জাসদ নিয়ে তোলপাড় : মাঘে চৈত্রের বক্তৃতা
চৈত্র মাসের বক্তৃতা গল্পটি সবাই জানেন তাই সেটি আর বলব না। গল্পটির সারাংশ আমরা সবাই জানি বলে আশা করি। তবে সারাংশটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেটি বোধহয় নিজেদের মনে করে দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। জাসদ নিয়ে হৈচৈ দেখে তাই মনে হচ্ছে। আসলে সত্য কথা বলার সময় সব সময় নয়। অসময়ে বললে সত্য কথাটি উল্টো অর্থ নিয়ে মানুষের মনে পৌঁছায়। অন্য সমস্যাও রয়েছে। সময় মতো না বললে সত্য কথা লোকে হয়তো শুনবেই না। এসব কারণে সত্য কথা অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সত্য কথা স্থান কাল পাত্র বিবেচনা করে বলা উচিত।
এসব কথা মনে রেখেই আমাদের সত্য কথা বলতে হবে। কে কোন কথা বলবেন সেটা বিবেচনা করা উচিত। জাসদ সম্পর্কে শেখ সেলিম সাহেব বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আসলে তিনি মন্তব্য করেছেন ১৯৭৫-এর পূর্ববর্তী সময়ে জাসদের ভূমিকা নিয়ে, জাসদের কার্যাবলি নিয়ে। জাসদ যা করেছিল সেটাকে সমালোচনা করা চলে। সমাজতন্ত্র আমরাও চাই। কিন্তু যে কথা বলে শুরু করেছিলাম সে কথায় ফিরে যাই। জাসদের সমাজতন্ত্র নিয়ে বলার সময় সঠিক ছিল না। সেই জন্য সবকিছু গোলমাল হয়ে গেছে। নিজেদের ক্ষতি হয়েছে। সমাজতন্ত্রের ক্ষতি হয়েছে। দেশের ক্ষতি হয়েছে। সমাজতন্ত্র বিরোধীদের, স্বাধীনতা বিরোধীদের লাভ হয়েছে। রক্তপাত হয়েছে। রক্তপাত চলেছে। অকারণে অসংখ্য প্রাণ ঝরে গেছে। আমরা এখনো ভুগছি এই ভুলের জন্য। সমাজতন্ত্র বিরোধীদের শক্তিশালী করে দিয়েছে জাসদ অসময়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলে।
এসব ঘটেছিল ১৯৭৫-এর আগে। চল্লিশ বছর আগে। এই ৪০ বছরে পদ্মা মেঘনার অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পরিস্থিতি বদলে গেছে। স্বাধীনতার শত্রুরা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। অবাঞ্ছনীয় হলেও এই সত্য মেনে নিতে হয়। ২০টি দল তাদের জোটে। স্বাধীনতার পক্ষের জোটে ১৪টি দল। বর্তমান পরিস্থিতিতে ১৪ দলের মহাজোটে ঐক্য প্রয়োজন। এখানে অনৈক্য স্বাধীনতার শত্রুদের সাহায্য করবে। যার একটু দায়িত্বজ্ঞান আছে সে-ই এ কথা বুঝবে। ১৪টি দল। এদের সবার চিন্তাধারা একেবারে এক হবে না। এদের অতীত একরকম হবে না। জোটের ঐক্য বজায় রাখতে গেলে এসব কথাসহ আরো অনেক কথা মনে রাখতে হবে। এসব কথা মনে রেখে দায়িত্ববান ব্যক্তিরা তাদের বক্তব্য পেশ করবেন সেটাই সবাই আশা করে।
যাদের আমরা একাডেমিক বলে থাকি তারা অতীত বিশ্লেষণ করবেন নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে। সে-ই কাম্য। এতে করে সাময়িকভাবে কার ক্ষতি হলো বা কার লাভ হলো সেটি দেখার বিষয় নয়। দীর্ঘস্থায়ী লাভ সেখানে বিবেচ্য। কিন্তু জোটের অংশীদারদের বক্তব্য অবিবেচনাপ্রসূত হলে তা জোটের সব রকমের ক্ষতি করবে শুধু। আসলে কোনো বিষয় নিয়ে কেউ কিছু বলার আগে চিন্তা করতে হবে যে বিষয়টি আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন এই মুহ‚র্তে ছিল কি? বিষয়টি নিয়ে আলোচনা জোটের বা দেশের উপকারে আসবে কি? অপরদিকে চিন্তা করতে হবে যে, বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য প্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকারক কিনা? আসলে দায়িত্বশীল অবস্থানে থাকলে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
জাসদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মুখপাত্র। জাসদের একজন নেতার মন্ত্রিসভায় থাকা উচিত কিনা তিনি এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। ২০ দলীয় নেতার পক্ষে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ১৪ দলের যে কোনো দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করা। কিন্তু একই প্রশ্ন যদি উত্থাপন করেন নিজ শরিক দলের দায়িত্বশীল নেতাদের কেউ তবে সেটা হবে জোটের জন্য ক্ষতিকারক। এই ক্ষতি শুধুমাত্র জোটের হবে না ক্ষতি হবে নিজের দলেরও। ক্ষতি হবে দলের আদর্শের। অবশ্যই ক্ষতি হবে দেশের ও জাতির।
একটা কিছু ঘটলে অনেক রকমের আলোচনা হয় আজকাল। দেশে এখন অসংখ্য সংবাদপত্র আর অনেক টেলিভিশন। আসলে দুই আওয়ামী লীগ নেতার জাসদ সম্বন্ধে মন্তব্যে লাভ হয়েছে কার? ক্ষতি হয়েছে কার? মন্তব্য করার আগে এই কথাটি মনে রাখতে হবে। অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করেছেন এই বিষয়ে। কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, তারা হয়তো মনে করেন যে জাসদ ক্ষতিকর কাজ করে মন্ত্রিত্ব পেয়েছে। আর আমরা আওয়ামী লীগের। আমাদের আপনজনরা প্রাণ হারিয়েছেন কিন্তু আমরা মন্ত্রিসভায় নেই। আমি শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত যে, এমন ভাবনা তারা করেননি। কিন্তু মানুষ অনেক কিছুই ভাবে।
কত কথা আলোচনা করে মানুষ। কত কথা রটে। জাসদ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের মন্তব্যের ফলে এমন কথাও কেউ কেউ বলেছে যে জাসদকে বাদ দেয়ার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ। কথাটির মধ্যে যদিও কোনো সত্য নেই কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতাদের কেউ কেউ জাসদ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন তাই এমন কথা ভেবেছেন অনেকে।
দেশের সামনে সমস্যা অনেক। সব সমস্যা সমাধান করা যায় না। যদিও আমাদের অর্থনৈতিক ইতিহাস গৌরবের যে জন্য আমাদের দেশকে বলা হয় সোনার বাংলা, তবু এটা সত্য যে আমাদের কাছে ইতিহাস প্রাচুর্যের নয়। এই অবস্থায় জনগণের আর্থিক সঙ্গতির গ্যারান্টি দেয়া সব সময় সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের সব পেশার মানুষের অভিজ্ঞতা অল্পদিনের। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমনি এক সমস্যা। আমাদের অনেক সমস্যা। আমাদের সরকারের অনেক সমস্যা। তবু স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি জাতির কল্যাণের জন্য চেষ্টা করে চলেছে। তাই এমন কিছু করা বা বলা যেন না হয় যা স্বাধীনতার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
ওয়াহিদ নবী : চিকিৎসক, লেখক। রয়াল কলেজ অফ সাইক্যাট্রিস্টের একজন ফেলো।
http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2015/09/02/49783.php
__._,_.___