এদিকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা রোববারের কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে পুলিশের কয়েকটি ব্যারিকেড পেরিয়ে কীভাবে মিন্টো রোডে মন্ত্রিপাড়ায় পৌঁছল তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডিএমপি।
ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমানকে প্রধান করে সোমবার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- উপপুলিশ কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আসমা সিদ্দিকা মিলি। তদন্ত কমিটিকে আগামী ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিপেটার প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য মঙ্গলবার সারাদেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছে।
প্রকাশিত: বিকাল ০৫:১৩ মে ১১, ২০১৫
সম্পাদিত: বিকাল ০৫:১৩ মে ১১, ২০১৫
বাংলাদেশের জন্মের আগে-পরে সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনের কাতারেই ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। ভালো, মেধাবী, ভদ্র, নম্র ছেলেমেয়েরাই ছাত্র ইউনিয়ন করে, বরাবর এই সংগঠনটির ভাবমূর্তি এমনই। ছাত্র ইউনিয়ন করা মানেই ভালোত্বের সার্টিফিকেট। শুধু ভালো নয়, একটু বেশিই ভালো। আমাদের বন্ধু-বান্ধব যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতো, ঠাট্টা করে তাদের আমরা হারমোনিয়াম পার্টির নেতা বলতাম। সেই হারমোনিয়াম পার্টির কর্মীদের পুলিশ কাল গরুপেটা করেছে। তাদের অপরাধ, তারা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের তদন্তে ধীরগতির প্রতিবাদে ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও করতে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলটি দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট, মৎস্য ভবন, কাকরাইল ঘুরে সার্কিট হাউস রোডের মুখে পুলিশের মারের কবলে পড়ে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখা গেছে, পুলিশ ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীদের রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছে। বিশেষ করে নারী কর্মীদের সঙ্গে তাদের আচরণ ছিল নির্মম, নির্দয় ও অসভ্যতায় ঠাসা। ডিএমপি ঘেরাও করতে গেলেই এমনভাবে মারতে হবে কেন? অনেক ভেবেও এর উত্তর পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে হলো ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী প্রতিবাদ করেছিল বলেই বর্ষবরণের ঘটনা ফাঁস হয়েছে। আর ফাঁস হয়েছে বলেই পুলিশকে এখন এত হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে। এখন শুনছি, এ ধরনের ঘটনা নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বড় উৎসবে নিয়মিতই ঘটে। কিন্তু কখনোই ধরা পড়ে না বা গণমাধ্যমে আসে না বলে আড়ালে থেকে যায় সবকিছু। পুলিশও শান্তিপূর্ণভাবে উৎসব উদযাপনের কৃতিত্ব নিয়ে বগল বাজায়।
বর্ষবরণের নির্যাতনকারীদের আমরা হয়তো চিনতে পারি না। কিন্তু এই নির্যাতনকারীদের তো আমরা চিনি। চিহ্নিত এইসব পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এবার সব ভণ্ডুল করে দিলেন লিটন নন্দী। লিটন যদি অন্যদের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন, তাহলেই শান্তিপূর্ণ বর্ষবরণ আয়োজনের জন্য বাহবা পেতো পুলিশ। এমন বাড়া ভাতে ছাই দিলে, আবার সেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ একটু খেপতেই পারে। মাঝে-মাঝে পুলিশকে আমার খুব ভীতু আর কাপুরুষ মনে হয়। যখন পুলিশের সামনেই অভিজিৎ খুন হয়, বর্ষবরণে পুলিশের সামনেই যখন নারীদের সম্ভ্রমহানী হয়, তখন এমন মনে হতেই পারে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সদস্য ইসমত জাহানের ওপর পুলিশের অন্তত পাঁচ সদস্যের হামলার ছবি দেখলে ভুল ভেঙে যায়। বীর না হলে এভাবে সবাই ঘিরে একটা মেয়েকে মারতে পারে? নারী নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে যে আমার বোনটি নির্যাতিত হলো, তার বিচার কে করবে? বিশ্ব মা দিবসে একজন নারীর প্রতি নির্মমতার তীব্র নিন্দা জানাই। বর্ষবরণের নির্যাতনকারীদের আমরা হয়তো চিনতে পারি না। কিন্তু এই নির্যাতনকারীদের তো আমরা চিনি। চিহ্নিত এইসব পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এ নিয়ে ফেসবুকে ছবিসহ স্ট্যাটাস দেওয়ার পর অনেকে মেয়েটির পুলিশের গাড়িতে ফুলের টব ছুঁড়ে মারার ছবি দিয়ে পুলিশের নির্যাতন যৌক্তিক প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। শুনে আমি খুব অবাক হয়েছি। একটি মেয়ে রাস্তার পাশের একটি ফুলের টব ছুঁড়ে মারলে প্রায় ট্যাংকের মতো দেখতে পুলিশের এপিসিতে আঁচড়ও লাগবে না। এই অপরাধে এভাবে একটি মেয়েকে নির্যাতন করতে হবে? পুলিশ প্রথমে মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ইসমত জাহান উঠে দৌড়ে পালাতে গেলে কয়েকজন পুলিশ তাকে ধাওয়া করে। সে একটি গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলে পুলিশ তাকে চুল ধরে টেনে এনে ইচ্ছামত পেটায়, লাথি দেয়, মাটিতে ফেলে পেটায়। আজ যারা একটি ফুলের টব মারার অপরাধে একটি মেয়েকে রাস্তায় ফেলে পেটানোকে সমর্থন করছেন, তারা কি কোনোদিন ছাত্র অবস্থায় পুলিশের গাড়িতে ঢিল ছোড়েননি? ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আজ যারা মন্ত্রী-এমপি, তারা কি কোনোদিন পুলিশের গাড়িতে ঢিল মারেননি? বরং আমি তো ইসমত জাহানকে স্যালুট জানাই, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে তিনি রাস্তায় নেমে এসেছেন। পুলিশী বাধার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছে, হাতে তুলে নিয়েছেন ফুলের টব। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমি নিজেও অনেকবার পুলিশের গাড়িতে ঢিল ছুড়েছি। এখন মানছি পুলিশের গাড়িতে ঢিল ছোড়াটা বেআইনি। কিন্তু তার জন্য পুলিশ এভাবে একটি মেয়ের ওপর হামলে পড়বে? সেখানে মহিলা পুলিশও ছিল। মহিলা পুলিশ ইসমতকে গ্রেফতার করতে পারতো।
মাঝে-মাঝে পুলিশকে আমার খুব ভীতু আর কাপুরুষ মনে হয়। যখন পুলিশের সামনেই অভিজিৎ খুন হয়, বর্ষবরণে পুলিশের সামনেই যখন নারীদের সম্ভ্রমহানী হয়, তখন এমন মনে হতেই পারে।
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার আবদুল বাতেন দেখলাম, গলা ফুলিয়ে বলছেন, 'দাবি পেশ করার জন্য লাখ-লাখ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে রাস্তা আটকে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে পারেন না। হাজার-হাজার গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ করে রাখতে পারেন না। আপনারা দেখেছেন, তারা প্রায় আধঘণ্টা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিলেন। ওনাদের বারবার রিকোয়েস্ট করেছি। তখন তো রাস্তা পরিষ্কার করা আমাদের দায়িত্ব।' বাহবা, হঠাৎ আমাদের পুলিশ এতো দায়িত্বশীল হয়ে গেল কেন। অভিজিৎ হত্যার সময় তারা নির্বাক থাকে, বর্ষবরণে নারী নির্যাতনের সময় তারা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আর ছাত্র ইউনিয়ন মিছিল করতে নামলে পাশবিক নির্মমতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দেয়! কী আশ্চর্য! এই দেশে কি অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নামা অন্যায় নাকি। এই দেশে তো যুগে-যুগে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তো রাস্তার আন্দোলন থেকেই উঠে আসা। কয়েকদিন আগেও তো সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী শাজাহান খান ট্রাক মিছিল নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছেন। সেদিন তো ঢাকা পুরো অচল হয়ে গিয়েছিল। সেদিন তো পুলিশকে জনগণের চলাচল নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। আর আজ শহরের এক কোনায় ন্যায্য দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের একটি মিছিল দেখে পুলিশ হঠাৎ এমন জনদরদী হয়ে উঠলো কেন?
আমি বিশ্বাস করতে চাই না, সরকারের কেউ নির্দেশ দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নকে পিটিয়েছে। কিন্তু যখন দেখি, সরকারি দলের লোকজন, এই হামলার পক্ষে নানা যুক্তি দিচ্ছে, তখন বিভ্রান্ত হয়ে যাই। কেন পুলিশের এই অন্যায় আচরণকেও বৈধতা দিতে হবে?
আমি বিশ্বাস করতে চাই না, সরকারের কেউ নির্দেশ দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নকে পিটিয়েছে। কিন্তু যখন দেখি, সরকারি দলের লোকজন, এই হামলার পক্ষে নানা যুক্তি দিচ্ছে, তখন বিভ্রান্ত হয়ে যাই। কেন পুলিশের এই অন্যায় আচরণকেও বৈধতা দিতে হবে? ছাত্র ইউনিয়ন তো সরকার পতনের আন্দোলন করছিল না। তারা নারী নিগ্রহের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। এইটুকু স্লোগানও এখন সইতে পারছেন না রাজপথ থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আমার ধারণা, পুলিশের অতি উৎসাহী সদস্যরাই এটা করেছে, যাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এই ক্ষুণ্ণ হওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে দায়ী পুলিশদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের হয়ে সাফাই গাইলে হবে না। আসলে আপনি যখন পুলিশকে দিয়ে একটা অন্যায় কাজ করাবেন, ওই লাইসেন্সে সে আরও ১০টা আকাম করে ফেলবে। দেশটাকে পুলিশি রাষ্ট্র বা মগের মুল্লুক বানিয়ে ফেলবে। প্লিজ, দানব হওয়ার আগেই পুলিশকে নিবৃত করুন।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
ইমেইল: probhash2000@gmail.com
__._,_.___