অবৈধ বিদেশীরা ষড়যন্ত্র ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে
উদ্বেগজনকহারে হারে বাংলাদেশে বাড়ছে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশীর সংখ্যা। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে জানা গেছে, দেশে অবৈধ নাগরিকের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এর মধ্যে ভারতীয় অবৈধ অভিবাসী প্রায় দেড় লাখ। তারপরে ক্যামেরুন, ঘানা, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, সেনেগাল, সিয়েরালিওন, ইথিওপিয়া, আলজেরিয়া, লাইবেরিয়াসহ অফ্রিকা মহাদেশের ১৭ হাজার বৈধ ও অবৈধ নাগরিক দেশে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে মধ্যে প্রায় ৯ হাজার নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ছয় বছর ধরে এসব বিদেশী বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যায়নি। এসব অবৈধ বিদেশী নাগরিককে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনায় গ্রেপ্তারও করা হয়। তবে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ নেই। ঢাকায় ওই সব দেশের দূতাবাস না থাকায় গ্রেপ্তারকৃতদের নিজ দেশে পুশব্যাকও করা যায় না।
অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশী নাগরিকরা সরকারকে কোনো রকম ভ্যাট বা কর দেয় না। অথচ সাধারণ নাগরিকের চেয়েও তারা অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছে। সম্প্রতি নিহত বিদেশীদের নিয়ে এবং জীবিত বিদেশীদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের কি তোড়জোর তা সবাইকে আলোড়িত করেছে। অথচ বিদেশী অবৈধভাবে উপার্জন করে তা নিজ দেশে পাঠাচ্ছে। এসব তথ্য উল্লেখ করে এনবিআর বেশ কয়েকবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। অন্যদিকে শত শত বিদেশী নাগরিক নানা অপরাধমূলক কাজে অংশ নিচ্ছে- এমন তথ্য পেয়েও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
জানা গেছে, বিদেশীদের মধ্যে বেশির ভাগ পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে এসে কখনো নিজের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে, আবার কখনো ভিসার মেয়াদ থাকা অবস্থাতেই নানা 'অপতৎপরতা' চালায়। পাসপোর্ট না থাকায় অপরাধমূলক কর্মকা-ে আটকের পর তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তৈরি হয় জটিলতা। এ সুযোগে বারবার তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মূলত গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোকে বিদেশীরা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এছাড়া বিনিয়োগকারী পরিচয়ে অভিজাত হোটেলে উঠে বিদেশে লোক পাঠানো, বাংলাদেশে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার আশ্বাস ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা প্রতারণা করছে। অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার দায়ে এর আগে বেশ কিছু বিদেশীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, বিদেশী নাগরিকরা অবৈধভাবে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করার পাশাপাশি অস্ত্র, স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালান, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, বিভিন্ন দেশের জাল নোট তৈরি, ডলার জালিয়াতি, এমনকি সন্ত্রাসী তৎপরতায়ও জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ভারত, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, তাইওয়ান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, চীন, তানজানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
অবৈধ বিদেশীরা কে কোথায় কী ধরনের কাজ করছে, সরকারকে বিপদে ফেলতে ষড়যন্ত্র ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিনা, সুনির্দিষ্ট ও যথাযথভাবে সে তথ্যও নেই কোনো সংস্থায়। বছরের পর বছর ধরে কর্তৃপক্ষীয় ঢিলেমির সুযোগে এসব অবৈধ বিদেশী নাগরিক নানা অপরাধমূলক কর্মকা- ঘটাচ্ছে। বিদেশীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে খুনের ঘটনাও ঘটছে। ওদের কারণে কখনো কখনো আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক বিদেশী নাগরিকের অবৈধভাবে অবস্থান যেকোনো বিবেচনায় উদ্বেগজনক। মাদক ও সোনা চোরাচালান, জাল টাকা তৈরি ও বিপণন, অবৈধ অস্ত্র ও ভিওআইপি ব্যবসা এবং জালিয়াতির সঙ্গে বিদেশীদের ব্যাপকহারে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকার পরও তাদের উপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা না করা দায়িত্বহীনতার নামান্তর। বিদেশীদের একাংশ সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িত বলেও সন্দেহ করা হয়। এজন্য পাকিস্তান এবং কোনো কোনো দেশের নাগরিককে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার করাও হয়েছে। সন্ত্রাসীবাদের সঙ্গে যুক্ত বিদেশীরা জাল টাকা তৈরির সঙ্গে ব্যাপকভাবে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে গত কয়েক বছরে রাজধানীতে অন্তত ২০০ বিদেশীকে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে গ্রেফতারের কথা স্বীকার করা হয়েছে। বিদেশী নাগরিকদের অবৈধভাবে অবস্থান এবং অপরাধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত হওয়া আইন-শৃঙ্খলার জন্য হুমকি সৃষ্টি করলেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কতটা সচেতন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত- এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যাতে বিদেশীদের পক্ষে অবৈধভাবে চাকরি ও বসবাস করা সম্ভব না হয়। এজন্য মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত ও জোরদার করতে হবে। কতজন বিদেশী আসছে, তারা ঘোষিত উদ্দেশ্যের বাইরে অন্য কোনো কাজ- বিশেষ করে চাকরি করছে কিনা এসব বিষয়ে মনিটরিং থাকতে হবে। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে যারা বাংলাদেশে আসছে তাদের কাউকে কোনো চাকরিতে ঢুকতে দেয়া যাবে না; বরং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বহিষ্কার বা গ্রেফতার করতে হবে। বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার সময়ও শর্ত রাখা দরকার যাতে স্থাপিত শিল্প বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রধানত বাংলাদেশীরাই পেতে পারে।
উল্লেখ্য, দেশের বেকারদের প্রতি কর্মসংস্থানের সুযোগ না দিয়ে কেবলমাত্র গাফলতি ও অবহেলার জন্য বিদেশীদের বিশেষত ভারতীয়দের এভাবে বিচরণ ও সুবিধা হাছিলের সুযোগ করে দেয়ার নজির বিশ্বের কোথাও নেই। সরকার যদি এ গাফলতির ইতি না টানে তবে জনগণকেই সোচ্চার হয়ে তার অবসান ঘটাতে হবে।
__._,_.___