শংকর কুমার দে ॥ সরকারের শেষ সময়ে এসে শাস্তি দিয়েও পুলিশকে বশে আনা যাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের ৩ বছরে ৪৩ হাজার পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই পুলিশ বেসামাল হয়ে আকস্মিকভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নেপথ্যে কোন তৃতীয় শক্তি কলকাঠি নেড়ে পুলিশকে উস্কে দিচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের উচ্চ পর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, '৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ক্ষমতার শেষ দিকে নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ এ ধরনের বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমান নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন। রাজধানীর একটি পাঁচতারা মর্যাদার হোটেলে সে সময় পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারেক রহমানের গোপন বৈঠকের খবর ফাঁস হয়ে যায়। নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ বাহিনীর সদস্য দিয়ে তখন অস্বাভাবিক ধরনের অপরাধ সংঘটিত করানো হয়েছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের উস্কে দেয়ার অতীতের তৎপরতার মতোই পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের মেয়াদপূর্তির আরও প্রায় দেড় বছর বাকি। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। তত্ত্ববধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। এরই মধ্যে মাইনাস টু, মাইনাস ওয়ান ফর্মুলার কথা এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে শোনা যাচ্ছে। তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের আশঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। তৃতীয় শক্তির পদধ্বনির গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশের মধ্যে আকস্মিকভাবে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিকে কোন মহলই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। দিনেদুপুরে বিচারপ্রার্থী তরুণীকে আদালতপাড়ায় পুলিশ ক্লাবে নিয়ে শ্লীলতাহানি করার মতো অস্বাভাবিক ঘটনা মানুষজনের মধ্যে মুখে মুখে ফিরছে।
এসি ও ওসির নাম বাদ দিয়ে মামলা
পুরনো ঢাকার আদালতপাড়ায় পুলিশ ক্লাবে তরুণীকে আটকে রেখে শ্লীলতাহানির চেষ্টার ঘটনায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হয়েছে বুধবার রাতে। নির্যাতনের শিকার তরুণীর মা রেবা বেগম বাদী হয়ে এ মামলা করেছেন। মামলা দায়ের নিয়ে পুলিশ চরম নাটকীয়তা করেছে। ওসি থানায় নেই বলে মামলার বাদীসহ অন্যদের বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রাখা হয়। পরে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ বাদীসহ সবাইকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নেন। তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের নামে রাত ২টা পর্যন্ত তাঁর কার্যালয়ে বসিয়ে রাখা হয়। এরপর রাত ২টার দিকে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। পরে পুলিশ মামলা রেকর্ড করে। তবে মামলা রেকর্ডের সময় দেখানো হয়েছে রাত ১০টা ৫ মিনিট। বৃহস্পতিবার মামলার তদন্তভার স্থানান্তর করা হয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ শাখায়।
মামলায় আসামির তালিকায় কোতোয়ালি থানার ওসি সালেহ উদ্দিনের নাম নেই। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলেও আসামির তালিকায় তাঁর নাম কেন নেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি নাম নেই কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার রাজীব আল মাসুদেরও। কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই নাজমুল হুদা, এসআই মনিরুজ্জামান এবং পুলিশ সোর্স বাবুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়। বাকি দু'জনের মধ্যে একজনকে সাদা পোশাকের পুলিশ ও অপরজনকে পুলিশের পোশাক পরিহিত অজ্ঞাতনামা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় পুলিশের বিরুদ্ধে চুরি করা, অবৈধভাবে বাধাদান, পথরোধ করা এবং মারধরের অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার আসেন রেবা বেগম তাঁর মেয়ে ও স্বামী ফারুককে নিয়ে ২৭, কোর্ট হাউস স্ট্রীটে আদালত চত্বরের পেছনে। মেয়ের স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করার জন্য আদালতের একজন মুহুরীর সঙ্গে আলোচনা করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি তাঁর স্বামী ও মেয়েসহ সিএমএম কোর্টের গেট দিয়ে মোটরসাইকেলে বের হওয়ার সময় পুলিশ সোর্স বাবু ও সাদা পোশাকে এক পুলিশ তাদের পথরোধ করে। এ সময় পুলিশ সোর্স বাবু তাদের দেখিয়ে বলে মোটরসাইকেল চোর। এ সময় তারা তাদের মোটরসাইকেলটি কেড়ে নিতে চায়। একপর্যায়ে তাদেরসহ মোটরসাইকেলটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আরও কয়েক পুলিশ সেখানে এসে তাঁর স্বামী ও মেয়েকে পুলিশ ক্লাবের ভেতর নিয়ে কলাপসিবল গেট আটকে দেয়। তাদের দু'জনকে দুই রুমে আটকে রাখা হয়। এ সময় কোতোয়ালি থানার সেকেন্ড অফিসার নাজমুল হুদা তাঁর স্বামীকে চড়, লাথি ও ঘুষি মারেন। তিনি তাঁর স্বামীর গলায় থাকা স্বর্ণের চেন ও হাতঘড়ি কেড়ে নেন। এ সময় তাঁর মেয়ে অপর কক্ষ থেকে চিৎকার করে বলে পুলিশ তার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তিনি পুলিশ ক্লাবের বাইরে থেকে চিৎকার করলে উপস্থিত আইনজীবীরা পুলিশকে গেট খুলতে বলেন। গেট খুললে আমার মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে। এ সময় কোতোয়ালি থানার ওসি সালেহ উদ্দীনসহ ৪-৫ জন পুলিশ আসে। পুলিশ তাঁর স্বামীকে টেনেহিঁচড়ে পুলিশভ্যানে তুলে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। বিকেল ৪টার দিকে তিনি ও তাঁর মেয়েসহ আদালত এলাকায় ঘোরাঘুরি করার সময় পুলিশ আবার তাদের দেখে গালিগালাজ করে। এ সময় তিনি এর প্রতিবাদ করলে উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকরা এগিয়ে যান। পুলিশ আইনজীবী ও সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করে। এ সময় পুলিশ তাঁকে, তাঁর মেয়ে ও দু'জন আইনজীবীকে পুলিশভ্যানে তুলে নিয়ে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। সন্ধ্যায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল দু'জন সহকর্মীসহ থানায় আসেন। পরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জিম্মায় নেন তাঁদের।
