আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত ব্যবস্থা অমান্য করে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট ফি প্রতিটনে ১৩০ টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশে শুল্ক পয়েন্টে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ ফি আদায় করবে। তবে পণ্য পরিবহনে নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেয়া হলে অতিরিক্ত ৫০ টাকা এবং ট্রান্সশিপমেন্ট তদারকি কার্যাবেক্ষণ চার্জ ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশীয় যানবাহনের জন্য প্রচলিত যেসব চার্জ রয়েছে, ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও একই পরিমাণ চার্জ বা ফি আদায় করা হবে। এছাড়া ভারতীয় পণ্য পরিবহনের উপর কোনো ধরনের ব্যাংক গ্যারান্টি থাকছে না। পণ্য পরিবহনকারী অপারেটরকে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দুই লাখ টাকা জামানত দেয়ার বিধান বহাল থাকছে। সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, চলমান অক্টোবরে ভারতে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ফি ও ব্যাংক গ্যারান্টির এসব প্রস্তাব তুলে ধরবে বাংলাদেশ। এতে নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদীর নেতৃত্বে জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যরা বৈঠকে অংশ নেবেন। বৈঠকে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ফিসহ অন্য বিধি-বিধানগুলো চূড়ান্ত হবে। তারা আরো জানান, দেশীয় বাজার ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে ২০১২ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ট্রানজিট সংশ্লিষ্ট সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ সংক্রান্ত কোর কমিটির কাছে প্রতি টন ৫৮০ টাকা ফি আদায়ের প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে স্ক্যানিংয়ের জন্য ৩০০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট বাবদ ২০ টাকা, নথি প্রক্রিয়াকরণ বাবদ ১০ টাকাসহ ৮টি খাতে এ টাকা ধরা হয়। এছাড়া পণ্যের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়ার কথা বলা হয়। ২০১৫ সালের একাধিক বৈঠকেও ওই প্রস্তাব বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নেয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আপত্তি এবং দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সভায় ট্রানজিট ফি (কাস্টমস সার্ভিস চার্জ) কমিয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণের বিষয়ে সম্মত হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু আমাদের মতে এতে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে ঢুকে যাওয়ার আশংকাও খুবই প্রবল।
পণ্য প্রবেশে কোনো রেসট্রিকশন না থাকলে বা অবাধে পণ্য যাতায়াতের সুযোগ দিলে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো হুমকির মধ্যে থাকবে।
গত সাড়ে ছয় বছরে ৫২টির বেশি দ্বিপক্ষীয় দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে। এর মধ্যে কানেকটিভিটি ও ট্রানজিট উন্নয়ন, জ্বালানি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা, পরিবেশ এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত নানা ইস্যু রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে সীমান্ত ইস্যু, সিকিউরিটি ও ল' এনফোর্সমেন্ট সহযোগিতা, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন, কানেকটিভিটি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগের বাস্তবায়ন হয়েছে। ট্রানজিট ও কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া ও নেপাল মোটর ভেহিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট, টু ওয়ে কোস্টাল শিপিং অ্যাগ্রিমেন্ট এবং ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট কার্যকর করার বিষয় বেশ এগিয়েছে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং সংবেদনশীল অন্যান্য ইস্যুতে সরকার অঘোষিতভাবে নীরব সহযোগিতা করে গেছে।
ভারতের ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি প্রায় ২০ বছরের পর্যবেক্ষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৮টি নদীসহ বিভিন্ন নদীর মধ্যে ২৯টি সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনার বিশেষ দিক হচ্ছে, নদীর এক অববাহিকার উদ্বৃত্ত পানি অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে, সেখানে স্থানান্তর করা। এই ২৯টি সংযোগ খালের মধ্যে ১৩টি হিমালয়বাহিত আর ১৬টি বিভিন্ন নদী ও উপদ্বীপ থেকে উৎসারিত। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত সারা দেশে ৭৪টি পানির আধার ও বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করবে। ফলে বর্ষার সময় সঞ্চিত পানি শুকনো মওসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও অন্যান্য কাজে সরবরাহ করা হবে। তারই অংশ হিসেবে এ নদীসংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছে ভারতের মন্ত্রী। পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পত্রিকার খবরকে ভিত্তি করে ভারতের কাছে 'প্রতিবাদ' জাতীয় কর্মকা- গ্রহণে অপারগ মর্মে জানিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের পানিবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংযোগ খালের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশ কার্যত মরুভূমিতে পরিণত হবে। মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের শাখা নদীগুলোর পানিপ্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে। আর নীরাভূমিগুলোও শুকিয়ে যাবে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমে গেলে লবণাক্ততা দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত উঠে আসতে পারে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে ইতোমধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ক্রমেই বাড়ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত জুন মাসে প্রথম বাংলাদেশ সফরে ৪১ বছর আগের মুজিব-ইন্দিরা গুচ্ছগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নকল্পে নতুন করে চুক্তি সম্পাদন ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতের সাথে যে ২২টি চুক্তি, চুক্তি নবায়ন, মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং তথা সমঝোতা ইত্যাদি সম্পাদন হয়েছে, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্য অক্ষরিক অর্থেই প্রায় ৯০ শতাংশ লাভজনক মর্মে প্রতীয়মান ট্রানজিট (সংশ্লিষ্ট উপকারকাক্সক্ষীরা 'কানেক্টিভিটি' নামে অভিহিত করছেন) চুক্তি। আর এ চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে ভারতের পক্ষ থেকে যে তোড়জোড় আহ্বান উপদেশ তাগিদ ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে, তা বেশ দৃশ্যমান এবং ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টিকটুও মনে হয়। তিস্তার পানির বেলায়, বাংলাদেশ নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত ব্যবস্থা অমান্য করে এ দেশের প্রাপ্য অধিকারকে আরো এক বা একাধিক দশক পিছিয়ে দেয়ার কারসাজির বিষয়ে তারা কোনো কথা বলছেন না। ট্রানজিট চুক্তির জন্য ভারত সেই ১৯৪৭ সাল থেকে এবং কার্যকরভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষমাণ ছিল, যা সম্প্রতি সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছে। ট্রানজিট, যার নতুন নাম দেয়া হয়েছে 'কানেক্টিভিটি'- বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার পাঁচ-ছয় বছর আগে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি 'কোর কমিটি' গঠন করেছিল। সেই কোর কমিটির পেশকৃত সমীক্ষা প্রতিবেদনে (২০১১) সংশ্লিষ্ট সড়ক-মহাসড়ক, রেল ও বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে (মূলত ভারতের সেভেন সিস্টারস রাজ্যগুলো থেকে বাংলাদেশের পশ্চিমাংশে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মালামাল পরিবহন সুগমকরণার্থে) প্রাথমিক হিসাবে ৪৭ হাজার ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন মর্মে মতামত দেয়া হয়। তবে পাশাপাশি ট্রানজিট-সংক্রান্ত অবকাঠামো তৈরির জন্য অর্থায়নে ঝুঁকি নিয়েও সতর্ক করেছে ওই কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের আওতায় আশানুরূপ পণ্য পরিবহন না হলে আর বিনিয়োগের অর্থ যদি বিদেশী সংস্থার কাছ থেকে নেয়া হয়, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এই বিপুল বিনিয়োগের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাজেটের মাধ্যমে সম্পূর্ণ দেশজ অর্থায়নে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে অন্যান্য আর্থসামাজিক উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্পে ব্যয় সঙ্কোচন হবে। এতে 'সুযোগ ব্যয়' আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই ট্রানজিট-সংক্রান্ত প্রকল্পে বিনিয়োগের বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।
কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট চুক্তিটি সব পক্ষের জন্যই লাভজনক হওয়া প্রয়োজন। তবে বিনিয়োগ কত দিনে উঠে আসবে, তা নির্ভর করছে কী পরিমাণ পণ্য ও যানবাহন আসা-যাওয়া করবে তার উপর। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প-িত, আমলা, প্রকৌশলী ও অন্যদেরকে সংশ্লিষ্ট কাজগুলো সম্পাদনের জন্য এখনই ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সম্প্রতি ভারতের ঢাকা হয়ে শুরু হয়ে যাওয়া বাস তথা যাত্রী চলাচলের মহড়ার পর এক বা দুই বছরের মধ্যে সেভেন সিস্টারস থেকে ভারতের মূল ভূখ-ে এবং উল্টো দিকে যে হিমালয়সম পণ্য মালামাল বাংলাদেশের উপর দিয়ে পরিবাহিত হবে, সে বিষয়ে সরকারের কোনো অনুভূতি ছিলো কি-না বা এখানো আছে কি-না তাই এখন বড় প্রশ্ন।
পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে অনেকগুলো স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তাদের টার্গেটেও পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ। এ বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে এ ক্ষেত্রে এগোনো উচিত ছিলো।
উল্লেখ্য, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতাকামী আন্দোলন ঠেকাতেই ভারতের দরকার বাংলাদেশের মাটি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কম করে হলেও ১৫টি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। এই গোষ্ঠীর মধ্যে আসামে রয়েছে ২টিÑ ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা, প্রতিষ্ঠা ১৯৭৯ সালে) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট অব বোড়োল্যান্ড (এনডিএফবি, প্রতিষ্ঠা ১৯৮৯ সালে)।
মনিপুরে রয়েছে ৩টি গোষ্ঠীÑ পিপলস লিবারেশন আর্মি (প্রতিষ্ঠা ১৯৭৮), ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (প্রতিষ্ঠা ১৯৬৪) ও পিপলস রেভলুশনারি পার্টি অব কাংলিপক। নাগাল্যান্ডে রয়েছে ৪টি গোষ্ঠীÑ নাগাল্যান্ড ন্যাশনাল কাউন্সিল (১৯৪৭), ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (১৯৮০), ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (আইএম-১৯৮৮) ও ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (কে-১৯৮৮)।
ত্রিপুরায় রয়েছে ২টি গোষ্ঠীÑ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (১৯৮৯) ও অল পার্টি টাইগার্স ফোর্স (১৯৯০)।
মেঘালয় রাজ্যে রয়েছে ২টি গোষ্ঠীÑ আচিক ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার কাউন্সিল (১৯৯৫) ও হাইনেউট্রেপ ন্যাশনাল লিবারেশন কাউন্সিল (১৯৯২) এবং মিজোরামেও রয়েছে আরো ২টি গোষ্ঠীÑ হামার পিপলস কনভেশন (ডি-১৯৯৫) ও বরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট।
__._,_.___