কোথায় কার যোগসূত্র
সামরিক বাহিনীর সময়োচিত যথার্থ পদক্ষেপের ফলে বহু আন্দোলন সংগ্রাম আর আত্মবলিদানের বিনিময়ে অর্জিত হাজার বছরের স্বপ্নসাধ আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল শাসন-সুশাসন অক্ষত রয়েছে। সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ধর্মান্ধ চক্রান্তকারী গোষ্ঠীর ছোবল ব্যর্থ করে দিয়েছে আমাদের সামরিক বাহিনী। জাতি একটি অনভিপ্রেত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হাজারো শোকরিয়া আদায় করছি। সেই সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করায় আমাদের সামরিক বাহিনীকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যদিও জানি ষড়যন্ত্রকারীরা বসে নেই। সুযোগ পেলেই হয়ত আবারও ছোবল মারার চেষ্টা করবে। অতীতেও বহুবার এমনি চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি অর্ধশতাধিক কালের অভিজ্ঞ রাজনীতিক একজন সৎ সুন্দর সাহসী মানুষ যখন রাষ্ট্রপতি এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনীতির উত্তরাধিকার, এ সময়ে সবচেয়ে সাহসী বিশ্বস্ত মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মানুষ যখন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বা প্রধানমন্ত্রী এই যৌথ নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাবেই। যারাই ধর্মান্ধ পশ্চাৎপদ রাজনীতি টেনে এনে দেশ ও জাতিকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করবে তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আয়ুব-ইয়াহিয়া চেষ্টা করেছে পারেনি, জিয়া-এরশাদ চেষ্টা করেছে পারেনি, ভবিষ্যতেও কোন 'মেজর জিয়া' পারবে না। বাংলাদেশের মানুষ আজ সচেতন, বিশেষ করে আমাদের বিচক্ষণ তরুণ সমাজ কোন অসাংবিধানিক শাসন মানবে না। ৩০ লাখ শহীদ ও পোনে ৩ লাখ জীবন সম্ভ্রম উৎসর্গকারী মা-বোনের মতোই দুষ্ট-নষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনা করবে, এগিয়ে যাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলার মাটি পাপমুক্ত করবে।
আমাদের স্বাধীনতা অনেক দাম দিয়ে কেনা। এই স্বাধীনতা কারও দয়ার দান নয়। জাতির জনকের রক্তের উত্তরাধিকার, ৩০ লাখ শহীদ ও ৩ লাখ জীবন-সম্ভ্রম উৎসর্গকারী মা-বোনের উত্তরাধিকার। বীর-মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষের রক্তের উত্তরাধিকার আজকের প্রজন্ম বাংলার ঘরে ঘরে। এই প্রজন্ম পশ্চাৎপদ ধর্মান্ধ রাজনীতি চায় না। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না কেবল সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা যুদ্ধাপরাধী ও তাদের ধর্মান্ধ সন্তানরা। আর চায় না তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে যারা ক্ষমতার সিঁড়ি খোঁজে তারা। এদের একটি অংশ মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও অন্তরে রাজাকার-আলবদরদের জন্য পিরিতি। এ রকম কিছু গোলাম-নিজামী, সাকা-সাঈদীর প্রতিচ্ছবি এখনও সমাজের সর্বস্তরে রয়েছে। রয়েছে সামরিক বাহিনীতেও। এরাই নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক ধারাকে অনিয়মতান্ত্রিক অসাংবিধানিক ধারায় নিয়ে যেতে চায়। এরাই মানুষের এই সুন্দর সমাজকে অমানবিক পথে পরিচালিত করতে চায়। মাঝে মাঝে ছোবল মারার চেষ্টা করে। সম্প্রতি এ রকম একটি ছোবল মারার চেষ্টা করলে আমাদের সুশৃক্সখল সেনাবাহিনী বিচক্ষণতার সঙ্গে তা নস্যাৎ করে জাতির শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সামরিক বাহিনী সম্পর্কে একটা কথা বলা হতো এই বাহিনী পাকি-সামরিক বাহিনীর লিগাসি বহন করছে। সাম্প্রতিক পদক্ষেপ তাদের সেই দুর্নাম ঘুছিয়ে দেবে বলে আমি মনে করি।
তবে একটু অবাক হবার বিষয় হলো যে সব মধ্যরাতের গলাজীবী প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগ সরকারের দোষত্রæটি তিলকে তাল বানিয়ে বলতে ভালবাসেন, গলা ফাটান, সম্প্রতি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ক্যু-এটেম্পট ব্যর্থ হওয়ার পর এবং সামরিক বাহিনী তা জাতির সামনে তুলে ধরার পর বন্ধুদের গলা যেন ফ্যাসফেসে হয়ে গেছে। বন্ধুরা এখন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদার কি কি বাস্তবায়ন হলো কি কি হলো না এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন। উদ্দেশ্য আসল ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো। কেননা ওই গলাজীবী বন্ধুদের পিরিতের মানুষরা অন্ধকারের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারেন। কারণ এরই মধ্যে সাম্প্রতিক ব্যর্থ ক্যু-এটেম্পটের সঙ্গে সম্পৃক্তার নামগুলোর সঙ্গে উঠে এসেছে সেই পিরিতের সন্তান তারেক রহমানের নাম।
