গো. আযমের পক্ষে ওকালতি এমাজউদ্দিনদের নিন্দা, প্রতিবাদের ঝড়
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ মহান একুশের প্রাক্কালে সাবেক ভিসি এমাজউদ্দিন আহমদসহ বিএনপিসমর্থিত কিছু বুদ্ধিজীবীর প্রকাশ্যে একাত্তরের ঘাতক ও রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের পক্ষে অবস্থানের ঘটনায় সারাদেশে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। যুদ্ধাপরাধীদের পাশাপাশি তাদের দোসর জ্ঞানপাপীদেরও বিচারের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, আইনজ্ঞ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, গণতন্ত্র হত্যাকারী সামরিক শাসকদের পদলেহনকারী কিছু বুদ্ধিজীবী জ্ঞানপাপী এখন যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় জাতিকে বিভ্রান্ত করতে মাঠে নেমেছে। রাজনীতিতে হালুয়ারুটির লোভে এসব জ্ঞানপাপী বিএনপি-জামায়াতের মিশন চরিতার্থ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর দোসরদেরও একদিন দেশের মানুষ বিচার করবে। বিশ্বের অন্য কোন সভ্য দেশ হলে, স্বাধীনতার ৪০ বছরেও যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসররা প্রকাশ্যে মাথা তুলে কথা বলতে পারত না। একবার নয়, জঘন্য অপরাধের জন্য গোলাম আযমদের ১০ বার ফাঁসি হতো। আর বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এমাজউদ্দিনরাও কোনদিন ভিসি হতে পারতেন না।
উল্লেখ্য, সোমবার বিএনপি-জামায়াত ঘরানার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে গঠিত সম্মিলিত পেশাজীবী ফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এম এমাজউদ্দিন আহমদ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ভাষা সৈনিক' দাবি করে বলেন, ভাষার মাসে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে তার ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেশের আজ যে দশা, তা আগে অনুমান করতে পারলে অনেক মানুষই হয়ত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিত না।
এমাজউদ্দিন আহমদের এমন বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও দেশের প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল (অব) কেএম শফিউল্লাহ বীরউত্তম জনকণ্ঠের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যারা আজ গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ওকালতি করছেন তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হোক- একাত্তরে তাঁদের কোন আত্মীয় বা ভাই-মা-বোনকে যুদ্ধাপরাধীরা যদি নির্যাতন করত তখনও কি এসব লোক আজকের মতো একই কথা বলতেন? তিনি বলেন, গোলাম আযম জাতীয় বেঈমান। আজও তারা বাংলাদেশকে স্বীকার করে না। আজ সময় এসেছে এদের আবারও নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়া হোক। এমাজউদ্দিনের মতো জ্ঞানপাপীরা আমাদের দেশে যেন আর না জন্মায়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিএনপি ও তাদের দোসরদের সমস্ত কর্মকা-ই পরিচালিত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায়। এর আগে খালেদা জিয়া নিজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ এবং একাত্তরের ঘাতকদের মুক্তির দাবি করে যুদ্ধাপরাধীদের দোসর হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। আজ তাঁরই উপদেষ্টা জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবী এমাজউদ্দিনরা গোলাম আযমের পক্ষ নিয়ে নিজেদের যুদ্ধাপরাধীদের দোসর হিসেবে প্রমাণ করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর দেশের জনগণ একদিন এই দোসরদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
সিনিয়র আইনজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় হালুয়ারুটির লোভে অনেকেই মানসিক বিকৃতির উদাহরণ সৃষ্টি করে। একাত্তরে গোলাম আযম গং জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। এদের সমর্থন করার মানেই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করা। গণতন্ত্র হত্যাকারী ও সামরিক শাসকদের পদলেহনকারী এক শ্রেণীর কথিত বুদ্ধিজীবী জ্ঞানপাপী গোলাম আযমদের পক্ষ নেবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, যারা বর্তমানে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করছে, উঁচু গলায় কথা বলছে- বাংলাদেশে এমন অবস্থা হবে জানলে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা উদারতা দেখিয়ে এদের বেঁচে থাকার সুযোগ দিত না।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এমাজউদ্দিন আহমদ একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তাঁর মতো লোক গোলাম আযমসহ রাজনীতিতে আবর্জনা বলে পরিচিতদের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেন, সেটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক ও দেশের মানুষকে ব্যথিত করে। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এমাজউদ্দিনরা ভিসি হতে পারতেন না, জিয়া সেনাপ্রধান বা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না।
এমাজউদ্দিন আহমদের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, গোলাম আযম ভাষাসৈনিক ছিলেন, কি ছিলেন না সেটা বড় কথা নয়। মূল কথা হচ্ছে গোলাম আযম জাতীয় বেঈমান, একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েছে, প্রকাশ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানের টিক্কা খান-ইয়াহিয়াদের একনম্বর দালাল ছিল এই গোলাম আযমরা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এমাজউদ্দিন স্যারদের মতো মানুষ সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদ, জঙ্গী-যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ওকালতি না করতেন তবে বাংলাদেশ আজ যা এগিয়েছে তারও অনেক বেশি দূর এগিয়ে যেত। রাজনীতির এসব আবর্জনা সুনামির ঝড়ে অবশ্যই উড়ে যাবে।
প্রবীণ রাজনীতিক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, এমাজউদ্দিন আহমদের মতো লোকদের মুখে এ ধরনের বক্তব্যে বিস্ময় লাগে। এই গোলাম আযমরা পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- ঘটিয়েছে। স্বাধীন দেশেও বোমাবাজি, জঙ্গীবাদ সৃষ্টি, রগকাটা, মানুষ হত্যা করেছে। তিনি বলেন, এসব লোক আগেও জাতিকে বিভ্রান্ত করতে সত্যকে মিথ্যা বলেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধকে গন্ডগোল বলে চালানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে। কিন্তু আগেও তারা সুবিধা করতে পারেনি, এখনও পারবে না।