'আমরা ভালো আছি, আমরা ভালো নেই'
পরপর দু'টো সাক্ষাত্কার দুই হিন্দু নেতার। একজন রানা দাশগুপ্ত, যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর এবং ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। অন্যজন ড: নিম চন্দ্র ভৌমিক। ঢাকা ভার্সিটির প্রফেসর এবং নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি আগে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এখন প্রেসিডিয়াম মেম্বার। সদ্য রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, 'আমরা ভালো নেই; শান্তিতে নেই'। পক্ষান্তরে নিম ভৌমিক বলেছেন, 'আমরা ভালো আছি; শান্তিতে আছি'। কার কথা ঠিক?
সোস্যাল মিডিয়া দেখলে বোঝা যায়, সবাই নিম ভৌমিকের বিপক্ষে। যারা এখন নিম ভৌমিকের গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন, তারা ক'দিন আগেও একইভাবে রানা দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে দয়াময়ী ভবন নিয়ে সাংবাদিক সন্মেলন ও তৎপরবর্তী ক'টি সাক্ষাত্কার ও প্রোগ্রাম রানা দাশগুপ্তকে লাইমলাইটে নিয়ে এসেছে। রানা দাশগুপ্তের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে হিন্দুদের মাঝে নি:সন্দেহে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। যদিও সরকারের একটি অংশ তার বিরুদ্ধে ক্ষ্যাপা। শোনা যায়, তার অবস্থাও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা নিম ভৌমিকের মত হয়ে যেতে পারে!
ঐক্য পরিষদে এখন রানা দাশগুপ্ত এবং নিম ভৌমিক কি মুখোমুখি? গুজব রয়েছে, নিম ভৌমিককে ফরিদপুরের একনেতা ডেকে পাঠিয়েছেন এবং তারপরই তার সাক্ষাত্কার এবং স্বজাতির বিরুদ্ধে কথা। এমনও শোনা যায়, তাকে আবার কিছু পদপদবী দেয়ারও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এমন সুযোগ কি বারবার আসে? একইভাবে সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন ফরিদপুরের অরুণ গুহ মজুমদার। তিনি সাফ জানিয়েছেন, সম্পত্তি তিনি বিক্রী করেছেন। এতে ক্রেতা লাভবান হলেও রানা দাশগুপ্ত বিপাকে পড়েছেন। সাধারণ মানুষের কিন্তু যা বোঝার তারা তা ঠিকই বুঝে নিয়েছে।
প্রবীর শিকদার মামলায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর একবার সবার প্রসংশা কুড়িয়েছেন। রানা দাশগুপ্ত বা প্রবীর শিকদার অথবা ফরিদপুরের আরো দুই দু'ডজন আওয়ামী ঘরানার নেতাকর্মী ষড়যন্ত্রের শিকার। এসব ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। ঘটনাক্রমে ভিকটিম হিন্দু, তাই কেউ কেউ এটাকে সাম্প্রদায়িক ঘটনাও বলতে চাইবেন। আর এসবই ঘটছে আওয়ামী লীগ আমলে। প্রবীর শিকদার ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে! এথেকে বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী না চাইলেও অনেক কিছু ঘটে। এটা হয়তো ঠিক প্রধানমন্ত্রী জানলে প্রবীর শিকদার কখনোই গ্রেফতার হতেন না।
এদিকে এসময়ে হটাত করে জাসদ-ইনু বা অন্যান্যদের নিয়ে এতকথা তো ওঠার প্রয়োজন ছিলোনা, তবু উঠেছে এবং তা বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে! বঙ্গবন্ধু কম দু:খে বলেননি যে, আমার চারপাশে চাটার দল! শেখ হাসিনাকেও মন্ত্রিসভার বৈঠকেই বলতে হয়েছে, আমি ক্ষমা করে দিয়েছি; কিন্তু ভুলিনি। এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আছে বলেই প্রবীর শিকদারের মত পঙ্গু সাংবাদিক, স্বাধীনতা যুদ্ধে যার পরিবার ১৪জনকে হারিয়েছেন, তাকেও অকারণে গ্রেফতার হতে হয়; মানস মুখার্জীর মত শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে পঁচতে হয়। অথবা আওয়ামী ওলামা লীগের 'পহেলা বৈশাখ বন্ধ' দাবি করার ঔদ্ধত্যের কথা আমাদের শুনতে হয়!
সম্প্রীতি সৈয়দ আশরাফ যেমনি 'খাই খাই' বন্ধ করার কথা বলেছেন, তেমনি ষড়যন্ত্রের কথা বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটারও ইঙ্গিত করেছেন। ছোট ছোট ষড়যন্ত্রগুলোও কিন্তু ফেলনা নয়! গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, দেশে কি পচাত্তরের আলামত দেখা দিয়েছে? বাইরের শত্রূ মোকাবেলা সহজ, কিন্তু ঘরের শত্রূ বিভীষণ ঠেকায় কে? কথায় বলে, আওয়ামী লীগকে কেউ হারায় না, আওয়ামী লীগ নিজেই হারে! একটানা সাত বছর ক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের নাই, আরো বেশিদিন টিকে থাকতে হলে মনে হয়, আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন আছে। স্মর্তব্য যে, পঁচাত্তরে কিন্তু আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিলো।
প্রবীর শিকদার গ্রেফতার নাটক, রানা দাশগুপ্তকে তলব, শাকিলা ফারজানাসহ তিন এটর্নীর জঙ্গী কানেকশন, সরকারে গৃহবিবাদ সৃষ্টি, সৈয়দ আশরাফের আশংকা, আগাচৌর সতর্কবাণী কিসের অশনি সংকেত? দেশে কি ইতিমধ্যে কিছু ঘটেছে যা আমরা জানিনা? ওপর দিয়ে সবকিছু নরমাল, ভেতরে ভেতরে কি অস্থিরতা বিরাজ করছে? ঘুসঘুসে জ্বর বড় অসুখের লক্ষ্মন! 'ঘরপোড়া গরু সিঁদুরের মেঘ দেখলে ভয় পায়' -আমাদের অবস্থা হয়তো তাই। এতসবের পরও আশার কথা, এটা পঁচাত্তর নয়, ২০১৫। কৌতুক অভিনেতা ভানুর ভাষায়, 'দুনিয়ার নিয়ম বিস্তর পাল্টাইছে'।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক, ৩১শে আগস্ট ২০১৫।
__._,_.___