http://www.bkagoj1.com/print-edition/2014/11/20/5417.php
মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে আইন
আমাদের দেশে মেয়েদের বয়স নাকি বলতে মানা। আর বিয়ের বয়স? ওটা 'দেবা ন জানন্তি কুত মনুষ্যা!' তবে দেশে আইন আছে, মেয়েদের ১৮-এর আগে বিয়ে দেয়া যাবে না। শহরে-গঞ্জে বা যারা লেখাপড়া করছেন, ১৮-এর আগে তাদের বিয়ে হয়ও না, সেটা আইনের জন্যে নয়, এমনিতে, পিতামাতা দেননা। গ্রামের কথা অবশ্য ভিন্ন, ১৮-এর আগে হাজারো নারীর বিয়ে হয়, আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। বাংলাদেশ, যেখানে আইন না মানাই 'আইন', সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে একটি আইন আছে, ধারণা করি গ্রামের মানুষ তা জানেইনা। ওটা এমন একটি আইন যা নিয়ে কারো কখনো মাথাব্যথা ছিলোনা। এখনো আছে তা নয়। তবে অধুনা সরকার এই আইনটি পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, এজন্যে অনেকের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে।
ইউনিসিফের মতে, বাংলাদেশ বাল্য-বিবাহের ক্ষেত্রে বিশ্বে নাইজিরিয়ার পরেই, অর্থাৎ সেকেন্ড। সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৫ করতে চান। এই আইনের প্রভাব কি তা বলা মুস্কিল, কিন্তু বিশ্বের কিছু নেতৃবৃন্দ এক খোলা চিঠিতে ইতিমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে আইনটি পরিবর্তন করা না হয়। ঢাকার কাগজেও এটা ছাপা হয়েছে। 'এলডারস' নামে একটি সংগঠন-এর প্রধান সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান এ আহবান জানিয়েছেন। রয়টার জানাচ্ছে, 'এলডারস'-এর ওয়েবসাইটে ওই চিঠিটি আছে। নেলসন ম্যান্ডেলা এই সংগঠনের প্রতিষ্টাতা এবং নোবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু; সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বা আইরিশ প্রেসিডেন্ট রবিনসন -এর মত বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিরা এর সাথে যুক্ত। খোলা চিঠিতে 'এলডারস' বলেছে, এরফলে মেয়েদের উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটাবে এবং দারিদ্র বিমোচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
হটাৎ করে সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স পাল্টানোর আইন করতে উদ্যোগী হলেন কেন? এটা কি কোন জরুরী ইস্যু? নাকি, 'নাই কাজ তো খই ভাঁজ।' এযুগে বিয়ের বয়স বাড়ানো যেতে পারে, কমানোর যুক্তি কি! আর বিয়ে তো হরদম হচ্ছে, আইন কেন? এর পেছনে মৌলবাদীদের কোন এজেন্ডা নেইতো? ক'দিন আগে প্রায় পুরো বাংলাদেশ একদিন অন্ধকারে ছিলো। ঢাকা থেকে একজন জানতে চাইলেন, 'দাদা, এটা জামাতের কারসাজি নয়তো? বললাম, কেন? তিনি বললেন, মৌলবাদীরা একদিনে ৫শ বোমা ফাটাতে পারে, কাজেই ওরা একসাথে পুরো বাংলাদেশও অন্ধকার করে দিতে পারে! যুক্তি অকাট্য। আসলেই ওরা পারে, বিয়ের বয়স কমানোর পেছনেও ওরা থাকলে অবাক হবর কিছু থাকবে না। কারণ এই ডিজিটাল সরকার উল্টোদিকে হাটতে পারেনা। ছোটবেলায় আমাদের ভয় দেখিয়ে বলা হতো, 'ভুত পিছন দিকে হাটে'। বাংলাদেশ তো ভুত নয় যে পিছন দিকে হাটবে!
ব্যারিস্টার শফিক আইনমন্ত্রী থাকতে হিন্দু মেয়েদের বাপের সম্পত্তি দেয়ার লক্ষ্যে একটি আইন করার উদ্যাগ নিয়েছিলেন। উদ্যাগটি ভালো। ভারতে এই আইনটি আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভারত নয়, তাই আইনটি হয়নি। কারণ সরকার জেনেছেন, হিন্দুরা এর পক্ষে নয়। তাহলে কি হিন্দুরা চায়না তাদের মেয়েরা বাপের সম্পত্তি পাক? মহিলা নেত্রী রাখী দাশপুরকায়স্থ আমেরিকা এলে এনিয়ে অনেকের সাথে বসেছিলেন। তাকে যেটা বুঝানো হয়েছে, তা হলো, সবাই এই আইনের পক্ষে, যদিনা, তাতে একটি ক্লজ থাকে যে, 'অন্য ধর্মে বিয়ে হলে মেয়েটি তার সম্পত্তির ওপর অধিকার হারাবেন।' তাকে আরো যা বোঝানো হয়েছিলো, তা হলো, ' নইলে তো রাজকন্যা ও রাজত্ব' দু'টিই যাবে। আসলে ব্যারিস্টার শফিক বা রাখিদি দু'জনেই বামপন্থী, তাদের চিন্তাধারাও স্বচ্ছ, কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন। এই আইনটির কোন মেরিট ছিলোনা; যেমন মেরিট নেই মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো আইনের।
যুক্তরাষ্ট্রে মেয়েদের বিয়ের বয়স কত? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুরো আমেরিকায় প্রায় সব স্টেটে সেটা ১৮। তবে নাব্রাস্কা ও মিসিসিপিতে তা যথাক্রমে ১৯ ও ২১। অধিকাংশ স্টেট পিতামাতা ও বিচার বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে ১৬ বছরের মেয়েদের বিয়ের পক্ষে। যদিও কোন মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে কোনরকম অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করতে বয়সের কোন বাঁধা নেই। যেদেশে ছেলে-ছেলে বা মেয়ে-মেয়ে বিয়ে হচ্ছে, অথবা বিয়ের সজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক চলছে, সেখানে বিয়ের বয়স কোন বিষয়ই নয়। আমরা যারা বা আমাদের দেশে বিয়ে বলতে আমরা যারা বুঝি 'দু'টি সাবালক ছেলে-মেয়ের' মিলন, সেখানে সাবালিকার বয়স কমিয়ে নাবালিকা করার কোন মানে হয়না। 'এলডারস' কি বলেছে তৎজ্জন্যে নয়, আমাদের দেশের মানুষও সম্ভবত: নাবালিকা বিয়ের বিপক্ষে। সুতরাং আইনটি বদলানোর কি কোন প্রয়োজন আছে? অন্তত: প্রয়োজনটা তো এমন জরুরী নয় যে, আইন করে দেশের আদিবাসীদের 'আদিবাসীত্ব' ঘুচিয়ে দিতে হবে!
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
১৮ই নভেম্বর ২০১৪। নিউইয়র্ক।
__._,_.___