প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০:০০আপডেট : ১৯ অক্টোবর, ২০১৪ ০১:১৭:২৩ |
ছাত্রদলে বিদ্রোহে বিব্রত বিএনপি
কার্যালয়ে তালা : আজ থেকে লাগাতার অবস্থান
ইরফান এইচ সায়েম ও মনিরুজ্জামান
নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে শনিবার পদবঞ্চিত ছাত্রদল কর্মীদের বিক্ষোভ - আলোকিত বাংলাদেশ
সরকারবিরোধী আন্দোলনের ভিত মজবুত করতে ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। কমিটিতে বিবাহিত অছাত্র, ছাত্রলীগের ক্যাডার, হত্যা মামলার আসামি স্থান পেয়েছেন এবং ত্যাগী নেতাকর্মীরা বাদ পড়েছেন- এই অভিযোগে বিভিন্ন জায়গায় অব্যাহতভাবে বিক্ষোভ করেছেন পদবঞ্চিত নেতারা। সর্বশেষ শনিবার দুপুরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব প্রবেশ করলে পদবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন। তারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। কমিটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তারা অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেন। জানা গেছে, মির্জা ফখরুল ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদলের পদবঞ্চিতরা প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এতে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। প্রায় ২০ মিনিট পর ফখরুল ইসলাম নিচে নেমে এলে তারা তালা খুলে দেন। পরে দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ কার্যালয়ে এলে তাকে ঘিরে রেখে ক্ষোভের কথা জানান তারা। বেলা পৌনে ৩টার দিকে ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী এবং সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন।
ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন শনিবার বিকাল ৫টার দিকে জানান, রোববার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রতিদিন কমিটি বাতিল না হওয়া ছাত্রদলে বিদ্রোহে পর্যন্ত তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত এই অবৈধ কমিটি বাতিল করা না হবে, ততদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আমাদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে। ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের পর ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এজন্য শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন তিনি। এসময় সবাই তরুণ ও নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন। এরপর বিবাহিত ও বয়স্করা বাদ পড়ছেন বলে আলোচনা ওঠে। তবে শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবে দেখা যায়নি। তবে দলটির নেতারা বলেছেন, বাস্তবতার আলোকেই নতুন কমিটিতে তাদের রাখা হয়েছে। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, তারুণ্যনির্ভর কমিটি গঠন করতে গিয়ে কিছু সিনিয়র নেতাকে ছাত্রদলের কমিটিতে রাখা সম্ভব হয়নি। যারা বাদ পড়েছেন তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনে জায়গা করে দেয়া হবে। নতুন এ কমিটি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সংশ্লিষ্টদের অনেক অভিযোগ মাথায় নিয়ে ও বিচার-বিশ্লেষণ করে চেয়ারপারসন নিজেই ছাত্রদলের এই কমিটি ঘোষণা দিয়েছেন। এতে সভাপতি-সেক্রেটারিসহ অন্য পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তা যৌক্তিকই বলে মনে করি। এই কমিটিকে যে সময় দেয়া হয়েছে সে পর্যন্ত দেখা উচিত। আশা করি তারা যোগ্যতার পরিচয় দেবে।
নতুন কমিটি নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ও বঞ্চিতদের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কমিটিতে যারা থাকতে পারেনি তাদের ক্ষুব্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এটা সাময়িক ব্যাপার। বিএনপির সিনিয়র নেতারা সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এর সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান জানান, দলের সিনিয়র কিছু নেতা এই বিক্ষোভ করে বিষয়টি অতিরঞ্জিত করছেন। এছাড়া কিছু লোক সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তাদের যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল কিংবা অন্য অঙ্গ সংগঠনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের ২০১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠনের তথ্য জানানো হয়। সদ্য বিলুপ্ত জুয়েল-হাবীব কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব আহসানকে সভাপতি এবং যুগ্ম সম্পাদক আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। খালেদা জিয়া ওই কমিটির অনুমোদর দেন। কমিটিতে সহ-সভাপতি ৩৩ জন, যুগ্ম সম্পাদক ৩৫ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক ২৭ জন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ২৮ জন। আংশিক কমিটির কথা বলা হলেও ১৫৩ জনের নাম পাওয়া যায় বিজ্ঞপ্তিতে। কমিটি ঘোষণা হওয়ার পরদিনই দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিতরা। পরে এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বঞ্চিতরা বলছেন, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু কমিটির ৬০ ভাগই নিজেদের পছন্দের লোক দিয়েছেন। বয়সসীমায় আগের কমিটিতে থাকার পরও অন্তত ৩০ নেতার নতুন কমিটিতে জায়গা হয়নি। সূত্র জানায়, সদ্য ঘোষিত কমিটিতে অন্তত ৭০ ভাগ ছাত্রনেতাই বিবাহিত। অধিকাংশেরই ছাত্রত্বের প্রমাণ মেলেনি। সদ্য ঘোষিত কমিটির সভাপতি রাজিব আহসান ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বিগত কমিটিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন তিনি। এছাড়া বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করা হয়েছে। কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলোচিত নেতা আকরামুল হাসান। ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর রাজনীতির মাঠে নামেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, দলীয় কর্মসূচি নিয়ে তিনি যতটা না সক্রিয়, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত দলীয় পদ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। টুকু-আলিম কমিটির সময় দুবার বহিষ্কৃত হওয়ার কলঙ্কও রয়েছে তার। সিনিয়র ৩৩ সহ-সভাপতির মধ্যে রয়েছে অছাত্র, বিবাহিত, হত্যা মামলার আসামি, সংস্কারপন্থী ও প্রবাসী ছাত্রনেতার ছড়াছড়ি। ছাত্রদলের মিছিলে গুলি চালানো এক সময়ের ছাত্রলীগ ক্যাডার হলেন সহ-সভাপতি মহিদুল ইসলাম হিরু। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, হিরু ২০০২ সালের আগে তৎকালীন মুহসীন হল ছাত্রলীগ সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফিকের ক্যাডার হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। শফিকের নির্দেশেই তিনি ২০০১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিবাদ মিছিলে প্রকাশ্যে গুলি চালান। ওই ছবি পত্রপত্রিকাগুলোয় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন কমিটির সহ-সভাপতি মামুন বিল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সনি হত্যা মামলার আসামি, জগন্নাথে ডাবল পুলিশ মার্ডার আসামি তারেকুজ্জামান তারেক এবং আবু আতিক আল হাসান মিন্টু জহুরুল হক হলের ছাত্রদল নেতা খোকন হত্যা মামলার আসামি। এছাড়া প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম হিমেল বাংলাদেশ মেডিকেলের এক ছাত্র হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। ছাত্রদলের নেতাদের বড় একটি অংশই শেয়ারবাজার ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী। এছাড়া শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গেও একাধিক ছাত্রনেতা যুক্ত বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রদলের কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন আবু আতিক আল হাসান মিন্টু, আসাদুজ্জামান আসাদ, নুরুল হুদা বাবু ও শাহ নাসির উদ্দিন রুম্মন। এছাড়া সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম রিবলু ও ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক ফাহমিদা মজিদ ঊষা স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করছেন। এছাড়া অনেকের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ করার অভিযোগ ও নানা অপরাধে একাধিক মামলা, টাকা খেয়ে একাধিকজনকে পদ পাইয়ে দেয়াসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, কমিটির পক্ষে-বিপক্ষে শুক্রবার সিলেট নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় ছাত্রদলের দুই পক্ষে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সিলেট কোতোয়ালি থানার এসআই কামাল হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ৭০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদলের চার নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
রাবিতে আনন্দ মিছিল পন্ড : রাবি প্রতিনিধি জানান, পুলিশের বাধায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আনন্দ মিছিল পন্ড হয়ে গেছে। ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়ে শনিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় এ আনন্দ মিছিলের আয়োজন করে সংগঠনটি।
সুপার ফাইভে কেউ নেই জবির : কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অবস্থান নগণ্য। ১৫৩ সদস্যের কমিটিতে জবি ছাত্রদল থেকে স্থান পেয়েছে মাত্র ১৫ জন। তবে 'সুপার ফাইভে' জবির কেউ নেই। এতে জবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে মাঠ গরম করতে গিয়ে গুম, গ্রেফতার ও আহত হয়েছেন এই শাখার অসংখ্যা নেতাকর্মী। তবে ত্যাগ স্বীকার করেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে শক্ত অবস্থান পায়নি জবি ছাত্রদল। জানা গেছে, বহুল প্রতীক্ষিত কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে আশাবাদী ছিলেন জবি শাখার নেতাকর্মীরা। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হয়নি বরং হতাশ হয়েছেন তারা। জবি ছাত্রদলের সিনিয়র নেতারা বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলে জবি থেকে স্থান পেয়েছেন মাত্র ১৫ জন। বাদ পড়েছেন পরিশ্রমী নেতারা। আন্দোলন-সংগ্রামে সরকারদলীয় ছাত্রনেতা ও পুলিশ কর্তৃক লাঞ্ছিত নেতাকর্মীরা ঠাঁই পাননি কমিটিতে। একাধিকবার জেল খেটেছেন এমন কর্মীর সংখ্যা জবিতে নেহাত কম নয়।
http://www.alokitobangladesh.com/first-page/2014/10/19/102365
ছাত্রদলের ধাক্কায় তোলপাড় ॥ বেসামাল বিএনপি
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2014-10-19&ni=189059
ছাত্রদলের কমিটি খুনের আসামি, বিবাহিত ও অছাত্রদের প্রাধান্য
সাখাওয়াত আমিন, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
__._,_.___