উন্নয়ন চাই, বিদ্যুৎ চাই; তবে সুন্দরবন ধ্বংস করে নয়
সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে না জানিয়ে
জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি জাতিসংঘের কাছে পাঠানো এক চিঠির
সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রর পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনও
পাঠিয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতির বিষয়ে
জাতিসংঘের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ ওই চিঠি দেয়। বিদ্যুৎ বিভাগ
সূত্র জানায়, দেশের পরিবেশবাদীরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রর বিরোধিতা করে
আসছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে সুন্দরবন
ধ্বংস হয়ে যাবে। এর পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারলেও
নানাভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ বন্ধ করার জন্য সরকারের উপর চাপ
প্রয়োগ করছে। শুধু দেশেই নয়; পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন জাতিসংঘ ছাড়াও
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রর বিরোধিতা
করে চিঠি পাঠিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সুন্দরবনের উপর বিদ্যুৎ
কেন্দ্রর কি প্রভাব পড়বে তা জানতে চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছে সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বনটি
ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যর অংশ। বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে বিশ্বঐতিহ্যর কী
ক্ষতি হতে পারে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের এমন উদ্বেগে জাতিসংঘ বিষয়টি জানতে চেয়ে
সরকারের কাছে চিঠি লেখে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানায়, জাতিসংঘের চিঠিতে তিনটি বিষয়কে
প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রথমটি হচ্ছে- বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরিবেশগত সমীক্ষা
প্রতিবেদন তৈরি (ইআইএ) করা হয়েছে কিনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সুন্দরবনের
মধ্যে কয়লা পরিবহনের জন্য ড্রেজিং করা হলে এর কী প্রভাব পড়বে এবং তৃতীয়টি
হচ্ছে- বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সুন্দরবনের উপর কী প্রভাব
পড়তে পারে। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা করা
হয়েছে। চিঠির সঙ্গে পুরো প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সেখানেই প্রকল্পর সকল দিক সম্পর্কে বলা রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশ
এবং প্রতিবেশের উপর কী কী প্রভাব ফেলতে পারে তা সমীক্ষাতেই রয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষতি কীভাবে কমানো যায়, কোন্ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে- সে
সম্পর্কে বিস্তারিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে রয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে নদী খনন
করলে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়েও বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি পৃথক সমীক্ষা করেছে।
জাতিসংঘের কাছে পাঠানো চিঠির সঙ্গে ওই সমীক্ষাটিও দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ
মেয়াদে অর্থাৎ ৫০ বা ১০০ বছর পর এতে সুন্দরবনের উপর কি প্রভাব পড়বে তা
পরিমাপের ব্যবস্থা বাংলাদেশের নেই। তবে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রর মেয়াদ
সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর হয়ে থাকে। এই সময়ে সুন্দরবনের উপর কি প্রভাব
পড়বে; না পড়বে তা পরিবেশগত সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে।
জানানো হয়েছে- ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি)-এর
মতো কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে। এই এলাকায় বৃহৎ কয়লা চালিত
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুন্দরবন
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও রয়েছে। আর ভারতীয় কোম্পানি সুন্দরবনের ক্ষতি
হয় এমন উদ্যোগের সঙ্গে নিশ্চয়ই থাকবে না।
বিদ্যুৎ সচিব এ প্রসঙ্গে জানায়, যেকোনো কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে
নির্মাণই পরিবেশের উপর কিছু না কিছু প্রভাব পড়ে। কিন্তু পরিবেশের উপর
বিরূপ প্রভাব সীমিত রাখার জন্য এখন উন্নত প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে।
সরকার এখানে উন্নত প্রযুক্তি এবং ভালো মানের কয়লা ব্যবহারের বিষয়ে
সর্বোচ্চ সচেতন অবস্থায় রয়েছে। রামপালে অধিকাংশই সরকারি খাস জমি। খুব কম
সংখ্যক মানুষকে পুনর্বাসন করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ খুব
ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় জমির বিষয়টি সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। কয়লা পরিবহনের জন্য
পানির নির্দিষ্ট গভীরতা থাকতে হয়। তা না হলে বড় জাহাজ কয়লা নিয়ে আসতে
পারে না। যেখানে তেমন গভিরতা রয়েছে সেখানেই কেবল এ ধরনের কেন্দ্র নির্মাণ
করা সম্ভব। অনেক বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই রামপালকে বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য
উপযুক্ত মনে করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে খুলনা বিভাগের তিনটি
সম্ভাব্য স্থান থেকে রামপালকে সর্বোত্তম উপযোগী স্থান হিসেবে বিবেচনা
করা হয়। যা সুন্দরবনের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকে ৭২ কিলোমিটার এবং
সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সামাজিক এবং কারিগরি
অর্থনৈতিক উপযোগিতা যাচাইয়ের পর পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের জন্য একটি
পূর্ণাঙ্গ ইআইএ করা হয়।
অথচ পরিবেশবিদরা মনে করে যে, কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ার
কারণে রামপালের মাধ্যমে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতিসাধিত হবে। তাছাড়া বন, কৃষি
ও আবাসিক এলাকার ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মাঝে এ ধরনের কোনো প্রকল্প
বাস্তবায়নও নিয়মসিদ্ধ নয়। কিন্তু সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের
দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার।
সূত্র জানায়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন সময় এবং নির্মাণের পরও
তা পরিবেশগতভাবে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কিন্তু এ বিরূপ প্রভাব
সত্ত্বেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ইতোমধ্যে ১৮৩৪ একর জমিও
অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে কেন্দ্রটি নির্মাণে অন্যান্য কাজও এগিয়ে
চলছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশ, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ওয়াটারকিপার
অ্যালায়েন্সের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্যোক্তারা বলেছে,
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে রামপালে
বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলে বিপন্ন হবে বাঘসহ বিভিন্ন প্রাণী। এটা শুধু
বাংলাদেশের সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না; ভারতে অবস্থিত অবশিষ্ট সুন্দরবনেরও
ক্ষতি করবে। এ কারণে কিছুতেই সুন্দরবনের আশপাশে কোনো ধরনের
বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে দেয়া যাবে না। এমন কিছু করা যাবে না যাতে সুন্দরবনের
ক্ষতি হয়। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে 'আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও
ব্যাংকগুলোকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ না করার' আহ্বান জানানো হয়েছে।
'বাংলাদেশের কয়লা জ্বালানি : পানি ও আবহাওয়ার উপর প্রভাব' শীর্ষক দুই
দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষে গত রোববার ওই সংবাদ সম্মেলনের
মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষায় আট দফা ঘোষণা ও পাঁচটি সুপারিশ প্রকাশ করা হয়।
ওয়াটারকিপার বাংলাদেশের সুপারিশগুলো হলোÑ বিশ্ব ঐতিহ্য এবং বিশ্বের
সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ
প্রকল্প স্থাপনের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সার্বজনীন এবং সমন্বিত
জ্বালানি এবং কয়লা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে
জ্বালানি সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নগরায়ন, ভবন নির্মাণ, পরিবহন
সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহ দিতে এবং অনৈতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং
বিদ্যুৎ অপচয় রোধমূলক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র
স্থাপনের আগে গণশুনানি করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে স্থান নির্বাচন,
অর্থায়ন, বাণিজ্যিক চুক্তি, ভূমি অধিগ্রহণ এবং সম্পদ সঠিকভাবে মূল্যায়নের
ভিত্তিতে করতে হবে। সুপারিশে বলা হয়, আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে খাপ
খাওয়ানো এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কর্মকা- এবং ইউনিসেফের ভূমিকা
গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা বাংলাদেশ সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই স্বীকার করা হয়েছে, এভাবে সুন্দরবনের ভেতর
দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে-
১) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, ভাঙা/টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা
আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে
নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে;
২) সুন্দরবনের ভেতরে আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা উঠানো
নামানোর সময় কয়লার গুঁড়া, ভাঙা কয়লা পানিতে/মাটিতে পড়ে- বাতাসে মিশে
মাটিতে মিশে ব্যাপক পানি-বায়ু দূষণ ঘটাবে;
৩) চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুইপাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে;
৪) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত
ব্যাপক শব্দ দূষণ হবে;
৫) রাতে জাহাজ চলার সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ
সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবন চক্রের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর
প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি।
স্মর্তব্য যে, সুন্দরবন এক দিনে তৈরি হয়নি। এক লাখ বছরের এই বন উন্নয়নের
নামে ধ্বংস করে দেয়া যায় না। অথচ সরকার মনে করছে এটি সামাজিক বনায়ন।
দু'তিন বছরের মধ্যেই বনায়ন করার মাধ্যমে সুন্দরবন তৈরি করা যায়। রামপাল
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবন আরো ঝুঁকিতে পড়বে।
লেখাবাহুল্য, আমরা উন্নয়ন চাই, বিদ্যুৎ চাই; তবে সুন্দরবন ধ্বংস করে নয়।
তাই অবিলম্বে এ বিষয়ে সরকারকে নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে
সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে অবিলম্বে
