বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাংলাদেশের প্রিমিয়ার লীগের খেলায় স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে সাজিদ খান (৩৬) নামে এক পাকিস্তানী নাগরিককে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দু'দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সাজিদের মোবাইলে পাকিস্তানী এক ক্রিকেটারের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট নম্বর ও ই-মেইল নম্বর পাওয়া গেছে। খেলা চলাকালীন সে তার মোবাইল ফোন দিয়ে খেলার খবরাখবর চট্টগ্রামের হোটেলে অবস্থানরত খেলোয়াড়, ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেল অবস্থানরত খেলোয়াড় ও পাকিস্তানে অবস্থানরত খেলোয়াড়দের কাছে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান কর্নেল এটিএম মেসবাহউদ্দিন সেরনিয়াবাত মিরপুর থানায় সাজিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার আগে তাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের দুর্নীতি দমন ও নিরাপত্তা ইউনিটের সফররত কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিটি ছক্কা মারার পর সে পাকিস্তানে ফোন করে বলে মামলার বাদী সেরনিয়াবাত জানিয়েছেন। সে খেলোয়াড়দের সাজঘরে প্রবেশেরও চেষ্টা করেছিল। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। সাজিদ খান গ্রেফতারের বিষয়ে পিসিবি (পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড) উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কোন মন্তব্য করেনি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান এটিএম মেসবাহউদ্দিন সেরনিয়াবাত সাংবাদিকদের জানান, সাজিদ খানের বাড়ি পাকিস্তানের করাচীতে। তার বয়স প্রায় ৩৬ বছর।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে বিপিএলের খেলা শুরু হয়। চলে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। চট্টগ্রামে খেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই তার গতিবিধি বিসিবি কর্মকর্তাদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। এজন্য চট্টগ্রামে ম্যাচ শুরুর পর থেকেই তার ওপর বিসিবির তরফ থেকে সর্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছিল। তার পুরো কর্মকা-ের ওপর নজরদারি চলতে থাকে বিসিবির পক্ষ থেকে। রবিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর মিরপুর থানাধীন মিরপুর জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে সাজিদ খানকে আটক করেন বিসিবি কর্মকর্তারা। সম্ভাব্য স্পট ফিক্সিংয়ের সম্ভাবনায় বিসিবিতে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। খেলোয়াড়দের সাজঘরসহ সংরক্ষিত এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াজেদ আলী জনকণ্ঠকে জানান, নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাজিদ খান খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুমে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় বিসিবি কর্মকর্তারা সাজিদ খানকে আটক করেন। পরে পুলিশে খবর দিলে পুলিশ সেখানে হাজির হয়। বিসিবি কর্মকর্তারা সাজিদ খানকে পুলিশের কাছে তুলে দেন। সাজিদ খান পাকিস্তানী নাগরিক। তার বিরুদ্ধে বিপিএলের কোন কোন ম্যাচের স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ করেন বিসিবি কর্মকর্তারা। রাতেই সাজিদ খানকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মিশুক চাকমার কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে বিসিবির পক্ষ থেকে মিরপুর থানায় সাজিদ খানের বিরুদ্ধে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়।
সাজিদ খান খেলোয়াড়দের সাজঘরের ওপর ভিআইপি গ্যালারি থেকে খেলা উপভোগ করে। প্রতিটি ছক্কা মারার পর সে পাকিস্তানে টেলিফোন করে। বেশ কয়েকবার সাজিদ খেলোয়াড়দের সাজঘরেও প্রবেশের চেষ্টা করে। খেলোয়াড়দের সাজঘরে প্রবেশের ক্ষেত্রে সে সাজঘরে নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করে। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। এরপর সাজিদ খানকে আটক করা হয়। আটকের পর সাজিদের পুরো আচরণ সম্পর্কে আইসিসির (আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল) দুর্নীতি দমন ও নিরাপত্তা ইউনিটের সফররত কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়।
মেজবাহউদ্দিন সেরনিয়াবাত আরও জানান, বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা তিন সপ্তাহ আগে বিসিবির কাছে সাবেক এক ক্রিকেটার তাঁকে (মাশরাফিকে) স্পট ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন। মাশরাফি বিন মর্তুজার এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিসিবির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাহাবুবুল আনামকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় এবং বিপিএলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই স্পট ফিক্সিংয়ের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির বিষয়টি প্রকাশ করা হয়নি। তবে গোপনে তদন্ত কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। পুরোপুরি তদন্ত শেষ না হওয়ায় তদন্ত কমিটি এখনও কোন তদন্ত প্রতিবেদন বিসিবির কাছে জমা দেয়নি।
বিপিএলের গবর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান গাজী আশরাফ হোসেন লিপু সাংবাদিকদের জানান, স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে সাজিদ খান ও পাকিস্তানী ক্রিকেটার সম্পর্কে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে (পিসিবি) জানানো হয়েছে। পিসিবি এতে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি।
বিসিবি সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল বিষয়টি নিয়ে বিসিবির উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরী বৈঠক করেছেন। ইতোমধ্যেই স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে বাংলাদেশে পাকিস্তানী নাগরিক সাজিদ খানের গ্রেফতারের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার পেয়েছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া সেন্টারের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পুলিশ তাঁদের কাছে সাহায্য চাইলে তাঁরা সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন।
আদালত প্রতিবেদক জানান, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে সাজিদ খানকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আতিকুর রহমানের আদালতে হাজির করেন। আদালত শুনানি শেষে সাজিদ খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আসামির পক্ষে কোন আইনজীবী শুনানিতে অংশ না নেয়ায় সাজিদ খানের জামিনের পক্ষে কোন আবেদনও পড়েনি।
গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোঃ মাইনুল ইসলাম জানিয়েছেন, পাকিস্তানী নাগরিক সাজিদ খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোর সে একজন বড় মাপের জুয়াড়ি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ক্রিকেটার নাসির জামশেদকে তাঁর হোটেলে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত সাজিদের সঙ্গে নাসির জামশেদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।