্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। তাই এ ধরনের কোন তৎপরতার খবর তাৎক্ষণিকভাবে আমি বা অন্য কোন সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারিনি। এর ফলে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা হয় যে রাজনৈতিক নেতাদের কোন ধরনের যুদ্ধ প্রস্তুতি নেই। ফলে ২৫শে মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করল, তখন এটিকে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি সেনাসদস্যদের কোন প্রস্ততি ছিল না। এটাই ছিল বাস্তব সত্য।
একাত্তরের ১লা মার্চ শাহীন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছিল। ওই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ঢাকা এয়ার বেসের কমান্ডার এয়ার কমোডর জাফর মাসুদের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। এয়ার কমোডর মাসুদ হঠাৎ ওই দিন সকাল প্রায় আটটার দিকে আমাকে বলেন, খন্দকার, তুমি আজকের অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থেকো এবং সভাপতিত্ব করো। যাহোক, ১ মার্চ বেলা একটার দিকে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। অধিবেশন বাতিলের ঘোষণাটি যখন এলো, আমি তখন শাহীন স্কুলের ভেতরে। তখন কোথায় অনুষ্ঠান, কোথায় পুরস্কার! সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। দ্রুত ঢাকার চেহারা পাল্টে যেতে লাগলো। ইয়াহিয়ার ঘোষণার পরপরই জনতা রাজপথে নেমে আসে। ঢাকায় বিক্ষোভ শুরু হলে কলেজের অনুষ্ঠানটি ভেস্তে যায়। ইয়াহিয়া খান জাতীয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করলে জবাবে আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির তৎপরতা- এ দুটি বিষয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যরা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। আমি নিজেও গভীরভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করতাম। সরকারের ভেতরের খবরগুলো উইং কমান্ডার এস আর মীর্জা, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা ও অন্যদের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতাম 'আমাদের কি করতে হবে?' এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোন নির্দেশ পাইনি। এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতারা আমাদের কিছু জানাননি। যদি কেউ বলেন যে তখন আওয়ামী লীগের নেতারা যুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তবে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় যে তা সঠিক নয়। অন্তত আমি কোন নির্দেশনা পাইনি। শোনা যায়, মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে পুরনো ৩০৩ রাইফেল দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো তখন তথ্যপ্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। তাই এ ধরনের কোন তৎপরতার খবর তাৎক্ষণিকভাবে আমি বা অন্য কোন সামরিক কর্মকর্তারা জানতে পারিনি। এর ফলে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা হয় যে রাজনৈতিক নেতাদের কোন ধরনের যুদ্ধ প্রস্তুতি নেই। ফলে ২৫শে মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করল, তখন এটিকে প্রতিহত করার জন্য বাঙালি সেনাসদস্যদের কোন প্রস্ততি ছিল না। এটাই ছিল বাস্তব সত্য।
উৎসঃ মানব জমিন
__._,_.___