আমাদের সাংবাদিকতা জগতের কিংবদন্তি সম্পাদক, প্রখ্যাত লেখক কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী গত ২৫ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠে 'চোরের মার বড় গলা' শিরোনামে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে হাঁড়িটি ভেঙ্গে দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের অন্যতম ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মেজর ডালিম যাকে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াত স্বামী মিলিটারি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রদূত বানিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন, সেই পলাতক মেজর ডালিম এখন পাকিস্তানে আশ্রিত। সেখানে বসে এই ডালিম বাংলাদেশে রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো এং নতুন কিলার বাহিনী গঠনের ষড়যন্ত্রে রত। এখন ঢাকায় ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্পর্কে তদন্ত সূত্রেই জানা যাচ্ছে এই অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি বৈঠক হয়েছে তিনটি দেশ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং হংকংয়ে। এই তিন দেশের বৈঠকেই মেজর ডালিম উপস্থিত ছিলেন। লন্ডনের বাজারে এখন জোর গুজব মেজর ডালিম ও লন্ডনে বসবাসকারী তারেক রহমানের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।' উল্লেখ্য, আবদুল গাফফার চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন প্রবাসী হলেও বাংলাদেশের চলমান ধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
আমাদের মধ্যরাতের গলাজীবী বন্ধুদের গলা সম্ভবত ফ্যাসফেসে এ জন্য যে, সাম্প্রতিককালে এক কাকডাকা ভোরে রাজধানী ঢাকায় সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ও মানুষ হত্যা, কিংবা পুলিশের ওপর যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ডে বিএনপি-জামায়াত জোটনেত্রী বেগম জিয়ার সামরিক বাহিনীর উদ্দেশে উস্কানিমূলক বক্তৃতা প্রদান এবং ঢাকায় সামরিক বাহিনীর ধর্মান্ধ ক্যু এটেম্পট ব্যর্থ করে দেয়া এসব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কোথায় কার যোগসূত্র তা প্রকাশ পাবে, থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে। গলাজীবী বন্ধুদের ভয় সম্ভবত এখানেই। এবং এ কারণেই বন্ধুরা সাইড-লাইন ধরেছেন, কেউ কেউ ঘোমটা পরে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছেন।
কি বলেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ডের জনসভায় ! বলেছিলেন, 'দেশে প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা হচ্ছে, গুম হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর অফিসারদের পর্যন্ত গুম করা হচ্ছে। বিডিআর ধ্বংস করে এবার সেনাবাহিনী ধ্বংস করতে চায় সরকার। এরা ক্ষমতায় আসার পর অনেক সেনাসদস্যকে বন্দী করে বিচার করা হচ্ছে। অনেককে গুম ও চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। এ সরকার বিডিআর ধ্বংস করে এখন সামরিক বাহিনী ধ্বংস করতে চায়।' এসব কথা বলে বেগম জিয়া মূলত সামরিক বাহিনীকে বর্তমান সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি তিনি সামরিক বাহিনীর সামনে লোভের টোপ পর্যন্ত দিয়েছেন যে, 'ক্ষমতায় গেলে চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করবেন।'
এভাবে কথা বলে বেগম জিয়া এক ঢিলে বহু পাখি মারতে চেয়েছেন-(১) ক্যান্টমেন্টের বাড়ি থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করায় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ চরিতার্থ করা, (২) শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে যাবার যন্ত্রণা থেকে নিজেকে উদ্ধারে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে সরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। যদি কল্পনা করা হয়, ঢাকায় সামরিক অভ্যুত্থানের এবং চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড থেকে বিপ্লবী রাষ্ট্রপতি হয়ে সরাসরি বঙ্গভবনে প্রবেশ, বিষয়টি রোমাঞ্চকর নয় কি? এসব কল্পনা রোমাঞ্চ সামনে চলে আসতে পারে এ ভয়েই কি তবে গলাজীবী বন্ধুরা সাইড লাইন ধরেছেন? হবে হয়ত?