সরে আসতে হবে।
সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে না জানিয়ে
জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি জাতিসংঘের কাছে পাঠানো এক চিঠির
সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রর পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনও
পাঠিয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতির বিষয়ে
জাতিসংঘের উদ্বেগের প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ ওই চিঠি দেয়। বিদ্যুৎ বিভাগ
সূত্র জানায়, দেশের পরিবেশবাদীরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রর বিরোধিতা করে
আসছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে সুন্দরবন
ধ্বংস হয়ে যাবে। এর পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারলেও
নানাভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ বন্ধ করার জন্য সরকারের উপর চাপ
প্রয়োগ করছে। শুধু দেশেই নয়; পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন জাতিসংঘ ছাড়াও
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রর বিরোধিতা
করে চিঠি পাঠিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সুন্দরবনের উপর বিদ্যুৎ
কেন্দ্রর কি প্রভাব পড়বে তা জানতে চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছে সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বনটি
ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যর অংশ। বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে বিশ্বঐতিহ্যর কী
ক্ষতি হতে পারে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের এমন উদ্বেগে জাতিসংঘ বিষয়টি জানতে চেয়ে
সরকারের কাছে চিঠি লেখে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানায়, জাতিসংঘের চিঠিতে তিনটি বিষয়কে
প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রথমটি হচ্ছে- বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরিবেশগত সমীক্ষা
প্রতিবেদন তৈরি (ইআইএ) করা হয়েছে কিনা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সুন্দরবনের
মধ্যে কয়লা পরিবহনের জন্য ড্রেজিং করা হলে এর কী প্রভাব পড়বে এবং তৃতীয়টি
হচ্ছে- বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সুন্দরবনের উপর কী প্রভাব
পড়তে পারে। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা করা
হয়েছে। চিঠির সঙ্গে পুরো প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সেখানেই প্রকল্পর সকল দিক সম্পর্কে বলা রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশ
এবং প্রতিবেশের উপর কী কী প্রভাব ফেলতে পারে তা সমীক্ষাতেই রয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষতি কীভাবে কমানো যায়, কোন্ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে- সে
সম্পর্কে বিস্তারিত সমীক্ষা প্রতিবেদনে রয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে নদী খনন
করলে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়েও বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি পৃথক সমীক্ষা করেছে।
জাতিসংঘের কাছে পাঠানো চিঠির সঙ্গে ওই সমীক্ষাটিও দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ
মেয়াদে অর্থাৎ ৫০ বা ১০০ বছর পর এতে সুন্দরবনের উপর কি প্রভাব পড়বে তা
পরিমাপের ব্যবস্থা বাংলাদেশের নেই। তবে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রর মেয়াদ
সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর হয়ে থাকে। এই সময়ে সুন্দরবনের উপর কি প্রভাব
পড়বে; না পড়বে তা পরিবেশগত সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে।
জানানো হয়েছে- ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি)-এর
মতো কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে। এই এলাকায় বৃহৎ কয়লা চালিত
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুন্দরবন
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও রয়েছে। আর ভারতীয় কোম্পানি সুন্দরবনের ক্ষতি
হয় এমন উদ্যোগের সঙ্গে নিশ্চয়ই থাকবে না।
বিদ্যুৎ সচিব এ প্রসঙ্গে জানায়, যেকোনো কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে
নির্মাণই পরিবেশের উপর কিছু না কিছু প্রভাব পড়ে। কিন্তু পরিবেশের উপর
বিরূপ প্রভাব সীমিত রাখার জন্য এখন উন্নত প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে।
সরকার এখানে উন্নত প্রযুক্তি এবং ভালো মানের কয়লা ব্যবহারের বিষয়ে
সর্বোচ্চ সচেতন অবস্থায় রয়েছে। রামপালে অধিকাংশই সরকারি খাস জমি। খুব কম
সংখ্যক মানুষকে পুনর্বাসন করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ খুব
ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় জমির বিষয়টি সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। কয়লা পরিবহনের জন্য
পানির নির্দিষ্ট গভীরতা থাকতে হয়। তা না হলে বড় জাহাজ কয়লা নিয়ে আসতে
পারে না। যেখানে তেমন গভিরতা রয়েছে সেখানেই কেবল এ ধরনের কেন্দ্র নির্মাণ
করা সম্ভব। অনেক বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই রামপালকে বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য
উপযুক্ত মনে করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে সম্ভাব্যতা জরিপের মাধ্যমে খুলনা বিভাগের তিনটি
সম্ভাব্য স্থান থেকে রামপালকে সর্বোত্তম উপযোগী স্থান হিসেবে বিবেচনা
করা হয়। যা সুন্দরবনের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ থেকে ৭২ কিলোমিটার এবং
সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সামাজিক এবং কারিগরি
অর্থনৈতিক উপযোগিতা যাচাইয়ের পর পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের জন্য একটি
পূর্ণাঙ্গ ইআইএ করা হয়।
অথচ পরিবেশবিদরা মনে করে যে, কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ার
কারণে রামপালের মাধ্যমে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতিসাধিত হবে। তাছাড়া বন, কৃষি
ও আবাসিক এলাকার ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মাঝে এ ধরনের কোনো প্রকল্প
বাস্তবায়নও নিয়মসিদ্ধ নয়। কিন্তু সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের
দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার।
সূত্র জানায়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন সময় এবং নির্মাণের পরও
তা পরিবেশগতভাবে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কিন্তু এ বিরূপ প্রভাব
সত্ত্বেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ইতোমধ্যে ১৮৩৪ একর জমিও
অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে কেন্দ্রটি নির্মাণে অন্যান্য কাজও এগিয়ে
চলছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশ, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ওয়াটারকিপার
অ্যালায়েন্সের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্যোক্তারা বলেছে,
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে রামপালে
বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলে বিপন্ন হবে বাঘসহ বিভিন্ন প্রাণী। এটা শুধু
বাংলাদেশের সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না; ভারতে অবস্থিত অবশিষ্ট সুন্দরবনেরও
ক্ষতি করবে। এ কারণে কিছুতেই সুন্দরবনের আশপাশে কোনো ধরনের
বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে দেয়া যাবে না। এমন কিছু করা যাবে না যাতে সুন্দরবনের
ক্ষতি হয়। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে 'আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও
ব্যাংকগুলোকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ না করার' আহ্বান জানানো হয়েছে।
'বাংলাদেশের কয়লা জ্বালানি : পানি ও আবহাওয়ার উপর প্রভাব' শীর্ষক দুই
দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষে গত রোববার ওই সংবাদ সম্মেলনের
মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষায় আট দফা ঘোষণা ও পাঁচটি সুপারিশ প্রকাশ করা হয়।
ওয়াটারকিপার বাংলাদেশের সুপারিশগুলো হলোÑ বিশ্ব ঐতিহ্য এবং বিশ্বের
সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ
প্রকল্প স্থাপনের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সার্বজনীন এবং সমন্বিত
জ্বালানি এবং কয়লা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে
জ্বালানি সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নগরায়ন, ভবন নির্মাণ, পরিবহন
সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারে উৎসাহ দিতে এবং অনৈতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং
বিদ্যুৎ অপচয় রোধমূলক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র
স্থাপনের আগে গণশুনানি করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে স্থান নির্বাচন,
অর্থায়ন, বাণিজ্যিক চুক্তি, ভূমি অধিগ্রহণ এবং সম্পদ সঠিকভাবে মূল্যায়নের
ভিত্তিতে করতে হবে। সুপারিশে বলা হয়, আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে খাপ
খাওয়ানো এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কর্মকা- এবং ইউনিসেফের ভূমিকা
গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা বাংলাদেশ সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই স্বীকার করা হয়েছে, এভাবে সুন্দরবনের ভেতর
দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে-
১) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, ভাঙা/টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা
আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে
নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে;
২) সুন্দরবনের ভেতরে আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা উঠানো
নামানোর সময় কয়লার গুঁড়া, ভাঙা কয়লা পানিতে/মাটিতে পড়ে- বাতাসে মিশে
মাটিতে মিশে ব্যাপক পানি-বায়ু দূষণ ঘটাবে;
৩) চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুইপাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে;
৪) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত
ব্যাপক শব্দ দূষণ হবে;
৫) রাতে জাহাজ চলার সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ
সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবন চক্রের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর
প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি।
স্মর্তব্য যে, সুন্দরবন এক দিনে তৈরি হয়নি। এক লাখ বছরের এই বন উন্নয়নের
নামে ধ্বংস করে দেয়া যায় না। অথচ সরকার মনে করছে এটি সামাজিক বনায়ন।
দু'তিন বছরের মধ্যেই বনায়ন করার মাধ্যমে সুন্দরবন তৈরি করা যায়। রামপাল
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবন আরো ঝুঁকিতে পড়বে।
লেখাবাহুল্য, আমরা উন্নয়ন চাই, বিদ্যুৎ চাই; তবে সুন্দরবন ধ্বংস করে নয়।
তাই অবিলম্বে এ বিষয়ে সরকারকে নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে
সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে অবিলম্বে
সরে আসতে হবে।
__._,_.___