http://sonarbangladesh.com/article.php?ID=7367
স্বার্থপরতার পুঁজিবাদ শুধু আঘাতই হানবে
আবু আহমেদ
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, বর্তমানে পশ্চিম থেকে শিক্ষার কিছু নেই। তাদের অর্থনীতিগুলো ফেইলড বা ব্যর্থ অর্থনীতি! বরং কিছু শিখতে হলে পূর্বের অর্থনীতিগুলোর দিকে তাকাতে হবে, যেসব অর্থনীতি সফল হয়েছে এবং সেই সাথে যেসব নেতৃত্বও সফল হয়েছে। মাহাথির পশ্চিমের দুনিয়াতে কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নন। তবে পশ্চিম তাকে অবমূল্যায়ন করতে চাইলেও অন্য বিশ্ব তাকে অনেক মূল্য দেয়। সত্য হলো- পশ্চিমের সমাজগুলো আগেই নষ্ট হয়েছে এবং এখন তাদের অর্থনীতিগুলোও নষ্ট হচ্ছে। আমেরিকার সমাজের দিকে তাকালে এ কী সমাজ তারা গড়ে তুলেছে, যে সমাজে সমকামিতাকে আইনি ঘোষণা করে প্রকারান্তরে এ সংস্কৃতির চর্চাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন সমপ্রতি আফ্রিকান দেশ ঘানার ব্যাপারে বলেছেন, ওই দেশে সমকামিতা বেআইনি থাকলে তারা ব্রিটিশ সাহায্য পাবে না। ঘানা অবশ্য বলে দিয়েছে, তাদের কাছে সাহায্যের চেয়েও মূল্যবান হলো তাদের ধর্ম এবং তাদের মূল্যবোধ।
লিবারেল ভ্যালুর নামে তারা যে স্বাধীনতাকে এত দিন প্রমোট করে আসছে, সেই ভ্যালু তাদের সমাজগুলোকে ভেতর থেকে ফোকলা বানানোর জন্য যথেষ্ট। ভাগ্যিস যে, ওই সব দেশে কিছু মুসলমান ও এশীয় লোক ইমিগ্র্যান্ট হয়ে গিয়ে লিবারেল দর্শনের ভ্যালুর পরিবর্তে অন্য ভ্যালুও যে বিশ্বে আছে, তা তুলে ধরে ওই সব সমাজে একটা ভারসাম্য আনতে চেষ্টা করছে। নইলে ওই সমাজগুলোর অধঃপতন আরো ত্বরান্বিত হতো বলে অনেকেই মনে করেন। হ্যাঁ গণতন্ত্র, ফ্রিডম ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে তাদের অনেক কিছু শিক্ষার আছে। কিন্তু যে লোকটি ওই সব প্রাচুর্যের সমাজেও দরিদ্র ও বেকার, তার কাছে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কী মূল্য আছে? গরিব ও বেকার লোকেরা একত্র হয়ে ২০০৮ সালে বারাক ওবামাকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছে। কিন্তু এখন বাস্তবতা হলো- বারাক ওবামা আমেরিকান ধনী লোকদের কাছে জিম্মি। কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ধনীদের পক্ষে কথা বলে। সেখানে গরিবদের পক্ষে বলার জন্য তেমন উঁচু কণ্ঠস্বর নেই। তাই আমেরিকান গরিবদের মোহমুক্তি ঘটেছে। তারা ক্ষীণস্বরে হলেও আওয়াজ তুলতে চাইছে ওই সব ১ শতাংশ আমেরিকানদের বিরুদ্ধে, যাদের হাতে আমেরিকার বেশির ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত। যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা হলো সম্পদের অভাব নয়, তাদের সমস্যা হলো সম্পদের বণ্টন। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও সেখানকার ধনী ১ শতাংশ লোক আরো ধনী হচ্ছে।
ওই দেশের সরকারের ঋণের সুবিধাটা নিচ্ছে ধনী লোকেরা, কিন্তু বোঝাটা বহন করছে গরিব লোকেরা। তারা যে গরিব লোকদেরকে একেবারে মেরে ফেলছে তা নয়, তাদেরকে নিম্নতম মজুরি ধরিয়ে দিয়ে ভোক্তা হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে বটে, তবে সেই সব ভোক্তা ঋণের জালে আবদ্ধ, পুরনো গাড়ি আর বাড়ির মালিক। তাদের জীবনযাত্রার মান না বেড়ে শুধুই সঙ্কুচিত হচ্ছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই সমাজের কিছু লোক বলা শুরু করেছে- আসল দোষ ওই পুঁজিবাদের, যে পুঁজিবাদ শুধুই স্বার্থপরতার জন্ম দেয়, যে পুঁজিবাদে পুঁজির মালিকেরা অতি সহজেই মিলিয়নার-বিলিয়নার হতে পারে। অন্যরা গায়ে এবং মাথা দিয়ে খেটে ভালো ভোগ করে মাত্র, তবে ধনী হতে পারে না দুই-তিন যুগেও। এই যে যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার বাড়ি কোর্টের হুকুমে ক্লোজার বা অধিগ্রহণ হলো, ওইগুলো কাদের বাড়ি? সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব লোকদের বাড়ি, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ করে ওই বাড়িগুলো কিনেছিল অথবা ব্যাংকে বাড়ি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে ব্যাংকই ভোগ করতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। শোষকের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ওই সব সমাজের কিছু পণ্ডিত লোক যে কিছু বলেননি তা নয়, তবে সেই সব বক্তব্য কখনো পাত্তা পায়নি। পুঁজিবাদের মূল চেতনাই হলো পুঁজির ব্যবহার করো, শ্রমিক বা কৌশল ব্যবহার করে আরো বেশি উৎপাদন করো, আর ব্যয় করো, দরকার হলে ভোগের জন্য ঋণ করো। কোটি কোটি আমেরিকান ও ইউরোপীয় আজকে ঋণের চক্রে আটকে গেছে। সারা জীবনের শ্রম বিক্রি করেও তারা সেই ঋণচক্র থেকে বের হতে পারবে না। বেকারত্ব বাড়ছে, বর্ধিত মূল্যস্ফীতি গরিব লোকেদের ক্রয়ক্ষমতাকে আরো কমিয়ে দিচ্ছে। পুঁজিবাদ বলছে তাদের অর্থনীতিতে এসব ধস সাময়িক, আবার পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন শুরু হবে, আবার লোকে কাজ পাবে, আবার ভোগ ও ব্যয় বাড়বে। তাদের এই তত্ত্ব তত্ত্বীয়ভাবে ঠিক আছে বটে; তবে তত দিনে ওই সব সমাজের অনেক লোক দারিদ্র্য আর বেকারত্বের কশাঘাতে শুধু জর্জরিত হতেই থাকবে।
তাই তারা স্লোগান তুলেছে- 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট'- মানে পুঁজিবাদের কেন্দ্রস্থল নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট দখল করো। ওয়াল স্ট্রিট তো হলো একটা সিম্বল। আসলে এরা আওয়াজ তুলে বলতে চাইছে- তোমাদের এই ধনী হওয়ার অসমতন্ত্র আমরা মানি না। আমরা সমতাভিত্তিক সমাজ চাই। তবে তাদের আন্দোলনের সাথে লাখ লাখ লোক এখনো যোগ দেয়নি। ধনী লোকেরা তাদের স্বপ্নের পুঁজিবাদে ফাটল ধরাবে এমনটি অবশ্যই চাইবে না। তাদের হাতে আছে সংবাদমাধ্যম, তাদের হাতে আছে রাজনীতি, এমনকি আইন ও কোর্ট পদ্ধতিও তাদের পক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক পুঁজিবাদের জয়গান গেয়ে কত যে গবেষণা করছেন, তার ইয়ত্তা নেই। পুঁজিবাদের আদি গুরু হলেন ব্রিটিশ দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ। তিনি বলেছেন, মানুষ প্রকৃতগতভাবেই গ্রিডি লোভী, তাকে তার সম্পদ ও ভোগ বাড়াতে স্বাধীনতা দাও। দেখবে পুরো সমাজে শুধুই সম্পদের সৃষ্টি হচ্ছে। এই দর্শন থেকে ব্যক্তিমালিকানার অবাধ সুবিধা ওই সব সমাজ তাদের লোকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। রাষ্ট্র মালিকানার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো- এই গ্রিড বা লোভভিত্তিক পুঁজিবাদে পুঁজির জোগানদারদের কাছে অন্যদের হার মানতে হয়। সৃষ্টি হয় এক অসম সমাজ। এরাই সুদ দেয়া ও ব্যবহার করাকে উৎসাহিত করেছে। পুঁজিবাদ বলে, সুদ হলো মূলধনের মূল্য। আর এই সুদের নির্যাতনের কাছেই আজকে গরিব লোকেরা পরাজিত হচ্ছে।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১৭/১১/১১]
http://www.sonarbangladesh.com/articles/AbuAhmed
শেয়ার করুনঃ
পাঠকের মন্তব্য: |
১ | |
১৭ নভেম্বর ২০১১; সন্ধ্যা ০৬:৫৬ | |
ধন্যবাদ স্যার, এখন সময় এসেছে পুজিবাদের শূন্য গহবরগুলো খুঁজে বের করার। মানুষ লোভী(গ্রীডী) এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু মানুষের সেই লোভ কে সমাজ স্বীকৃত উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের উতপাদনের চাকাকে সচল রাখা মানব সমাজের | |
71851 | |
__._,_.___