সামরিক বাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর ঘৃণ্য প্রচেষ্টা প্রতিহত করার পর সেনা সদর দফতর থেকে যে প্রেস ব্রিফিং করা হয় তাতেও বেগম খালেদা জিয়ার চট্টগ্রামের উস্কানিমূলক বক্তব্যের উল্লেখ করা হয় গত ১৯ জানুয়ারি আর্মি অফিসার্স ক্লাবে আয়োজিত এই প্রেস ব্রিফিংয়ে সামরিক বাহিনীর পার্সোনাল সার্ভিস পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহম্মদ মাসুদ রাজ্জাক বলেন, 'উগ্র ধর্মান্ধ কিছু সংখ্যক চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর ঘৃণ্য প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হয়েছে।' এ ঘটনায় বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কেউ কেউ পলাতক রয়েছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক বলেন, "সম্প্রতি কিছু প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকের ইন্ধনে অবসরপ্রাপ্ত এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় কর্মকর্তা অন্যদের ধর্মীয় অনুভ‚তিকে পুঁজি করে দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সেনাবাহিনীতে বিশৃক্সখলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করতে চায়।...তারা নিকট ও দূর অতীতের ন্যায় এবারও ধর্মীয় অনুভ‚তি, অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর প্রক্রিয়া ব্যবহারে করেছে। ...অপপ্রচার চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে কিছু স্বার্থাম্বেষী সংবাদপত্র, নিষিদ্ধঘোষিত ধর্মভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের প্লাটফরম।'
প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, চক্রান্তে জড়িত পলাতক মেজর জিয়া গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইন্টারনেটে 'mid-level officers of Bangladesh Army bringing down change soon' শিরোনামে একটি মেইল ছড়িয়ে দেয়। এই মেইলটিই গত ৮ জানুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মান্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর ডাউনলোড করে দেশব্যাপী উস্কানিমূলক লিফলেট ছড়িয়ে দেয়। ... তার একদিন পর ৯ জানুয়ারি দেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল উপরোক্ত মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও প্রচারণামূলক সংবাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে 'সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করা হয়, যা সেনাবাহিনী ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে উস্কানিমূলক বিতর্কের সৃষ্টি করে।'
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানে আশ্রিত মেজর ডালিমের যোগাযোগ, কিংবা ৮ জানুয়ারি জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের ইস্টারনেটে প্রোপাগান্ডার পরদিন বেগম খালেদা জিয়ার চট্টগ্রামের জনসভায় একই উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান, এসব বিশ্লেষণ করলে সহজেই সামনে চলে আসবে 'কোথায় কার যোগসূত্র?'
সম্ভবত মধ্যরাতের গলাজীবীদের ভয় এবং দুশ্চিন্তা এ জায়গাটাতেই।
ঢাকা, ২৬ জানুয়ারি: ২০১২
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক