স্টাফ রিপোর্টার ॥ 'যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই পক্ষ নিলে রক্ষা নাই', 'একাত্তরের হাতিয়ারÑ গর্জে উঠুক আরেকবার' স্লোগানে রবিবার রাজধানীর রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং 'দলগত যুদ্ধাপরাধী' জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। বয়সে তারুণ্য পেরিয়ে এলেও মিছিলে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বজ্রমুষ্ঠিতে ছিল অদম্য শক্তির ছাপ। চোখে-মুখে ছিল স্বাধীনতাবিরোধী খুনী, ধর্ষণকারীদের প্রতি ঘৃণার আগুন।
মিছিল শুরুর আগে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরে মিছিল বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে এসে শেষ হয়।
মিছিল উদ্বোধন করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয় উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি, সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোন মতবিরোধ নেই। যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করা দুরূহ হয়ে পড়বে। সমাবেশ শেষে শতাধিক ট্রাক, বাস, মাইক্রোবাসে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা মিছিল বের করে। মিছিলটি মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ থেকে শুরু হয়ে রাসেল স্কয়ার, সায়েন্স ল্যাবরেটরী, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, মতিঝিল, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মিরপুর-১০, টেকনিক্যাল মোড়, কলেজ গেট, আসাদ গেট হয়ে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে এসে শেষ হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি সংবলিত বিভিন্ন সেøাগান লেখা রংবেরঙের ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন বহন করে। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের লোগো সংবলিত ক্যাপ, গেঞ্জি পরিধান করে মিছিলে অংশ নেন। এ সময় অনেকে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করে। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা নাড়িয়ে রাজধানীবাসীকে বিজয় মাসের শুভেচ্ছাও জানান। মিছিল চলাকালে রাস্তার দু'পাশে দাঁড়িয়ে, উঁচু ভবনগুলোর ছাদে, বিভিন্ন বাসা থেকে নানা বয়সী মানুষ হাত তালি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছার জবাব দেন এবং তাঁদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। মিছিলটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে এসে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক গোলাম আযম, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, আবুল কালাম আজাদ (বাচ্চু রাজাকার), আবদুল আলীমের কুশপুতুল দাহ করেন। মিছিলে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমান্ড, প্রাতিষ্ঠানিক ইফনট কমান্ডসমূহ, ঢাকার আশপাশের জেলা ও উপজেলার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।
এর আগে সকাল নয়টার পর থেকেই বিভিন্ন ইউনিটের মুক্তিযোদ্ধারা মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে সমবেত হতে থাকেন। তাঁরা বাস, ট্রাকে করে এসে সমবেশস্থলে উপস্থিত হন। এ এলাকায় সকাল থেকেই মাইকে দেশাত্মবোধক গান এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজতে থাকে। দুপুর ১২টায় মিছিল শুরু হয়।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, আমরা সবাই যে স্বাধীনতা ভোগ করছি, তা কারও দানে আসেনি। আমাদের স্বাধীনতা কোন গোলটেবিল বৈঠক থেকে আসেনি। নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। আর এর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্ব জেনেছে, আমরা বিশ্বের অন্যতম বীরের জাতি। আশরাফুল বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা একাত্তর সালে যেমন আমাদের ওপর চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়েছিল এখনও তারা একই কাজ করছে। প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধু আওয়ামী লীগের দাবি নয়, এটা জাতির দাবি। গত নির্বাচনে দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে রায় দিয়েছে। দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর দেখতে চায়। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় ঘোষণা কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক, সুলতান উদ্দিন আহমদ রাজা, মহাসচিব (প্রশাসন) এমদাদ হোসেন মতিন, মহাসচিব (কল্যাণ) মনিরুল হক, যুগ্ম- মহাসচিব সফিকুল বাহার মজুমদার টিপু, সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। সমাবেশে জানানো হয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম এমপি রাষ্ট্রীয় কাজে ভারতে অবস্থান করায় সমাবেশে উপস্থিত না থাকলেও তিনি দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সমাবেশে হেলাল মোর্শেদ খান মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাসব্যাপী কর্মসূচী ঘোষণা করেন। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ৩ ডিসেম্বর প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট কমান্ডসমূহের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে মানববন্ধন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি প্রদান। এইদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মাসের অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সামনে মানববন্ধন, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন, ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মাননা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, প্যারেড স্কয়ারে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ, ১৭ ডিসেম্বর প্যারেড স্কয়ারে প্রীতিভোজে অংশগ্রহণ, ১৮ ডিসেম্বর শিখা চিরন্তনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ১৯ ডিসেম্বর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল, ২৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে মানববন্ধন, ৩০ ডিসেম্বর বিজয় র্যালি ও সমাবেশ এবং ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সামরিক-বেসামরিক উর্ধতন কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, সাব সেক্টর কমান্ডার, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের সম্মানে নৈশভোজ।
আজ ট্রাইব্যুনালের সামনে মানববন্ধন: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আজ সোমবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে মানববন্ধন করবেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট কমান্ডসমূহের উদ্যোগে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবেন মুক্তিযোদ্ধারা।