মাছের রাজা ইলিশ আর জামাইর রাজা পুলিশ
পুলিশের মধ্যে আকস্মিকভাবে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষজনের মধ্যে মুখে মুখে ফিরছে 'মাছের রাজা ইলিশ আর জামাই রাজা পুলিশ'। পুলিশের অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, আইনজীবী, সাধারণ মানুষ কেউ-ই পুলিশের নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। যাকেই পারছে পুলিশ তাকেই হেনস্থা করছে। তবে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের নির্যাতন করে পুলিশ এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত। অনেকের মতে, পুলিশের মধ্যে 'চেন অব কমান্ড' বলে এখন আর কিছু নেই। ফ্রিস্টাইলে চলছে পুলিশের কার্যক্রম। ফলে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোথাও কোথাও পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এর ফলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মুষ্টিমেয় পুলিশের জন্য তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে।
আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার
কর্মীদের অভিমত
পুলিশের প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্য পাওয়ায় তারা এতটা বেপরোয়া। তারা অপরাধ করেও থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অপরাধী পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। কোন ঘটনা ঘটলে পুলিশকে দিয়েই তদন্ত করানো হয়। ফলে তদন্ত রিপোর্ট পুলিশের পক্ষে চলে যায়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, শাসক দলের নেতারা পুলিশকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রাজনৈতিক তদ্বিরে পুলিশে চাকরি পাচ্ছে কেউ কেউ। ফলে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্য কাউকেই তোয়াক্কা করছে না। পাশাপাশি দলীয় আনুগত্য পেতে কিছু পুলিশ সদস্য আবার অতিউৎসাহী হয়ে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে, যা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে। এতে একদিকে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে ঘটনার শিকার বিশেষ পেশা বা শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি সাংবাদিক নির্যাতনের একাধিক ঘটনায় সাংবাদিকদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করছেন। অবশ্য এ অবস্থার মধ্যেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভাল। অনেকের মতে, এ ধরনের বক্তব্যে পুলিশের বাড়াবাড়িকে আরও উৎসাহিত করতে পারে।
মাঠ পর্যায়ে পুলিশ কেমন
পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা সিনিয়র কর্মকর্তাদের কোন আদেশই পালন করছে না। পুলিশ সদস্যরা যে যার মতো দায়িত্ব পালন করছেন। আইনের লোক হয়েও তারা আইনকে তোয়াক্কা করছে না। মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে পুলিশ প্রকাশ্য অসহায় নারীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে যে কাউকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। আবার কেউ পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তার নিস্তার নেই। থানার হাজতখানার ভেতর আটক ব্যক্তিদের ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিবর্তে নিজেরাই অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে আসছে। ডাকাতি ছিনতাই থেকে শুরু করে সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে কিছু অসাধু পুলিশ। পুলিশের এই বেপরোয়া আচরণে রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীতে পুলিশের মারমুখী আচরণে হতবাক হচ্ছে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো পর্যন্ত পুলিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি উচ্চ আদালতও বলেছে পুলিশ ব্যর্থ।
পুলিশের মধ্যে দুষ্ট প্রকৃতির লোক
পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, পুুলিশের মধ্যে কোন দুষ্ট প্রকৃতির লোক প্রবেশ করেছে কিনা তা খুঁজে বের করতে হবে। যে কোন দলীয় সরকারের আমলেই পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আবার দলীয় আনুগত্য পাওয়ার পর কাউকে পরোয়া করছে না। নিজের মতো করেই তারা চাকরি করছেন। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বেশি বেপরোয়া। পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশ পালন করছেন না তাঁরা। রাজনৈতিক কর্মসূচীতে ওইসব পুলিশ সদস্য হয়ে ওঠে বেশি উচ্ছৃঙ্খল। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের পাশাপাশি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এখন সাংবাদিকরা পুলিশের আক্রোশের শিকার হচ্ছেন বেশি। আদালত থেকে শুরু করে কোথাও পুলিশের কাছে নিরাপদ ভাবছেন না। দলীয়ভাবে পুলিশকে ব্যবহার করা ঠিক হচ্ছে না। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে কোন অপরাধ কর্মকা- ঘটানোর সাহস পেত না। তিনি আরও বলেন, এখন রাজনৈতিক ব্যানারে পুলিশে নিয়োগ, পদোন্নতি বন্ধ করতে হবে। পেশাকে পেশাই মনে করতে হবে। আর এখন আমরা কি দেখছি। সরকারের অমুক নেতার তোষামোদ করতে পারলেই বড় অফিসার হওয়া যায়। দলীয় আনুগত্য থেকে বেরিয়ে না এলে পুলিশের সুনাম ফিরে আসাটা সুদূরপরাহত। পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। মূলত রাজনৈতিকভাবে পুলিশ আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় বলে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। এখন প্রকাশ্যে পুলিশ নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এটা আগামী দিনের জন্য ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত।