কক্সবাজারের রামুতে দু'টি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। একটি হচ্ছে ফেসবুকে উত্তম কুমার বড়–য়ার অ্যাকাউন্টে কুরআনের এক চিত্র, যার ওপর একজন নারী পা দিয়ে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, এর প্রতিক্রিয়ায় রামুর বৌদ্ধ গ্রামে হামলা এবং কয়েকটি বৌদ্ধ উপাসনালয় পুড়িয়ে দেয়া। দু'টি ঘটনাই ক্ষমার অযোগ্য। কুরআনের অসম্মান মুসলিম জাতির কাছে অসহ্য একটি বিষয়। অন্য দিকে একদল মুসলিমের প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধপল্লীতে হামলা কোনো বিচারেই মেনে নেয়া যায় না। ইসলামেও এর কোনো স্থান নেই। এ জন্য বাংলাদেশের সব ইসলামি দল এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। ৪ অক্টোবর ডেইলি স্টারের রিপোর্টে দেখা যায়, একটি ফোন রিপেয়ারের দোকান থেকে এর সূত্রপাত। দোকানের মালিক উমর ফারুক উত্তম কুমার বড়–য়ার ফেসবুকের অ্যাকাউন্টে কুরআনের অপমানজনক ছবিটি দেখেন। এ খবর অন্যরা জানলে তারা তার কাছে কপি চান। ফারুক ছবিটির কপি তাদের দেন। পরে আরো লোক এসে ছবি চান। ফারুক দিতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত দিতে বাধ্য হন। এভাবেই ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে লোকজন একত্র হয়ে মিছিল করে এবং একসময় বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালায়। আমি এ রিপোর্ট থেকে বুঝতে পেরেছি উত্তম কুমার বড়–য়ার ফেসবুক থেকে ছবিটি ছড়িয়ে পড়ায় হঠাৎ উত্তেজনায় এ দুর্ঘটনা ঘটে, যা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। এতে কোনো রাজনৈতিক দল বা ইসলামিক দল বা রোহিঙ্গারা জড়িত নয়; যদিও সরকারের ভেতরের এবং বাইরের কিছু লোক এ ঘটনার জন্য রোহিঙ্গা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ইসলামি দলকে দায়ী করছেন। বিশেষ করে সরকারের এটা করা উচিত নয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেকুলার ও বামের কিছু লোক নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলছেন যে, এটা সম্প্রদায়িক চেতনার জন্য হচ্ছে। এটা সেকুলার ও বামের পুরনো রোগ। আর যারা বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে পরিচিত তারা জানেন যে, সাম্প্রদায়িকতা বলতে বাম ও সেকুলাররা ইসলাম, ইসলামি দল, ইসলামপ্রীতি ও ইসলামি রাষ্ট্র দাবির প্রতি ইঙ্গিত করে থাকেন। এরা ইসলামি দল নিষিদ্ধ করা চান, শিক্ষায় ইসলামের কোনো স্থান চান না। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব। সমাজতত্ত্বে বা সোসিওলজিতে সম্প্রদায় (কমিউনিটি, সোসাইটি) একটি পজিটিভ পরিভাষা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। সমাজতত্ত্বে এটা কোনো নিন্দনীয় পরিভাষা নয়। সমাজে সম্প্রদায় থাকবে। সব সম্প্রদায়ের অধিকার রয়েছে তার বিশ্বাস মোতাবেক চলার এবং কর্মসূচি নেয়ার। মুসলিমসমাজ বা সম্প্রদায়েরও একই অধিকার। ইসলাম একই সাথে একটি ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা। তাই মুসলমানেরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে তাদের ইসলামি সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন করার সব ধরনের চেষ্টা করা তাদের অধিকার। এটাকে সাম্প্রদায়িক চেতনা বলে নিন্দা করা যায় না। অসাম্প্রদায়িক অর্থ যার কোনো সম্প্রদায় নেই। তার মানে তার কোনো আদর্শ ও নীতিবোধ নেই। এ ধরনের নীতিহীনতা ও নীতিহীন লোক দিয়ে কোনো কল্যাণ হতে পারে না। এসব শব্দের ভুল ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্র থেকে হটিয়ে দেয়ার জন্য। সবাই কমিউনিস্ট নয়, তবু কমিউনিস্ট পার্টি করলে তাকে সাম্প্রদায়িক বলা হয় না। সবাই সেকুলার নয়, তবু সেকুলার পার্টি করলে তাকে সাম্প্রদায়িক বলা হয় না। তাহলে ইসলামি দলের ক্ষেত্রে তা কেন বলা হবে? সবশেষে রামুর ঘটনার শিক্ষা কী? প্রথমত, ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করা যাবে না। তার ফলাফল ভালো হবে না। দ্বিতীয়ত, উত্তেজনার বশে নিরীহ লোকদের ওপর হামলা করা যাবে না। যারা এসব করবে তাদের যথাযথ শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সরকারি এজেন্সিগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। রামুর ক্ষেত্রে এরা দেরিতে কাজ করেছে, যার ফলে অনেক বাড়ি ও ধর্মস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে যারা দায়ী নয়, তাদের দায়ী করা যাবে না। আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বোধ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রচার-প্রসার ঘটাতে হবে। লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার (নয়া দিগন্ত, ০৯/১০/২০১২) |