ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে নিরীহ মানুষের ওপর গত ৮ জুলাই থেকে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এরও প্রায় এক সপ্তাহ পর স্থল পথেও হামলা শুরু করে তারা। 'অপারেশন প্রটেকটিভ এজ' নামের এই অভিযানে, ইসরায়েলি বর্বরতায় হতবাক গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ।
রাতের অন্ধকারে কিংবা ভোরের আলো ফুটতেই, গাজা ভূখণ্ডে সক্রিয় হয়ে ওঠে ইসরায়েলি জঙ্গি-বিমানগুলো। বোমা ফেলা হয় হামাসের বিভিন্ন স্থাপনা, নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের ওপর। বাড়তে থাকে লাশের মিছিল; বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপের ভিতর ফুলের মতো শিশুদের প্রাণহীন শরীর, নারীদের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ। পরিবারের সদস্যেদের হারিয়ে বুকফাটা আর্তনাদে কেবলই ভারী হয়ে উঠছে ফিলিস্তিনের আকাশ-বাতাস। ইসরায়েলের বর্বর এই হামলায়, কেঁপে ওঠছে বিবেকবান মানুষের প্রাণ। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানান, গাজা শহরের উত্তরের বেত লাহিয়া এলাকায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে- এমন একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানেও বোমা ফেলে ইসরায়েল। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান অন্তত ৪ ফিলিস্তিনি।
হাসপাতালও আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। সম্প্রতি জাবালিয়ায় এক হাসপাতালে বোমায় প্রাণ হারান এক নার্স ও ৩ রোগী। হামলা থেকে বাদ পড়েনি মসজিদ। এই হামলার কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে- অপহরণের পর ৩ ইসরায়েলি কিশোরের মৃত্যুর ঘটনাকে অযুহাত হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে তেলআবিব। মাস দুয়েক আগে ৩ ইসরায়েলি কিশোর নিখোঁজ হয়ে পড়ে। ওই সময়ের দু'সপ্তাহ পর অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায় ফিলিস্তিনি সীমান্ত এলাকা থেকে। ব্যাস হয়ে গেলো, ইসরায়েল সরকার তড়িঘড়ি অভিযোগ করে বসলো, এ ঘটনার জন্য ফিলিস্তিনিরাই দায়ী। অতএব ফিলিস্তিনিদের শাস্তি দাও। আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।
প্রথম দিকে কেবল বিমান হামলার মধ্যেই সীমাবন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও মন ভরলো না। নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারী ও শিশুদের ধরে ধরে হত্যা না করলে তাদের আকাঙ্ক্ষা মিটবে কেনো? গাজার আশাপাশের এলাকায় আগে থেকেই প্রায় ৪০ হাজার সেনা মোতায়েন রাখা হয়েছিল। নিরীহ মানুষদের রক্ত চুষে নিতে তাদের যেনো আর তর সইছিল না। সরকারের নির্দেশ পেয়ে রোববার তারাও মাঠে নেমে পড়ে। ১৩ জুলাই পর্যন্ত গাজায় প্রায় ১২শ'টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর কথা স্বীকার করেছে ইসরায়েল। হামাসও পাল্টা রকেট ছুড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। তবে শক্তিশালী মারণাস্ত্রের কাছে সেসব নস্যি। এখন পর্যন্ত কোনো ইসরায়েলির প্রাণ নিতে পারেন দুর্বল ওই অস্ত্র। তবুও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু'র প্রশাসন গলা ফাটিয়ে বলছে, 'এই দেখো দেখো, ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীরা আমাদের দিকে রকেট ছুড়ছে'। এটি আর এক পক্ষ থেকে আক্রমণ নয়।
মিডিয়ার অনুকম্পা পেতে ইসরায়েল যতোই থোড়া যুক্তি তুলে ধরুক না কেন। তাতে খুব একটা লাভ হবে না। কারণ গণমাধ্যের কল্যাণে বিশ্ববাসী প্রতিনিয়তই দেখতে পাচ্ছে, সত্যিই সেখানে কি ঘটছে..। গাজার অধিবাসীদের প্রতিটি রাত কাটছে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। দিন কাটছে বারুদের গন্ধে। প্রতিনিয়ত এমন আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে, এই বুঝি মাথার ওপড় হামলে পড়লো, ইসরায়েলি জঙ্গিবিমান থেকে ছুড়ে ফেলা কোনো বোমা। এই বুঝি প্রাণ যায় তাদের। এই বুঝি পরিবারের একমাত্র শিশুটিও পঙ্গু হয়ে যায়। দু'দিন আগেও যেখানে ছিল চারতলা-পাঁচতলা ভবন। ইসরায়েলি জঙ্গি বিমান চক্কর দেয়ার পর, সেখানে আজ কেবলই ধ্বংসস্তুপ। মানুষের আহাজারি; আত্মচিৎকার। ইসরায়েলের ওই নির্মম হামলায় হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে আহত মানুষের স্রোত। নেই ওষুধপত্র বা চিকিৎসা সরঞ্জাম। তাই হিমসিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালকর্মীদের।
এসব দেখে মনে হচ্ছে, নর-মাংসলোভে ব্যর্থ কোনো মাংশাসী পেত্নীর দল প্রতিহিংসার ক্ষোভে উন্মাদিনী রঙে যেনো নেচে চলেছে। তাদের আটকাবার কেউ নেউ ধরাধামে। গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করতে করতে যাদের চোখের পানি শুকিয়ে যায়, মানবতার চরম অবমানার এই সময়টিতেও নিশ্চুপ রয়েছে সেই সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। দুই একটি বিবৃতি দিয়েই যেনো দায়িত্ব শেষ। তবে মানবতার পক্ষে কথা বলার মানুষেরে অভাব নেই। ফিলিস্তিনিদের ওপর বিমান হামলা শুরুর পর থেকে সময় যতো গড়াচ্ছে, ততোই বাড়ছে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড়। আমেরিকা-ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে প্রতিদিনই হচ্ছে বিক্ষোভ-সমাবেশ। সভা-সেমিনার। বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী মানুষ বলতে চাইছে..'বন্ধ করো এই হত্যাকাণ্ড'। 'এভাবে মানুষ মারা চলবে না... চলবে না'।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়েছে জোরশোরেই। উল্টো ইসরায়েলি সরকার বলছে, তাদের জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে হামলা বন্ধের কথা ভাবতে চাইছে না তারা। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের পতন ঘটেছে। ক্ষমতায় এসেছেন ফিল্ড মার্শাল আব্দেল ফাতাহ আল-সিসি। মুখে কিছু না বললেও, হয়তো ইসরায়েল তাদের কাছে থেকে কিছুটা প্রশ্রয় পেয়েও থাকতে পারে- এমন ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ইসরায়েলকে যেভাবে পেছন থেকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, তা আজ সবার কাছেই পরিষ্কার। তবে যেভাবে বা যে শক্তির ভরসার ওপর ভর করেই... ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলায় উৎসাহিত হোক না কেন, মানবতার ওপর নিষ্ঠুর আঘাত প্রকৃতি যে কখনোই মেনে নেয় না, সে কথাও তাদের মনে রাখতে হবে।
সুদীপ ঘোষ
সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
http://www.poriborton.com/post/59129/
__._,_.___